বার্ডফ্লু
এক প্রকার ভাইরাস-ঘটিত সংক্রামক রোগ। বন্য প্রজাতির যে সব পাখি জলচর, তাদের মধ্যে কোন রকম ক্ষতি ছাড়াই এই রোগের ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় বসবাস করে। ভাইরাস-পোষক কোন জলচর পাখিদের সংস্পর্শে যখন গৃহপালিত পাখিসমূহ (হাস, মুরগি) আসে তখন তাদের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়। প্রথম দিকে মনে করা হতো পাখিরাই কেবল এই রোগের শিকার। কিন্তু ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে প্রথম মানুষের দেহে এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়। বর্তমানে এই ভাইরাসকে মানুষের জন্য ক্ষতিকারক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। 

বার্ডফ্লু রোগের ভাইরাসের পরিচয়
সাধারণভাবে এটি বার্ডফ্লু ভাইরাস নামে পরিচিত। জীববিজ্ঞানীদের মতে- এটি  মিক্সো ভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত অর্থোমিক্স উপ-পরিবারের সদস্য। প্রাথমিক বিভাজনে এদেরকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বলা হয়। জীববিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।এর এই ভাগ তিনটি হল- A,BC। এর ভিতরে BC গ্রুপের ভাইরাসগুলো মানুষ বা পাখির জন্য ক্ষতিকারক নয়। এই বিচারে এদেরকে  নিরীহ বা অক্ষতিকারক গ্রুপ হিসাবে বিবেচন করা হয়। বার্ডফ্লু হল- A গ্রুপের সদস্য। এই ভাইরাসের শরীরের উপরে দুই ধরনের প্রোটিন থাকে। একটিকে বলে হেমাগ্লুটিনিন (H) এবং অন্যটি হলো নিউরামিনিডেজ (N)। এ পর্যন্ত হেমাগ্লুটিনিন (H) এর ১৬ টি ক্যাটাগরি ও নিউরামিনিডেজ (N) এর ৯টি ক্যাটাগরির সন্ধান পাওয়া গেছে। হেমাগ্লুটিনিন (H) এর পঞ্চম ক্যাটাগরি H5  ও নিউরামিনিডেজ (N) এর প্রথম ক্যাটাগরি N1 এর সমন্বয়ে গঠিত বর্তমানের H5N1 স্ট্রেনটির শরীরের বহিরাবরণী এই কারণে এই ভাইরাসে শনাক্তকারী নাম রাখা হয়েছে- H5N1। এই স্প্যানিশ ফ্লু-র গবেষণার সূত্রে, বিজ্ঞানীরা বার্ড-ফ্লু'র গবেষণা হাত দিয়েছিল বিশ্ব-স্বাস্থ্য গবেষকরা। এই রোগটি প্রথম হংকং-এ সন্ধান পাওয়া যায় বলে- এর অপর নাম হংকং ফ্লু।

সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হল, এই ভাইরাসটি প্রতি মূহুর্তেই নিজেকে বদলে নিতে পারে। ফলে কোন সুনির্দিষ্ট টিকা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী হয়ে উঠে না। বিজ্ঞানীদের মতে, মহামারী সৃষ্টি করার জন্য একটি ভাইরাসের তিনটি গুণ থাকা অতি জরুরী। প্রথমটি হলো কার্যকরভাবে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটানো। দ্বিতীয়টি হলো মানবদেহে টিকে থাকার ক্ষমতা ও তৃতীয়টি হল মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হবার যোগ্যতা অর্জন। এই ভাইরাসটির মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হবার যোগ্যতা নেই, তাই এই রোগকে মহামারী পর্যায়ে ফেলা হয় না।  তবে জিনগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটলে, এই ভাইরাস মহামারীর সৃষ্টি করবে।

বার্ডফ্লু ভাইরাসের প্রথম সন্ধান
এই ভাইরাসজনিত রোগের প্রায় সমগোত্রীয় রো্গ হলো- স্প্যানিশ ফ্লু। এর নাম-H1N1। স্প্যানিশ ফ্লু সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তা হল- ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে মার্কিন সেনাবাহিনীর এক বাবুর্চি প্রচণ্ড জ্বর হয়। চিকিৎসক প্রথমে সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা দিয়েছিল। এই চিকিৎসায় ও সৈনিক সুস্থ হয়ে উঠেনি। এরপর দেখা গেল পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এই ধরনের জ্বরে পাঁচশ মানু ষ আক্রান্ত হয়। পরে এর অর্ধেকেরও বেশী ঐ জ্বরে প্রাণ হারায়। কেবল মার্কিন সেনাবাহিনীর ব্যারাকে নয়, মাত্র এক বছরের মধ্যে পৃথিবীর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই সময় মৃত্যবরণ করেছিল প্রায় ৫ কোটির মত রোগী।

বিজ্ঞানীরা বার্ড-ফ্লু-র মানুষে সংক্রমণের বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারেন ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে, হংকং-এ। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি  সময়ে এটি হাঁস-মুরগীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে মাসে লক্ষ্য করা যায় যে, অসুস্থ মুরগীর সংস্পর্শে আসা মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। ২০০৭ খ্রিষ্তাব্দে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আশপাশে এই রোগের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়।

বার্ড-ফ্লু-র উপসর্গ
মুরগীর ক্ষেত্রে
১. মুরগীর পালক অমসৃণ হয়ে যায়।
২. মুরগীকে অবসাদগ্রস্ত বা ঝিমাতে দেখা যায়।
৩.অস্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে শুরু করে মুরগী।
৪. মুরগীর ঝুটিতে বেগুনীভাব চলে আসে এবং ফুলে যায়।
৫. ডিম দেয়া কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে নরম খোসাযুক্ত ডিম পাড়ে।

মানুষের দেহ
মানবদেহে প্রবেশের পর ২ থেকে ৪ দিন এই ভাইরাস সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে। ভাইরাস সংক্রমিত হলে যে সব লক্ষণ ফুটে ওঠে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. তীব্র জ্বর (৩৮ ডিগ্রী সেলঃ এর উপরে)
২. শ্বাসযন্ত্রের নিচের দিকে বা পেটের উপর দিকটায় প্রচণ্ড ব্যাথা হয়।
৩. কফের সাথে রক্ত আসতে পারে।
৪. নিউমোনিয়ার লক্ষণ উপস্হিত থাকে।
৫. শ্বাস নিতে নিদারুণ কষ্ট হয়। শ্বাস গ্রহণকালে ভাঙা ভাঙা শব্দ হয়।
৬. গলার স্বর কর্কশ হয়ে যায়।
৭. পানির মত পাতলা পায়খানা দেখা দিতে পারে (বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশী হয়)

বার্ড ফ্লু'র চিকিৎসা
বর্তমানে ‘অসিলটামিভার’ (বাণিজ্যিক নাম 'টামি ফ্লু') এবং 'জেনামিভার' (বাণিজ্যিক নাম 'রেলেঞ্জা')- এই দুইটি ঔষধকেই প্রধান ঔষধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ‘টামি ফ্লু’ হল বড়ি আকৃতির প্রতিষেধক এবং ‘রেলেঞ্জ’ ইনহেলার ধরনের ঔষধ।

লক্ষণ প্রকাশ পাবার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এন্টিভাইরাল ড্রাগ ব্যবহার করতে পারলে ভাল ফল পাবার সম্ভাবনা থাকে। অসিলটামিভারের ক্ষেত্রে দিনে দুইবার ৭৫ মিলিগ্রাম করে ৫ দিন খাওয়াটাই উপযুক্ত ডোজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বাচ্চাদের জন্য এটির মাত্রা ৪০ মিলিগ্রাম হওয়া উচিত্।

আক্রান্ত হবার পর বিশ্রামের কোন বিকল্প নেই। শরীরের জলশুন্যতা দূর করার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। ঘরোয়া পথ্য হিসাবে কাঁচা হলুদ, রসুন, আদা বেশ উপকারী। কারণ এদের এন্টিভাইরাল গুণ বেশ প্রশংসনীয়।

এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করার জন্য ভাইরাল কালচার, সেরোলজীক্যাল টেস্ট, পি.সি.আর টেস্ট, এন্টিজেন ডিটেকশন টেস্ট, আর.ই.এ পরীক্ষা করা যায়। তবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত কুইক এন্টিজেন ডিটেকশন টেস্টের মাধ্যমে ৩০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

বার্ড ফ্লু সম্পর্কে সতর্কতা
রোগাক্রান্ত হাঁস-মুরগী, তাদের বিষ্ঠা ও অন্যান্য তরল যেমন শ্লেষ্মার মাধ্যমে ভাইরাসের নিঃসরণ ঘটে। ভাইরাস মিশ্রিত ধূলিকণা নাক ও গলা দিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই সন্দেহজনক এলাকাতে ‘মাস্ক’ ব্যবহার করা যেতে পারে।

এভিয়ান ফ্লু একটি সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ। তাই ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় হাত মুখ পরিষ্কার রাখতে হবে। সৌজন্য সাক্ষাতের সময় হ্যান্ডশেক না করাই ভালো।

রান্না করলে পোলট্রির মাংসের ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পোলট্রির মাংস ৭০ ডিগ্রী সেঃ এ পৌঁছায় এমনভাবে রান্না করতে হবে (সাধারণ ভাবে রান্না সম্পন্ন করতে এর চেয়ে বেশী তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়)। কাঁচা মাংসের সকল অংশে যেন তাপ লাগে- এটা নিশ্চিত করতে হবে।

রোগাক্রান্ত মুরগীর দেয়া ডিমের অভ্যন্তরে ও খোলসের উপরিভাগে ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অসুস্থ পাখি সাধারণ ডিম দেয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু রোগের প্রথম পর্যায়ে দেয়া ডিমগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ডিম ভালভাবে রান্না করতে হবে (৭০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার উপর)। কোন অংশ যেন কাঁচা না থাকে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।

নিম্ন তাপমাত্রায় (৪ ডিগ্রী সেঃ) এই ভাইরাস ৩৫ দিন বেঁচে থাকতে পারে। হিমায়িত অথবা হিমায়িত অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হতে দেয়া হয়েছে এমন কাঁচা পোলট্রি বা ডিম স্পর্শ করার পর ভালভাবে হাত ধুঁয়ে নিতে হবে। এর সংস্পর্শে এসেছে এমন স্থান  ও তৈজসপত্র পরিষ্কার করা প্রয়োজন।

ইন্‌ফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ধ্বংস করার জন্য শক্তিশালী জীবাণুনাশকের তেমন কোন প্রয়োজন নেই। সাধারণ সাবানই যথেষ্ট। এই ভাইরাস উচ্চ তাপমাত্রা (৭০ ডিগ্রী সেঃ), ক্লোরিন-পানি, এমনকী ঘন লবণের দ্রবণকেও সহ্য করতে পারে না।

গৃস্থালি পরিষ্কার করার সময় শুকনা কাপড়ের পরিবর্তে ভেজা কাপড় ব্যবহার করুন। কারণ এই ভাইরাস ধূলিকণায় ভর করে অ্যারোসল আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

একটি জীবন্ত পাখি হত্যা ও খাদ্যের জন্য প্রস্তুত প্রক্রিয়ায়, সংক্রমিত বা রোগাক্রান্ত পাখি থেকে ভাইরাসটি মানবদেহে স্থানান্তরিত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল জবাই ও কাটাকুটির কাজটি। বাড়িতে হাস মুরগি জবাই করা বন্ধ করতে হবে।