আর্য
ইংরেজি :
aryan।
ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ নৃগোষ্ঠী। এই নামটি বিশেষভাবে ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের পরিচয় প্রদানের জন্য ব্যবহার করতো। তবে ভারতের বৈদিক এবং পৌরাণিক যুগে এই নামটি নানা অর্থে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ৫১ সুক্তে রয়েছে আর্য এবং দস্যু শব্দ পাওয়া যায়।
[হে ইন্দ্র! কারা আর্য এবং করা দস্যু তা অবগত হও। কুশযুক্ত যজ্ঞের বিরোধীদের শাসন করে বশীভূত কর।]
এক্ষেত্রে যজ্ঞ করতেন যাঁরা তাঁদেরকে আর্য
বলা হয়েছে। ঋগ্বেদের কালে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দ), বেদের অনুসারী
ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর মানুষে হয়তো আর্য বলা হয়েছে, অন্যান্য অনার্য
জনগোষ্ঠীকে বলা হয়েছে দস্যু। তবে বেদে নানা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। পাশ্চাত্য
পণ্ডিতদের অনেকের মতে কৃষিজীবিদের আর্য বলা হয়েছে। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, আর্য কোনো
নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নয়, ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠী। যদি এই সত্য মেনে নেওয়াও যায়, তাহলেও
বলা যায়, যাঁরা আর্য ভাষায় কথা বলতেন, তাঁরাই যেমন আর্য। যেমন একালে আমরা বলি,
জাপনি, বাঙালি, জার্মানি ইত্যাদি।
আর্য শব্দটি জাতিগত শব্দ হিসেবে আর্য-ভাষাভাষীরা ভারতীয়রা গ্রহণ করেছিলেন বেশ
গভীরভাবেই। এর প্রভাব পড়েছিল ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণেও। যেমন ভারতের
ইন্দো-ইরানিয়ান সংস্কৃতির বিচারে বড় ধরনের একটি অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছিল
আর্যবর্ত্ম।
ভারতবর্ষে
আর্যদের উৎস:
ধারণা করা হয়, একদল মানুষ
১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ,
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ৭৫ হাজার বৎসর আগে এদের একটি দল
আরব উপদ্বীপে পৌঁছায়। আর ৬০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা এশিয়া সংলগ্ন ইউরোপে বসতি
স্থাপন করে। ৪০ হাজার বৎসরে ভিতরে ইউরোপের
রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে
ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার বৎসরের দিকে এদের একটি দানিয়ুব নদীর
তীরবর্তী বিশাল তৃণাঞ্চলে বসবাস করা শুরু করে। সে সময়ে বসবাস এদের ছিল মূল পেশা ছিল
পশুপালন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আন্তঃগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের সূত্রে এদের একটি দল এই
অঞ্চল ত্যাগ করে দার্দেনেলিশ প্রণালী হয়ে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫
হাজার বৎসরের দিকে এরা ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদী পার হয়ে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এদের একটি দল চলে যায় ইউরোপের দিকে, অপর দলটি চলে আসে ইরানের
দিকে। আর খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতে
প্রবেশ করা। ইরানে যারা থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলা হয় ইন্দো-ইরানীয়। আর ভারতে যারা
প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে বলা হয় আর্য।
ছোটো ছোটো দলে এরা এদের ভারতে প্রবেশের
প্রক্রিয়াটি প্রায় ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত চলেছিল। আর্যদের রচিত ঋগবেদের ভাষার সাথে
জেন্দভেস্তা ভাষার অদ্ভুদ মিল রয়েছে। ধারণা করা হয়, ইরানের প্রাচীন ভাষা এবং
আর্যদের ভাষা একই ছিল। হাজার হাজার বৎসর অতিক্রম করে উভয় ভাষা স্বতন্ত্র রূপ লাভ
করেছিল। এছাড়া উভয় ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত দেবদেবীদেরও অনেক মিল আছে। জেন্দভেস্তা
বরুণকে দেবরাজ ও ইন্দ্রকে মন্দ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ঋগবেদে বরুণ জল ও
মেঘের দেবতা আর ইন্দ্রকে দেবরাজ। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে কশ্যপ মুণির নামানুসারে
কাস্পিয়ান হ্রদের নাম করণ করা হয়েছে। কয়েকজন পশ্চিমা নৃবিজ্ঞানিও এ মতের সমর্থন
করেছেন। এমতবাদ কে আউট অব ইন্ডিয়া (Out of India) হিসাবে অভিহিত করা হয।
আর্যরা ভারতের সিন্ধু নদীর অববাহিকা জুড়ে স্থানীয় দ্রাবিড়দের বিতারিত করে আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল। ঋগ্বেদ থেকে জানা যায় আর্যরা আফগানিস্তান থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই বেদে যমুনা, গঙ্গা নদীর নাম নেই। ঋগ্বেদের আমলে এরা হিমালয় পর্বতমালা সংলগ্ন উত্তরভারতের সাথে পরিচিত হয়েছিল। এই কারণে হিমালয় পর্বতের নাম পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। কিন্তু বিন্ধ্যপর্বতের নাম পাওয়া যায় না। এই বিচারে ধারণা করা যায়, ঋগ্বেদের আমলে বিন্ধ্যপর্বত পর্যন্ত আর্যরা পৌঁছাতে পারে নি। হিংস্র জীবজন্তুর মধ্যে ঋগ্বেদে বাঘের নাম নেই। কারণ, ভারতবর্ষের বাঘের দেখা পাওয়া যায় ভার্তবর্ষের পূর্বাঞ্চলে। সে কারণেই বলা যায়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের বঙ্গদেশ থেকে এরা অনেকদূরে ছিল। এই সময় পাঞ্চাব অঞ্চলের সিন্ধুসহ অন্যান্য নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে আর্যরা বসতি স্থাপন করেছিল। ঋগ্বেদ খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ বা ১১০০ অব্দের দিকে রচিত। এই সূত্রে বলা যায়, আফগানিস্তান থেকে পাঞ্জাব অঞ্চলের ভিতরে আর্যদের বিচরণ ছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর আর্যদের প্রভাব তখনো পড়ে নি।
পাঞ্জাব এবং এর আশপাশের কিছু অংশে আর্যরা বসতি স্থাপন করে নিজেদেরকে সুস্থির অবস্থায় আনতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময় এরা পাথর, ব্রোঞ্জ এবং তামার তৈরি কুঠার কোদাল ইত্যাদি ব্যবহার করতো। এই সব অস্ত্রপাতি দিয়ে সেকালের বিশাল বনজঙ্গল পরিষ্কার করে করে গঙ্গানদী পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় ব্যয় করেছিল। অবশ্য খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে আর্যরা লৌহের ব্যবহার শিখেছিল। কিন্তু ব্যাপকভাবে লৌহের ব্যবহার করতে পেরেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দের দিকে । এরপর থেকে এদের অগ্রযাত্রা দ্রুততর হতে থাকে। শক্ত এবং ধারালো অস্ত্র তৈরির জন্য লোহার আর্য সভ্যতাকে আরও সুস্থির করতে সহায়তা করেছিল। এরা লোহার কুঠার ব্যবহার করে দ্রুত জঙ্গল পরিষ্কার করে, লোহার তৈরি লাঙ্গলের ফলার সাহায্য ব্যাপক কৃষি কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল। সে কারণে, সে সময়ে ঋষিরা নানা রকম বিষয় নিয়ে ভাববার সময় পেয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দের দিকে আর্য ঋষিরা রচনা করেছিল উপনিষদ।
এই সময় অনার্য গোষ্ঠীদের সাথে তাদের প্রায়ই সংঘাত হতো। আক্রমণপরায়ণ অনার্যদের এরা নাম দিয়েছিল দস্যু। একসময় আর্যদের ছোটো ছোটো গোষ্ঠী এইসব দস্যুদের দমন করে, ছোটো ছোটো রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তী প্রায় ২০০ বৎসর এরা ক্রমান্বয়ে এই ভাবে গাঙ্গেয় উপত্যকা ধরে ধরে পূর্ব ভারতের দিকে এগিয়ে চলেছিল।
এই সময় স্থানীয় ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার সংমিশ্রণে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, স্থানীয় ভাষাগুলো নতুন রূপ লাভ করেছিল। খ্রিষ্ট-পুর্ব ৫৬৭ অব্দের দিকে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। নেপালের দক্ষিণাংশে এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের যোধপুর রাজ্য নিয়ে একটি রাজপুত রাজ্য ছিল। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সেই রাজ্যের রাজপুত্র। গৌতম বুদ্ধের সূত্রে ভারতীয় আর্য দর্শনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল। প্রথমদিকে আর্য রাজার বুদ্ধের দর্শনকে আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। এবং আর্য ঋষিদের ভিতরে বৌদ্ধ দর্শনের চর্চা ছিল। মহাভারতে আদি পর্বে রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়ায় গিয়ে হরিণের পিছু পিছু কণ্ব মুনির আশ্রমে গিয়ে- বৌদ্ধমতালম্বী লোকেদের ধর্ম্মালোচনা দেখতে পেয়েছিলেন। [মহাভারত আদিপর্ব ৭০ অধ্যায়]। মহাভারতের এই অধ্যায় অনুসরণে বলা যায় -রাজা দুষ্মন্তের পুত্র ভরত রাজ্য লাভ করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের ভিতরে। আর মহাভারত রচিত হয়েছিল সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের ভিতরে।
কোথাও বা শব্দ সংস্কারসম্পন্ন দ্বিজগণ বেদগান দ্বারা সেই ব্রহ্মলোক-সদৃশ আশ্রমকে নিনাদিত করিতেছেন; কোন স্থলে যজ্ঞানুষ্ঠানক্রম, পুরাণ, ন্যায়, তত্ত্ব, আত্মবিবেক, শব্দশাস্ত্র, ছন্দঃ নিরুক্ত ও বেদবেদাঙ্গ প্রভৃতি নানা শাস্ত্রে পারদর্শী, বিশেষ কার্য্যজ্ঞ, মোক্ষধর্ম্মপরায়ণ, উহাপোহ [তর্করহিত] সিদ্ধান্ত-কুশল, দ্রব্য-কর্ম্মের গুণজ্ঞ, কার্য্যকারণবেত্তা, পক্ষী ও বানর প্রভৃতি জীবগণের বাক্যার্থবোদ্ধা মহর্ষিগণ নানাশাস্ত্রের বিচার করিতেছেন এবং বৌদ্ধমতালম্বী লোকেরা নিজ ধর্ম্মের আলোচনা করিতেছেন।
ধর্মীয় দর্শনের ধারায় আরও একটি ধর্মের আবির্ভাব ঘটলো মহাবীরের সূত্রে। মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪০ অব্দের দিকে। এই ধর্মের ও সনাতন আর্যধর্মের প্রবল ধাক্কা লেগেছিল।
মূলত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের কারণে উত্তরভারতে আর্যদের সাথে অনার্যদের সম্মিলনকে ত্বরান্বিত করেছিল দ্রুত। কালক্রমে উত্তরভারতে আর্য নামক পৃথক জাতি সত্তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে ভারতবর্ষে আর্য নামে কোনো পৃথক নৃগোষ্ঠী নেই। কিন্তু ধর্ম, ভাষাসহ সাংস্কৃতিক নানা উপাদান ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যামান রয়েছে।