নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে— প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার ইথিওপিয়া অঞ্চলে। এদের প্রথম দলটিকে সাধারণভাবে নেগ্রিটো নামে অভিহিত করা হয়। ক্রমে ক্রমে এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে, প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের দিকে এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫ হাজার অব্দের ভিতরে,
আফ্রিকা থেকে একটি দল পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই দলটিকে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
নামে অভিহিত করে থাকেন। প্রায় ৫০-৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা একসময় সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাদদেশ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশ, বাঙলা, অসম
হয়ে এরা বার্মা ও কম্বোডিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্রায় ৪০-৩০ হাজার
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা
ইন্দোনেশিয়া মেলেনেশিয়া হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো অস্ট্রেলিয়ার
আদিবাসী। এদেরকে সাধারণভাবে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলা হয়।
আদিতে প্রোটো-অস্ট্রেলয়েড-রা ছিল
অরণ্যচারী এবং মূলত শিকারী। তারা কৃষি কাজ জানতো না, জীবিকার জন্য নির্ভর
করতো বনের ফলমূল আর বন্যপ্রাণী। এরা খর্বাকার, মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি, নাক চওড়া ও চ্যাপটা, গায়ের রঙ কালো ও মাথার চুল
ঘন ও ঢেউখেলানো। চিবুক বেশ ছোটো । এদের আগমনের
ফলে ভারতের
আদি
নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে
পড়েছিল। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে বিলীন হয়ে
গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য
হারিয়েছিল। আদিবাসী হিসেবে ভারতে
নেগ্রিটো-কে সবার আগে
স্থান দিলেও মূলত প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরাই ভারতরে মূল জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছিল।
এদের মূল ধারা হিসেবে ভারতবর্ষে রয়েছে কোল, সাঁওতাল, মুণ্ডা (মুণ্ডারি)
ইত্যাদি। তথ্য সূত্র
:
এরা যে ভাষায় কথা বলতো,
ভাষাবিজ্ঞানীরা তার গোষ্ঠীবদ্ধ নাম দিয়েছেন অষ্ট্রিক। এরা বঙ্গোপসাগরের জাভা বর্ণিও
থেকে পশ্চিমে এডেন পর্যন্ত বসতি গড়ে তুলেছিল। এরা অন্যান্য অঞ্চলের মতো বঙ্গদেশেও
এরা বসতি গড়ে তুলেছিল। কৃষিজীবি জাতি হিসেবে তারা বঙ্গদেশে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
এদের প্রশাসনিক কোনো কাঠামো বঙ্গদেশে গড়ে উঠে নি। ফলে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে
স্থায়ীভাবে রাজতন্ত্র গড়ে উঠে নি। এদের কোনো স্থাপত্য নিদর্শন ভারতবর্ষে পাওয়া
যায় না। এমন কি এমন কোনো স্থায়ী স্থাপত্য নিদর্শন ছিল কিনা তাও জানা যায় না।
এদের সমাজ ছিল দলনেতা ভিত্তিক গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এদের ছিল
অসংখ্য ছোটো ছোটো এরূপ ছোটো ছোটো গোষ্ঠী শাসন ব্যবস্থা। তারপরেও এদের ভিতর
সাধারণ সংস্কৃতি প্রায় একই ছিল।
স্বভাবগতভাবে আদি-অস্ট্রালরা সহজ-সরল, আমোদ-প্রিয়। ধারণা করা হয়, প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এদেরকেই নিষাদ ও ভিল্ল-কোল্ল নামে অভিহিত করা হয়েছিল।
এদের হাতে ভারতের আদি কৃষিকাজের
সূচনা হয়েছিল।
আদি-অস্ট্রালরা প্রধানত স্ত্রীসত্তার পূজা করতো। এদের প্রায় সব দেবতাই স্ত্রীদেবতা।
সম্ভবত এদের দ্বারাই ভারতে
আদ্যা শক্তিপূজার প্রবর্তন হয়েছিল। ভারতীয় জীবনযাত্রায় ধান, পান, হলুদ, সিঁদূর, কলা, সুপারি ইত্যাদির
ব্যবহার এরাই শুরু করেছিল।
এরা আত্মায় (সু ও কু) বিশ্বাস করতো। হিন্দুধর্মে পুনর্জন্মবাদের বীজ সম্ভবত এদের থেকে অঙ্কুরিত হয়। শ্রাদ্ধের মতো রীতিও এদের মধ্যে ছিল। এরা মৃতদেহকে সমাধিস্থ করে একটা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিতো। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের
মতে
এই অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়েরা মানুষের একাধিক জীবনে বিশ্বাস করিত,
এখনও করে। কাহারও মৃত্যু হইলে তাহার আত্মা কোনও পাহাড় অথবা গাছ অথবা কোন জন্তু
বা পক্ষী বা অন্য কোনও জীবকে আশ্রয় করিয়া বাঁচিয়া থাকে, ইহাই ছিল ইহাদের ধারণা;
পরবর্তী কালে এই ধারণাই হিন্দু পুনর্জন্মবাদ ও পরলোকবাদে রূপান্তরিত হয়। মৃতদেহ
ইহারা কাপড় অথবা গাছের ছালে জড়াইয়া বৃক্ষস্কন্ধে অথবা ডালে ঝুলাইয়া রাখিত, বা
মাটির নীচে কবর দিয়া তাহার উপর বড়ো বড়ো পাথর সোজা করিয়া পুঁতিয়া দিত, অথবা
স্ত্রীলোক হইলে কবরের উপর লম্বালম্বি করিয়া শোয়াইয়া দিত (গন্দ, কোরক, খাসিয়া
প্রভৃতিরা এখনও ঠিক যেমনটি করে), মৃতব্যক্তিকে মাঝে মাঝে আহার্যও দান করিত,
যেমন এখনও করে। এইসব বিশ্বাস ও রীতিই পরবর্তী কালে হিন্দুসমাজে গৃহীত হইয়া
শ্রাদ্ধাদি কার্যে মৃতের উদ্দেশে পিণ্ডদান ইত্যাদি ব্যাপারে রূপান্তরিত হইয়াছে।
লিঙ্গ-পূজাও ইহাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে হয়। ‘লিঙ্গ’ শব্দটিও তো
অস্ট্রিক ভাষার দান, এবং কোনও কোনও নৃতত্ত্ববিদ খাসিয়াদের সমাধির উপর যে
দীর্ঘাকার পাথর দাঁড় করানো এবং শোয়ানো থাকে তাহাকে যথাক্রমে লিঙ্গ ও যোনি বলিয়া
অনুমানও করিয়াছেন। বস্তুত, পলিনেশীয় ভাষায় এখনও ‘লিঙ্গ’ তাহার সুপরিচিত অর্থেই
ব্যবহৃত হয় এবং তাহার তুষ্টিবিধানের চেষ্টাও সুবিদিত।’
[বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব]
আদি-অস্ট্রালরা প্রধানত স্ত্রীদেবতারই পূজা করতো। এদের প্রায় সব দেবতাই স্ত্রীদেবতা। তাই এরাই ভারতে শক্তিপূজার আদি প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। ভারতীয় জীবনযাত্রায় ধান, পান, হলুদ, সিঁদূর, কলা, সুপারি ইত্যাদি এদেরই অবদান।
অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে–
‘অস্ট্রিকভাষীরা বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফলমূল, ফুল, কোনও বিশেষ স্থান, বিশেষ বিশেষ পশু, পক্ষী ইত্যাদির উপর দেবত্ব আরোপ করিয়া তাহার পূজা করিত। এখনও খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি কোমের লোকেরা তাহা করিয়া থাকে।
বাঙলাদেশে পাড়াগাঁয়ে বৃক্ষপূজা এখনও প্রচলিত
আছে। বিশেষকরে শেওড়াগাছ ও বটগাছের
পূজা সনতান ধর্মীরদের কেউ কেউ করে থাকেন। এছাড়া এরা পাথর ও পাহাড়-পূজাও
করতো। বিশেষ বিশেষ ফল-ফুল-মূল এরা দেবীকে উৎসর্গ করতো।
কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রচলিত নবান্ন উৎসব, মেয়েরা ব্রতানুষ্ঠান
ইত্যাদি এরাই শুরু করেছিল।
নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের
গুচ্ছ, দূর্বা, কলা, হলুদ, সুপারি, নারিকেল, পান, সিন্দূর, কলাগাছ প্রভৃতি
ব্যবহৃত হতো আদি-অস্ট্রালরা
সংস্কৃতিতে। বাঙালি সনাতন ধর্মীদের বিবাহে- ‘পানখিলি’, ‘গাত্রহরিদ্রা’,
‘গুটিখেলা’, ‘ধান ও কড়ির স্ত্রী-আচার’ সম্ভবত
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের আচার ছিল। এই নরগোষ্ঠীর ওঁরাও-মুণ্ডাদের ‘সরণা’
দেবীর মাথায় ধান্যশীর্ষের জটার দেখা যায়। এই দেবী কালক্রমে
সনাতন ধর্মীদের লক্ষ্মী দেবীতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সনাতন ধর্মীদের অনুরূপ
পিতৃপুরুষের পূজা এখনও সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, শবর, ভূমিজ, হো ইত্যাদি
জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মধ্যে সুপ্রচলিত রয়েছে।
World History- The Human Experience. Mounir Farah, Andrea Berens Karls. MGraw-Hill, 1985
http://www.cristoraul.com/ENGLISH/readinghall/UniversalHistory/INDIA/Cambridge/I/CHAPTER_II.html