সাইক্লোট্রোন
Cyclotron

কণা (প্রোটন ও নিউট্রোন) ত্বরকযন্ত্র। মৌলিক পদার্থের কণাসমহের গতি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। ১৯২৯-৩০ খ্রিষ্টাব্দে ক্যালিফোর্নিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলেতে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন আর্নেস্ট ও লরেন্সের (Ernest O. Lawrence) । ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পেটেন্ট পান। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে সিনোক্রোট্রোন (Synchrotron) যন্ত্র আবিষ্কারের পূর্ব-সময় পর্যন্ত সাইক্লোট্রোনই ছিল নির্ভরযোগ্য কণা ত্বরকযন্ত্র। তারপরেও এখনও সাইক্লোট্রোন কণা পদার্থ বিজ্ঞান এবং নিউক্লিয়ার ঔষধ শিল্পে ব্যাপক ব্যবহার করা হয়।

কণা গতিকে অধিকর দ্রুত করার জন্য এই যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল।

  ১৯২৫ দুই মার্কিন বিজ্ঞানী জি ব্রাইট ও এমটুভে তাঁদের সহযোগিদের নিয়ে একটা টান্সফর্মার তৈরি করলেন। এই ট্রান্সফর্মারের সাহায্যে কণাকে ত্বরিত করার উপায় তাঁরা বের করেন। কিন্তু খুব বেশি সফলতা পাননি। তারপর একদল জার্মান বিজ্ঞানী প্রোটন ত্বরক যন্ত্র তৈরি করেন। ত্বরিত প্রোটন দিয়ে তাঁরা পরমাণুর নিউক্লিয়াসকেও ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন এ ব্যাস্ক ও এফ ল্যাংলে। তাঁদের ত্বরক যন্ত্র কতটুকু সফল হত কে জানে, মাঝপথেই থেমে যায় তাঁদের কর্মকাণ্ড। বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান একজন পদার্থবিদ। কৃত্রিম ত্বরকযন্ত্র দিয়ে প্রথম সফলভাবে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙতে সক্ষম হলেন দুই বৃটিশ বিজ্ঞানী ডগলাস ককক্রফট ও আর্নেস্ট ওয়ালটন। তারা ক্ষরণ যন্ত্রে উচ্চ বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্য তৈরি করে কণাকে উচ্চ শক্তিতে ত্বরিত করতে সক্ষম হন। অতি উচ্চ বিভব পার্থক্য তৈরির জন্য তাঁরা একটা শক্তিশালী ট্রান্সফরমার বানালেন। সেটার বিভিব ছিল ২ লাখ ভোল্ট! সত্যিকার অর্থে এটাই ছিল প্রথম শক্তিশালী ও সফল কণা ত্বরকযন্ত্র। এরপরই কণা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব কণাত্বরক যন্ত্রের মহানায়ক আর্নেস্ট অরনাল্ডো লরেন্সের। নরওয়েজিন বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম এই মার্কিন বিজ্ঞানীর যতটা ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ঝোঁক, তার অনেক বেশি ঝেৎাক ছিল যন্ত্রপাতির প্রতি। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে যোগদেন ১৯২৮ সালে। সেখানকার লাইব্রেরির একটা জার্নাল পড়তে গিয়ে তাঁর মাথায় সাইক্লোট্রোন তৈরির চিন্তা আসে। এর আগে যেসব ত্বরক যন্ত্র তৈরি হয়েছির সেগুলো, কণাকে ত্বরিত করত সোজা পথে। লরেন্স ধরলেন একটু ভিন্ন পথ। তার যন্ত্রে ছিল একটা বৃত্তাকার পথ, সেই পথে কণাদের বার বার ঘু্রিয়ে এদের গতি বাড়ানো হয় প্রতিটা বাঁকে। এজন্য একটা বিশেষ উপায় বের করেছিলেন লরেন্স। তার যন্ত্রের ভেতর তৈরি করেছিলেন উচ্চ শক্তির চৌম্বক বলক্ষেত্র। চুম্বকক্ষেত্রর ভেতর রাখা ঞয় একটা আয়ন উৎস। উৎসটা এমনভাবে রাখা হয় তা থেকে নির্গত কণার কণার চৌম্বকক্ষেত্রের বলরেখার লম্বভাবে ছুটবে। কিন্তু চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে সে আর সোজা পথে চলতে পারবে না। তার চলার পথ হবে বৃত্তাকার। এরপর পড়বে এসি কারেন্টের পাল্লায়- জলন্ত উনন থেকে ফুটন্ত কড়াই আরকি। বৃত্ত পথে এই কারেন্টের বিদ্যুৎক্ষেত্র ভেতর চলতে গিয়ে পড়বে এর কম্পাংকের ধাক্কায়। কণাকে বৃত্তপথে ছুটতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হবে মুহূর্মুহূ বিদ্যৎ কম্পােঙ্কের পাল্লায়। কম্পন পথের ব্যস প্রতিবার অতিক্রম করার সময় বাড়বে কণার বেগ। প্রতি সেকেন্ডেই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কম্পন, কণার বেগও তাই হুহু করে বাড়বে। লাভ করবে প্রবল গতিশক্তি। সেই পরাক্রমশালী কণা দিয়ে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে আঘতে করলে কী ঘটবে ভাবা যায়! ভেঙে চুরমার হবে নিউক্লিয়াস মুক্ত হবে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এটাই ছিল লরন্সের সাইক্লোট্রনের মূলনীতি। আজকের এলএইচসির মতো সাইক্লোট্রনেও এই মূলনীতি মেনে চলা হয়। লরেন্স প্রথম যে সাইক্লোট্রন তৈরি করেন সেটার ব্যাস ছিল কয়েক ইঞ্চি মাত্র। এর পর একের পর এক সাইক্রোট্রনের তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিজ্ঞানীরা। ১৯৩৯ সাল নাগাদ সাইক্লোট্রনের ব্যাস গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৫ ইঞ্চিতে। এস সাইক্ল্রোট্রনে সাহায্যে ভারি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে তৈরি হলো না ধরনের আইসোটোপ। আর এই যন্ত্রের বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান লরেন্স। এরপর বাজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যক্তরাষ্ট্র আর জার্মান বিজ্ঞানীরা তখন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর সেকাজে বড় সহায়ক হয়ে ওঠে কণা ত্বরকযন্ত্র। আর মার্কিন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির অগ্রগামী নায়ক রবার্ট ওপেনহাইমর। সেও বন্ধু লরেন্সে অনুরোধ ও সুপারিশে। যুদ্ধের পর কণা পদার্থবিজ্ঞান প্রাণ ফিরে পায়। আর গবেষণাও চলে যায় বিগ সায়েন্সেরে দখলে। একের পর এক কণার ভবিষ্যদ্বাণী করছেন বিজ্ঞানীরা; কিন্তু সেগুলোর হদিস পাওয়ার জন্য চায় কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ। এখন আর নিউক্লিয়াসকে কণা দিয়ে আঘাত করলে চলবে না। কিন্তু অতি হালকা এসব কণা একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ করবে কনে? তাছাড়া সমচার্জের কণারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তাহলে? সংঘর্ষ ঠবে যদি সাইক্লোট্রনে কণাদের গতি কয়েক হাজর গুণ বাড়ানো যায়। সেই পরিমাণ গতিতে কণা ছুড়ে দেওয়া লরেন্সের সাইক্লোট্রনের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সেসময় প্রচলিত কোনো ত্বরক যন্ত্রের পক্ষেই। সত্তর দশকের শেষ দিকে আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়েনবার্গ আর শেলডন গ্ল্যাশোরা দুর্বল নিউক্লিয় বল আর বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে তাত্ত্বিকভাবে একত্রিত করতে সক্ষম হলেন। দুই বলের মিলনে জন্ম হলো তড়িৎদুর্বল বলের। আর এই বলের বাহক কণা W-, W+ এবং Z0 কণা। ইউরোপিয়ান কণা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্নের বিজ্ঞানীরা ১৭৪ সালের মধ্যে আবিষ্কার করে ফেললেন এই কণাগুলি। আর্ এই কাজের কাজী সার্নের শক্তিশালী কণা ত্বরকযন্ত্রগুলি। তখন সার্নের বিজ্ঞানীদের চোখ উঠে যায় আরও পরে। বস্তুর ভরের জন্য দায়ী যে কণা, সেই হিগস বোসন বা ইশ্বর কণার ইঙ্গিত ছিল আগেই। কিন্তু সেই কণা পেতে হলে যে পরিমাণ শক্তির দরকার, কণাকে সংঘর্ষ ঘটাতে যতটা ত্বরণের দরকার, সেই শক্তি বা ত্বরণ দান করার কষ্শতা তখনকার কণা ত্বরক যন্ত্রগুলো ছিল না। দরকার এরচেয়ে লক্ষকোটি গুণ শক্তিশালী সাইক্লোট্রন। আর সেজন্য সার্নের বিজ্ঞানীরা ভাবলেন এলএইচসির অর্থাৎ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। নামের মধ্যেই রয়েছে বিশালত্বের আভাস। কয়েক ইঞ্চি ব্যাস নিয়ে যে সাইক্লোট্রনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এলএইচসিতে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩ কিলোমিটার পরিধিতে। কিন্তু এত বিশাল দক্ষযজহ্ঞের আয়োজনটা সহজ ছিল। তাছাড়া টাকাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখ রাঙানিতে থমকে শুরুর আগেই হোঁট খেয়েছিল এলএইচসির পরিকল্পনা। জেড জিরো বোসন আবিষ্কারের পর নড়েচড়ে মার্কিন কণাবিজ্ঞানীরা। কণা আবিষ্কারের সাফল্য একের পর ঘর এক ঘরে তুলছে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের ভৎাড়ার পরিণত হতে চলেছে শূন্য কলসিতে। এ অবস্থান থেকে উত্তরণের উপায় এলএইচসি তৈরির আগেই এর চেয়ে বড় সাক্লোট্রন তৈরি করা। এর তড়িঘরে করে শুর হয় এসএসি প্রকল্প। অর্থাৎ সুপারকন্ডাক্টিং সুপার কোলাইডার। পরিধি ৮৭ কিলো, এলএচসির মতো এটাও বসানোর পরিকল্পনা ছিল মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে। রাশি রাশি টাকা ঢেলে শুরুও হয় কাজ। কিন্তু নোংরা রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে মাঝপথেই পণ্ড হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরক যন্ত্রের কাজ। এএসসির ডামাডোলে থমকে গিয়েছিল এলএইচসির শুরুর কাজ। কিন্তু ওটার বাতিলে আবার আশা দেখলেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। জোর কদমে শুরু হলো এলএইচসি প্রকল্পের কাজ। প্রায় দুই দশকের নির্মাণ কাজ শেষে ২০০৮ সালে চালু হয় এলএইচসি। এরপরই শুরু ঞয় হিগস বোসন আবিষ্কারের তোজড়। এলএইচসি’র সাইক্লোট্রনে প্রবল গতি নিয়ে প্রোটন কণার স্রোত ছুটে যায়, ধাক্কা মারে একে অপরকে। তা থেকে তৈরি হয় বহুরকমের কণা। কিছু ভারী কণাও তৈরি হয়। তবে তা অস্থায়ী। দ্রুতই সেই কণা কয়েকটা হালকা কণার জন্ম দিয়ে নিজে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিগস কণার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার কথা। সাইক্লোট্রনে জন্ম নেয়া নানা ধরনের কণাকে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের উৎস যে অন্য কণা নয়, হিগ্স কণা, এটা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল পদার্থবিদদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পড়্গ থেকে জানানো হয়, হিগস বোসন কণার অসিত্মত্ব প্রাথমিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ওই সম্মেলনে একথাও বলা হয়, হিগস বোসন প্রাপ্তি সম্পর্কে মোটমুটি নিশ্চিত হলেও শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন কণা। তবে এই সন্দেহের কফিনে এলএইচসির বিজ্ঞানীরা শেষ পেরেক ঠোকেন ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ইতালির এক সম্মেলেনে। তাঁরা এখন শতভাগ নিশ্চিত নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন। হিগস বোসন আবিষ্কারে সাথে সাথে বিজ্ঞান জগতে খুলে যায় এক নতুন দিগন্ত। মেলে ‘বস্তুর ভরের উত্স কী’ প্রশ্নের উত্তর। সেই সঙ্গে মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনের জন্য যে মহামিলনের পথ খুঁজনে বিজ্ঞানীরা, সেই দিকেই বিজ্ঞানীদের এক ধাপ এগিয়ে দেয় কণা ভাঙনের এই যন্ত্র। তাই ভাঙনের বাশিতেই আজ আমরা শুনছি মিলনের গান।