আব্দুল মতিন
ভাষা সৈনিক (১৯২৬- ২০১৪)

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলার ধুবালীয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন এঁদের প্রথম সন্তান। তাঁর ডাক নাম ছিল গেদু। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামের বাড়ী যমুনা নদীর ভাঙনে বিলুপ্ত হয়ে গেলে, আবদুল জলিল জীবিকার সন্ধানে ভারতের দার্জিলিং এ চলে যান। তিনি সেখানকার জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইস স্টাফ হিসেবে একটি চাকরি পান।
 
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল মতিন শিশু শ্রেণিতে দার্জিলিং-এর বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মা এ্যাক্‌লেম্‌শিয়া রোগে মারা যান। মহারানী গার্লস স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাইমারি স্তরের পড়াশোনার শেষ হয়।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দার্জিলিং গভর্মেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। 
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এনট্রেন্স (মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা) পরীক্ষায় ৩য় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। এই বৎসরে তিনি রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেন।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এইচ এস সি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আব্দুল মতিন বৃটিশ আর্মির কমিশন র‌্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষা দেন। দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা, আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাশ কোর্স) এ ভর্তি হলেন। তাঁর আবাসিক হল ছিল ফজলুল হক হল।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বিভাগ থেকে।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে নস্যাৎ করার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল ও  সভা করার উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। এই ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কিনা
এই নিয়ে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড.এস.এম. হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে আলোচনা হয়। উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হকের নেতৃত্বে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি' ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেয়। কিন্তু সর্বদলীয় সমাবেশ থেকে সেখানকার নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন কমরেড আব্দুল মতিন।
২১শে ফেব্রুয়ারি উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। এই সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়।

পঞ্চাশের দশক থেকে আবদুল মতিনকে' ভাষা মতিন' বলে ডাকা শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখক বদর উদ্দিন উমর, বশির আল হেলাল সহ আবুল কাশেম ফজলুল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মুস্তফা নুরুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল , কে জি মুস্তফা তাদের লেখায় 'ভাষা মতিন' ব্যবহার করেন। ভাষাসংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব, মহবুব আনাম , আবদুল গফুর , হাসান ইকবাল ,এম আর আখতার মুকুল , কে জি মুস্তফা , আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ তারাও 'ভাষা মতিন' হিসেবে সম্বোধন করেন। যার কারণে সকলের কাছে তিনি ভাষা মতিন নামে  পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ভাষা আন্দোলনের পর তিনি ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পরে সংগঠনটির সভাপতি হন। এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনতার পক্ষে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হন।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মওলানা ভাসানী'র 'ন্যাপ' নামক রাজনৈতিক দলে যোগ দেন।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল ) গঠন করেন। চীনকে অনুসরণকারী বামপন্থী দলগুলোর নানা বিভাজনের মধ্যেও আবদুল মতিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও আবদুল মতিন পুনর্গঠিত ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গেই রয়েছেন।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই অক্টোবর সকাল ৯টায় ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মৃত্যুর আগেই ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে মরণোত্তর দেহ ও সন্ধানীকে চক্ষু দান করে গেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী গুলবদন নেসা আবদুল মতিনের মরণোত্তর দেহদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে দেহদানের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল, শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর মরণোত্তর দেহটি গ্রহণ করে।

আব্দুল মতিনের রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তালিকা

১. ইউরোপের দেশে দেশে (১৯৬০)
২. কাস্তে (১৯৮৭)
৩. স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি (১৯৮৯)
৪. প্রবাসীর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ (১৯৯১)
৫. শামসুদ্দিন আবুল কালাম ও তার পত্রাবলী (১৯৯৮)
৬. শেখ হাসিনা: একটি রাজনৈতিক আলেখ্য (১৯৯২)
৭. স্মৃতিচারণ পাঁচ অধ্যায় (১৯৯৫)
৮. একটি বিশেষ অধ্যায় (২০১২)
৯. জেনেভায় বঙ্গবন্ধু (১৯৮৪)
১০. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় (১৯৯৩)
১১. খালেদা জিয়ার শাসনকাল: একটি পর্যালোচনা (১৯৯৭)
১২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: মুক্তিযুদ্ধের পর (১৯৯৯)
১৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল (২০০৮)
১৪. বিজয় দিবসের পর: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০০৯)
১৫. রোমের উত্থান ও পতন (১৯৯৫)
১৬, মহানগরী লন্ডন (১৯৯৬)
১৭. ক্লিওপেট্রা (২০০০)
১৮. দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষবৃক্ষ (২০০১)
১৯. ভলতেয়ার: একটি অনন্য জীবনকাহিনী (২০০২)
২০. কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের জনক (২০০৩)
২১. মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য (২০০৫)
২২. ইউরোপের কথা ও কাহিনী (২০০৫, ২০০৭, ২০০৯);

পুরস্কার ও সম্মাননা
একুশে পদক, (২০০১)