আবুল কালাম আজাদ, মৌলানা
(১১ নভেম্বর ১৮৮৮ - ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং স্বাধীন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী।
ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন বিধায় তাঁকে মৌলানা বলা হতো।
মৌলানা আজাদের পূর্বপুরুষেরা আফগানিস্থানের হেরাত থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ১৮৫৭
খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের তাঁর পিতা মৌলানা খইরুদ্দিন মক্কায় চলে যান।
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮৯০
খ্রিষ্টাব্দে মৌলানা খইরুদ্দিন স্বপরিবারে ভারতে চলে আসেন এবং কলকাতায় বসবাস
শুরু করেন।
তরুণ বয়সে তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। অল্প বয়স থেকে
মৌলানা আজাদ উর্দু ভাষায় কবিতা এবং ধর্ম ও দর্শন-সংক্রান্ত নিবন্ধ রচনা করতে শুরু
করেন। পরে তিনি সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্রে ব্রিটিশ ভারতে যে স্বদেশী আন্দোলনের
চেতনা তীব্রভাবে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় তিনি বিপ্লবী সংগঠনের সাথে জড়িয়ে
পড়েন। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ এবং
শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর দ্বারা।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে আজাদ 'আল-হিলাল' নামে একটি উর্দু সাময়িকী প্রকাশ করেন।
এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ শাসনের তীব্র
সমালোচনা করেন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন জানান। এই কারণে, ১৯১৪
খ্রিষ্টাব্দে আল হিলাল নিষিদ্ধ হয়। এরপর তিনি 'আল বালাহ' নামে আরেকটি সাপ্তাহিক
প্রকাশ করা শুরু করেন। ব্রিটিশ বিরোধী বক্তব্য প্রকাশের জন্য, এই পত্রিকাটিও
নিষিদ্ধ করা হয়। এই সময় কলকাতা
থেকে তাকে রাঁচিতে নির্বাসিত করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তার ওপর থেকে
এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজির অহিংস অসহযোগের ধারণায়
অণুপ্রেরিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলন অংশগ্রহণ করেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খিলাফৎ
আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সূত্রে তিনি কারাবন্দী হন। এই বছরের
সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। এই সময় খেলাফত আন্দোলন নিয়ে
কংগ্রেসীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ছিল, এই সভায় তা মিটে যায়। এই বছরের ডিসেম্বর মাসে
নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং অধিবেশনে জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ
করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক
বিশেষ বৈঠকে ৩৫ বৎসর বয়সে তিনি
সভাপতি নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য
সেই সময়ে তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে মৌলানা আজাদ ধারাসন সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এই সময় তিনি দেশের
অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক
ধ্যানধারণা এবং হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা প্রচার করেন।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় যুদ্ধের শুরুর দিকে, ভারতীয় কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের
মধ্যে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের বিষয় ছিল, এই বিশ্বযুদ্ধে কংগ্রেসের
ভূমিকা কি হবে। এই বছরের ৩রা ডিসেম্বর গ্রেট ব্রিটেন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ঘোষণা করে। এই সময় ব্রিটেন কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহকে এই যুদ্ধে ব্রটেনের
পক্ষ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। এই সময় ব্রিটেন যুদ্ধশেষে ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার
অঙ্গীকার করে।
১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে অনুষ্ঠিত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তিনি
কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মৌলানা আজাদ এবং জহরলাল নেহরুর সমর্থন ছাড়াই কংগ্রেসের 'ভারত
ছাড়' আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় গান্ধীজীসহ কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতাকেই
গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
বিশ্বযুদ্ধ শেষে, ব্রিটেন ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
http://www.somewhereinblog.net/blog/amins/29262503
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের
১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভের পরে, ভারতীয় যে পাঁচজন নেতা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন,
তাঁর ভিতরে মৌলানা আজাদ ছিলেন একজন। অন্য চারজন ছিলেন- মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু,
সরদার বল্লভভাই পাটেল ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী পরিষদের প্রথম
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি যোগ দেন।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে খড়গপুরের প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব
টেকনোলজি (আইআইটি) প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নেহরুর সঙ্গে নয়াদিল্লীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশন
প্রণয়ন করেন। এই বছরে তিনি সাহিত্য, নাটক ও সঙ্গীতের উন্নয়নের জন্য সাহিত্য একাডেমি
স্থাপন করেন।
১৯৫৪ সালে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের উন্নয়ন এবং ভারতের মনীষী ও শিল্পীদের
সাহসিকতা ও স্বাধীনতার ভিত মজবুত করার জন্য ললিতকলা একাডেমি স্থাপনে সহযোগিতা করেন।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্নে (মরণোত্তর) ভূষিত করা
হয়।
স্বাধীন ভারতে শিক্ষাবিস্তারে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণে রেখে তাঁর জন্মদিনটি
সারা দেশে "জাতীয় শিক্ষা দিবস" হিসেবে পালন করা হয়।
তাঁর প্রকাশিত গ্রস্থের মধ্যে আছে ‘আল-বায়ান’ (১৯১৫) এবং ‘তারজমান-উল-কোরান’
(১৯৩৩-১৯৬৯)। এছাড়া ‘তাজকিবাহ’ (১৯১৬) নামে তাঁর একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা রয়েছে।
‘গাবর-ই-থাতির’(১৯৪৩) চিঠিপত্রের সংকলন অন্যতম।