আদি শঙ্কর
(৭৮৮-৮২০ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতীয় সনাতন ধর্মাদর্শনে 'অদ্বৈত বেদান্ত' প্রবক্তা ।

আনুমানিক ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মায়ের নাম আর্যাম্বা। কথিত আছে, শঙ্করের বাবা-মা দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন। সন্তান কামনায় তাঁরা ত্রিশূরের বৃষভচল শিবমন্দিরে পুত্রকামনা করে পূজা দেন। এরপর আর্দ্রা নক্ষত্রের বিশেষ তিথিতে শঙ্করের জন্ম হয়। শঙ্কর শৈশবে তাঁর পিতাকে মৃত্যু হয়। এই কারণে শঙ্করের উপনয়নে দেরি হয়। পরে তার মা উপনয়ন করান।

শৈশবে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল স্থানীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি চারটি বেদ আয়ত্ত্ব করতে সক্ষম হন।

এই সমণ সন্ন্যাস গ্রহণের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। কিন্তু তাঁর মা তাঁকে অনুমতি দেননি। কথিত আছে একদিন তিনি পূর্ণা নদীতে স্নান করা সময় একটি কুমির তার পা কামড়ে ধরে। এই সময় শঙ্করের তাঁর মাও সেই সময় পূর্ণার তীরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মা-কে বলেন, মা যদি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেন, তাহলে কুমিরটি তার পা ছেড়ে দেবে। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে মা তাকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিলেন। তার পর থেকে কোনোদিন পূর্ণা নদীতে কোনো কুমিরকে দেখা যায়নি।

এই ঘটনার সত্যাসত্য যাই হোক, তিনি সন্যাস গঋহণের জন্য কেরল ত্যাগ করে গুরুর খোঁজে উত্তর ভারতের দিকে রওনা দেন। চলার পথে নর্মদা নদীর তীরে ওঙ্কারেশ্বরে তিনি গৌড়পাদের শিষ্য গোবিন্দ ভগবদপাদের দেখা পান। গোবিন্দ শঙ্করের কাছে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে, শঙ্কর মুখে মুখে অদ্বৈত বেদান্ত তত্ত্ব বিষয়ক একটি শ্লোক রচনা শোনান। গোবিন্দ এই শ্লোক শুনে খুশি হন এবং তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।

কিছুদিন শিক্ষা গ্রহণের পর, গোবিন্দ শঙ্করকে ব্রহ্মসূত্রের একটি ভাষ্য রচনা করে তা প্রচারের আদেশ করেন। এই সূত্রের কাশীতে আসেন। সেখানে সনন্দন নামে দক্ষিণ ভারতের চোল রাজ্যের এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।  সনন্দন শঙ্করের তত্ত্ব গ্রহণ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ধীরে ধীরে শিষ্য বাড়তে থাকে। কথিত আছে, শঙ্কর তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কাশীতে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করতে যাওয়ার সময় এক চণ্ডালের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সেই চণ্ডালের সঙ্গে চারটি কুকুর ছিল। শঙ্করের শিষ্যরা চণ্ডালকে পথ ছেড়ে দাঁড়াতে বললে, চণ্ডাল উত্তর দেয়, "আপনি কী চান, আমি আমার আত্মকে সরিয়ে ফেলি, না এই রক্তমাংসের শরীরটাকে সরিয়ে ফেলি?" শঙ্কর বুঝতে পারেন যে, এই চণ্ডাল স্বয়ং শিব এবং তার চারটি কুকুর আসলে চার বেদ। শঙ্কর তাকে প্রণাম করে পাঁচটি শ্লোকে বন্দনা করেন। এই পাঁচটি শ্লোক "মণীষা পঞ্চকম্‌" নামে পরিচিত।

এরপর তিনি সারা ভারত পর্যটন করে অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। সেই সাথে তিনি নিজের দার্শনিক মতটি প্রচার করেন। এই ভ্রমণের সময় তিনি বিভিন্ন স্থানে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মঠগুলি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ, পুনর্জাগরণ ও প্রসারের জন্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

শঙ্কর অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন ছাড়াও,  তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের দশনামী সম্প্রদায় ও হিন্দুদের পূজার সন্মত নামক পদ্ধতির প্রবর্ত করেন। তাঁর সময় হিন্দু দর্শনের মীমাংসা শাখাটি অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতার উপর জোর দিত এবং সন্ন্যাসের আদর্শকে উপহাস করত। আদি শঙ্কর উপনিষদ্‌ ও ব্রহ্মসূত্র অবলম্বনে সন্ন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উপনিষদ্‌, ব্রহ্মসূত্র ও ভগবদ্গীতার ভাষ্যও রচনা করেন। এই সব বইতে তিনি হিন্দু দর্শনের সাংখ্য দর্শন বৌদ্ধ দর্শনের মতামতকে খণ্ডন করেন।

শিষ্যদের সাথে নিয়ে মহারাষ্ট্র ও শ্রীশৈলম ভ্রমণ করেন। শ্রীশৈলে তিনি শিবের প্রতি ভক্তিমূলক স্তোত্রগীত শিবানন্দলাহিড়ী রচনা করেন। মাধবীয়া শঙ্করাবিজয়াম অনুসারে যখন শঙ্কর কপালিকা দ্বারা বলি হতে যাচ্ছিলেন, তখন পদ্মপদাচার্যের প্রার্থনার উত্তরস্বররূপ ভগবান নরসিংহ শঙ্করকে রক্ষা করেন। এই সূত্রে তিনি লক্ষ্মী-নরসিংহ স্তোত্র রচনা করেন। এরপর তিনি গোকর্ণ, হরি-শঙ্করের মন্দির এবং কোল্লুড়ে মুকাম্বিকা মন্দির ভ্রমণ করেন। কোল্লুড়ে তিনি এক বাকশক্তিহীন বালককে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। শঙ্কর তার নাম দেন হস্তামলকাচার্য ("বৈঁচি-জাতীয় ফল হাতে কেউ", অর্থাৎ যিনি নিজেকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করেছেন)। পরবর্তীতে তিনি সারদা পীঠ প্রতিষ্ঠা করতে শৃঙ্গেরী ভ্রমণ করেন এবং এখনে তোটকাচার্য তাঁর শিষ্য হন।

তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে নেপাল পৌঁছান। পথিমধ্যে সাধারণ মানুষের মাঝে তিনি তাঁর তত্ত্ব প্রচার করেন এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের সাথে দর্শন বিষয়ে তর্ক করেন।  

মালয়ালী রাজা সুধনভকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে শঙ্কর তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিদর্ভ, কর্ণাটক ভ্রমণ করেন। কর্ণাটকে যাওয়ার পথে তিনি একদল সশস্ত্র কাপালিকের মুখোমুখী হন। এই সময় রাজা সুদনভ তার সঙ্গীদের নিয়ে কাপালিকাদের পরাজিত করেন। এরপর তাঁরা গোকর্ণে পৌঁছানল এখানে এসে  তিনি তর্কযুদ্ধে শৈব পণ্ডিত নীলাকান্তকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি সৌরাষ্ট্রের তথা প্রাচীন কম্বোজে যান। এই সময় তিনি  গিরনার, সোমনাথ ও প্রভাসার সমাধিমন্দিরসমূহ ভ্রমণ করেন এবং এ সকল স্থানে বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্ব ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এই ভ্রমণ শেষ করে তিনি দ্বারকা পৌঁছান। সেখেনে তিনি উজ্জয়িনীর ভেদ-অভেদ দর্শনের প্রস্তাবক ভট্ট ভাস্করকে তর্কে পরাজিত করেন। এর ফলে উজ্জয়িনীর সকল পণ্ডিত আদি শঙ্করের দর্শন গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বাহলিকা নামক এক জায়গায় দার্শনিক বিতর্কে জৈনদের পরাজিত করেন। তারপর তিনি কম্বোজ (উত্তর কাশ্মীরের এলাকা), দারোদা ও মরুভূমিটিতে অবস্থিত বিশিষ্ট দার্শনিক এবং তপস্বীদের তর্কে পরাজিত করেন। এখান থেকে তিনি পার্বত্য পথে কাশ্মীরে প্রবেশ করেন।

এর কাশ্মীরে (বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত কাশ্মীর) সারদা পীঠ ভ্রমণ করেন। কথিত আছে মাধবীয়া শঙ্করাবিজয়ম অনুসারে এ মন্দিরে চারটি প্রধান দিক থেকে পণ্ডিতদের জন্য চারটি দরজা ছিল। দক্ষিণ দরজা (দক্ষিণ ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী) কখনই খোলা হয়নি যা নির্দেশ করত যে দক্ষিণ ভারত থেকে কোনো পণ্ডিত সারদা পীঠে প্রবেশ করেনি। সকল জ্ঞানের শাখা যেমন মীমাংসা, বেদান্ত এবং অন্যান্য হিন্দু দর্শনের শাখাসমূহে সকল পণ্ডিতকে বিতর্কে পরাজিত করে আদি শঙ্কর দক্ষিণ দরজা খোলেন। তিনি সে মন্দিরের সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞানের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

তার জীবনের শেষদিকে তিনি হিমালয়ের এলাকা কেদারনাথ-বদ্রীনাথে যান এবং বিদেহ মুক্তি ("মূর্তরুপ থেকে মুক্তি") লাভ করেন। এখানে বসে তিনি তাঁর বিখ্যাত টীকাভাষ্য ও দর্শনমূলক প্রকরণগুলি রচনা করেন।

কেদারনাথ মন্দিরের পিছনে আদি শঙ্করের প্রতি উৎসর্গীকৃত সমাধি মন্দির রয়েছে। কেরালীয়া শঙ্করাবিজয়াতে ব্যাখ্যাকৃত এক পরম্পরাগত মতবাদ তার মৃত্যুর স্থান হিসেবে কেরালার থ্রিসুরের বদাক্কুন্নাথান মন্দিরকে নির্দেশ করে। কাঞ্চী কামাকোটি পীঠের অণুসারীরা দাবি করেন যে তিনি সারদা পীঠে আরোহণ করেন এবং কাঞ্চীপুরমে (তামিলনাড়ু) মৃত্যুবরণ করেন।  তাঁর মৃত্যুকাল ৮২০ খ্রিষ্টাব্দ হিসেবে মানা হয়।

আদি শঙ্করের রচিত ভাষ্যসমূহ: আদি শঙ্করের রচিত মৌলিকগ্রন্থ

 


সূত্র: