অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
(১৮৬১-১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ)
ইতিহাসবেত্তা ও সমাজকর্মী

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ তারিখে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার গৌরনাইয়ের বরেন্দ্র বর্মণ পরিবারের সন্তান।  নদিয়া জেলার নওয়াপাড়া থানার শিমুলিয়া গ্রামে মায়ের মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতার নাম মথুরানাথ মৈত্রেয়।

পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদারের কাছে। বছর বয়সে তিনি রাজশাহীতে তার বাবার কাছে চলে যান। উল্লেখ্য তাঁর বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয় তখন রাজশাহীতে ওকালতি করতেন। এই সময় ইনি তৎকালীন বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল (বর্তমানে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল)-এ ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এনট্রান্স পাশ করেন এবং ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আবার রাজশাহী কলেজ থেকে বিএল পাশ করেন। একই বছর তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

অক্ষয়কুমার ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে তিনি পণ্ডিত ছিলেন। উভয় সাহিত্য নিয়েই তিনি অনেক সুলিখিত প্রবন্ধ রচনা করেন। তবে অক্ষয়কুমারের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল ইতিহাস। নিজদেশের ইতিহাস রচনার গুরুত্ব তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন এফএ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন সময়ে। সে সময় তিনি মেকলে-র লেখা ক্লাইভ অ্যান্ড হেস্টিংস বইটি পোড়ে বুঝতে পারেন যে, এটি মিথ্যায় পূর্ণ। তিনি ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘকাল ধরে তথ্য সংগ্রহ করেন। এই সূত্রে তিনি বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, রানী ভবানী, সীতারাম, ফিরিঙ্গি বণিক, প্রমুখ ব্যক্তিকে নিয়ে ইতিহাস বিষয়ক প্রথম বাংলা ত্রৈমাসিক পত্রিকা ঐতিহাসিক চিত্র প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি বঙ্গদর্শন, সাহিত্য, প্রবাসী -সহ বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করতেন।

১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে দীঘাপতিয়ার রাজা শরৎকুমার রায়,  বাংলার এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য রাজশাহীতে '‌বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি‌' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় অক্ষয়কুমার তাঁকে সর্বপ্রকার সহায়তা দান করেন। এছাড়া রাজশাহীর সন্নিহিত এলাকায় সফরকালে উদ্ধার করা প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে তাঁরা ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাজশাহী জাদুঘর (বর্তমান বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর) প্রতিষ্ঠা করেন। জাদুঘরটি '‌বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি‌'র ব্যবস্থাপনা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত ছিল। এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন শরৎকুমার রায়, পরিচালক ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং সচিব ছিলেন রমাপ্রসাদ চন্দ। সোসাইটির পরিচালক হিসেবে মৈত্রেয় দীর্ঘ ৩০ বছর এর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক ও বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানী সফরের আয়োজন করতেন ও সেগুলিতে অংশ নিতেন।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গৌড়লেখমালা নামের বইতে তিনি পাল রাজাদের তাম্রশাসন ও শিলালিপি বাংলায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করে প্রাচীন ব্রহ্মদেশের অজানা ইতিহাস তুলে ধরেন এবং এভাবে বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন। তিনি ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বিশিষ্ট সদস্য নির্বাচিত হন।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্য সফরে যান। যেখানে তিনি বহু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ, কাহিনী ও লোককথা সংগ্রহ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে দিঘাপতিয়া রাজ পরিবারের কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও জনৈক স্কুল শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ গবেষণা ও প্রাচীন নিদর্শনাদি সম্বন্ধে অভিন্ন আগ্রহের কারণে মিলিত হন।

অক্ষয়কুমার ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী রেশম-শিল্প বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক ও শিক্ষক। রাজশাহী পৌরসভার কমিশনার হিসেবে কাজ করার সময় তিনি রাজশাহী শহরের নাগরিক সুবিধা সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করেন। ডায়মন্ড জুবিলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের শুরুর দিকে তিনি স্কুলটিকে যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এমনকি স্কুলের অবৈতনিক প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের রেশম চাষ পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন।

বেশ কিছু সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। একজন ভাল ক্রিকেট খেলোয়াড় ও আঁকিয়ে হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

গ্রন্থাবলি :

সম্মাননা


সূত্র :