বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসিক।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর (২৮ ভাদ্র, ১৩০১ বঙ্গাব্দ), বুধবার বেলা সাড়ে
দশটার সময়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকটবর্তী
মুরাতিপুর গ্রামে (মামাবাড়ি) জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোহর
জেলার বনগ্রাম মহকুমার বারাকপুর গ্রামে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগের সময়
বনগ্রাম মহকুমা পুনর্গঠিত হয়ে ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
তাঁর পিতামহ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যৌবনে কবিরাজি করার জন্য ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রাম থেকে বারাকপুরে আসেন এবং বারাকপুরের স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত। পাণ্ডিত্য এবং কথকতার জন্য তিনি শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বিবাহ করেন রাণাঘাটের হেমাঙ্গিনী দেবীকে। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হলে, তিনি নিজ উদ্যোগে স্বামীকে বর্ধমান জেলার খোসবাগ-নিবাসী গুরুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া জ্যেষ্ঠা কন্যা মৃণালিনী দেবীর সাথে বিবাহ দেন।।
পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ ছিলেন সবার বড়। তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেরা ছিলেন— ইন্দুভূষণ (১৮ ভাদ্র ১৩০৪), জাহ্নবী দেবী (৬ চৈত্র ১৩০৫), সরস্বতী দেবী (১১ আশ্বিন ১৩০৮), বটুবিহারী (৮ শ্রাবণ ১৩১২)।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি (৫ ফাল্গুন ১৩১৩ বঙ্গাব্দ), রবিবার পঞ্চমী তিথিতে বারাকপুরে তাঁর উপনয়ন হয়। পিতার কাছে বিভূতিভূষণের পড়ালেখার পাঠ শুরু হয়। কথিত আছে, বিভূতিভূষণের জন্য তাঁর পিতা একটি করে বর্ণপরিচয় কিনে দিতেন এবং দিনশেষ সে বইয়ের কিছু থাকতো না। এই কারণে তাঁর পিতা তাঁর জন্য ১ পয়সা মূল্যের বর্ণপরিচয় এক মাসের জন্য কিনতেন। এর জন্য প্রতিও মাসে সাড়ে সাত আনা খরচ হতো।
এরপর তিনি গ্রামের হরি রায়ের পাঠশালায় ভর্তি হন। এরপর হুগলি জেলার সাগঞ্জ-কেওটায় এবং পিতার কর্মস্থল কলকাতার বৌবাজার আরপুলি লেনের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। একই সময় তিনি পিতার কাছে সংস্কৃত ভাষা শেখা শুরু করেন। এই সময় তিনি মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পাঠ করেন। তাঁর পিতা তাঁর শিক্ষার জন্য অত্যন্ত যত্নবান হলেও সংসারের অভাবের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকাল বেশ কষ্টে কেটেছে। কারণ, তাঁর পিতা ছিলেন ভবঘুরে। সংসারে তিনি খুব কম সময় কাটাতেন। ফলে আর্থিক অনটন তাঁদের সংসারে লেগেই ছিল। একসময় তিনি বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে প্রথম দুই দিন ভয়ে স্কুলে প্রবেশ করতে পারেন নি। তৃতীয় দিনে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নজরে পরেন। তিন বিভূতিভূষণের কাছে সিঁদুর-মাখানো টাকা দেখে, জিজ্ঞাসাবাদ করে সংসারের অনটনের কথা জানতে পারেন। পরে তিনি বিভূতিভূষণকে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করে নেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর পিতা মারা যান।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ভর্তি হন এবং ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায়ও ডিস্টিংশনসহ পাশ করেন। এরপর তিনি কিছুদিন এম.এ এবং ল-ক্লাসে লেখাপড়া করেন। উল্লেখ্য, তিনি তাঁর তৃতীয় বার্ষিক পরীক্ষার সময় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন। কিছুদিন পর এই স্ত্রী কলেরা রোগে মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর শোকে তিনি কিছুদিন প্রায় সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন। এরপর তাঁর লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে। এই সময় তিনি হুগলি জেলার জাঙ্গীপাড়ায় মাইনর স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করেন। কিন্তু সেখানে তিনি অস্থিরতায় কাতর হয়ে, সোনারপুর হরিণাভিতে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে যান। এখানে থাকতেই তিন প্রথম 'উপেক্ষিতা' নামক গল্প রচনা করেন। এবং গল্পের সূত্রে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু হয়। গল্পটি প্রবাসী পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায়(১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই সময় স্ত্রীর শোকে গভীরভাবে পরলোকতত্ত্ব চর্চা শুরু করেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর (১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা রমা দেবীকে (ডাক নাম কল্যাণী) বিবাহ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং এখানকার গোপালনগর স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি পৈতৃক ভিটার কাছে একটি পুরানো বাড়ি কেনেন এবং এই বাড়ি মেরামত করে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর তাঁর দুটি মৃত কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এরপর পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায় (ডাকনাম বাবলু) জন্মগ্রহণ করেন।
সংসার জীবনে তিনি তাঁর পিতার মতোই কিছুটা ভবঘুরে জীবনযাপন করেন। ১৯৪২-৪৩
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, তিনি বন্ধু এবং বিহার সরকারের বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচরী
যোগেন্দ্রনাথ সিন্হার সাথে ছোটনাগপুর বিভাগের সিংভূম, হাজারীবাগ এবং রাঁচী ও
মানভূম জেলার অরণ্য ভ্রমণ করেন। এছাড়া দুই-একবার তিনি সারান্দা বনের নিভৃত অরণ্যে
বাস করেন।
এই মহান কথাসাহিত্যিক ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর (১৫ কার্তিক ১৩৫৭) বুধবার,
রট্রি ৮টা ১৫ মিনিটে বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন।
পুরস্কার :
রবীন্দ্র পুরস্কার - ১৯৫১ (মরণোত্তর), ইছামতী উপন্যাসের জন্য।
রচনাবলি :
উপন্যাস | ||
পথের পাঁচালি (১৯২৯) অপরাজিত (১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯৩২) দৃষ্টিপ্রদীপ (১৯৩৫) আরণ্যক (১৯৩৯) আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০) বিপিনের সংসার (১৯৪১) দুই বাড়ি (১৯৪১) |
অনুবর্তন (১৯৪২) দেবযান (১৯৪৪) কেদার রাজা (১৯৪৫) অথৈজল (১৯৪৭) ইচ্ছামতী (১৯৫০) অশনি সংকেত (অসমাপ্ত, বঙ্গাব্দ ১৩৬৬) দম্পতি (১৯৫২) |
|
গল্প-সংকলন | ||
মেঘমল্লার (১৯৩২) মৌরীফুল (১৯৩২) যাত্রাবাদল (১৯৩৪) জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৮) কিন্নর দল (১৯৩৮) বেণীগির ফুলবাড়ী (১৯৪১) নবাগত (১৯৪৪) তালনবমী (১৯৪৪) আচার্য কৃপালিনী কলোনি (বর্তমান নাম 'নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব', ১৯৪৮) জ্যোতিরিঙ্গন (১৯৪৯) |
কুশল-পাহাড়ী (১৯৫০) রূপ হলুদ (১৯৫৭) অনুসন্ধান (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬) ছায়াছবি (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬) সুলোচনা (১৯৬৩)উপলখণ্ড (১৯৪৫) বিধুমাস্টার (১৯৪৫) ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫) অসাধারণ (১৯৪৬) মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭) |
|
কিশোরপাঠ্য | ||
চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮) আইভ্যানহো (সংক্ষেপানুবাদ, ১৯৩৮) মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০) |
মিসমিদের কবচ (১৯৪২) হীরা মাণিক জ্বলে (১৯৪৬) সুন্দরবনের সাত বৎসর (ভুবনমোহন রায়ের সহযোগিতায়, ১৯৫২) |
|
ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি | ||
অভিযাত্রিক (১৯৪০) স্মৃতির রেখা (১৯৪১) তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩) ঊর্মিমুখর (১৯৪৪) |
বনে পাহাড়ে (১৯৪৫) উৎকর্ণ (১৯৪৬) হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮) |
|
অন্যান্য | ||
বিচিত্র জগৎ (১৯৩৭) টমাস বাটার আত্মজীবনী (১৯৪৩) আমার লেখা (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮) |
প্রবন্ধাবলী পত্রাবলী দিনের পরে দিন |
তথ্যসূত্র :
বিভূতি রচনাবলী। প্রথম খণ্ড। মিত্র ও ঘোষ পাব্লিশার্স। ১লা বৈশাখ, ১৩৯৪।