বিজয় সরকার
বিজয়কৃষ্ণ ছিলেন পিতামাতার পাঁচপুত্র ও পাঁচ কন্যার মধ্যে দশম এবং শেষ সন্তান। অধিক সন্তানের মাতা হওয়ার কারণে হিমালয় দেবী, সর্বকনিষ্ঠ পুত্র বিজয়ের যত্ন নিতে পারতেন না। তাই শৈশবে তিনি বড় দিদি সোহাগীর যত্নে বড় হয়ে উঠেন।
বিজয়ের জ্যাঠাতুত দাদা অভয়চন্দ্র বৈরাগীর প্রচেষ্টায় লেখাপড়ায় উৎসাহী হয়ে উঠেন। মূলত এই দাদার কাছেই তাঁর লেখাপড়ায় হাতে খড়ি। এরপর নবকৃষ্ণ বিজয়কে স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। এই সময় তিনি তাঁর শিক্ষক নেপাল বিশ্বাসের সংস্পর্শে আসেন। স্থানীয় লোকের কাছে এই শিক্ষক নেপাল পণ্ডিত নামে পরিচিত ছিলেন। উল্লেখ্য নেপাল পণ্ডিত সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। এই সূত্রে বিজয়ের সঙ্গীতের হাতে খড়িও হয়েছিল এই নেপাল পণ্ডিতের কাছে। নেপাল পণ্ডিত বিজয়সহ তাঁর চার জন ছাত্রকে যাত্রাগানের তালিম দিয়েছিলেন। এঁদের ভিতরে অপর তিন ছিলেন উপেন বিশ্বাস, উপেন মজুমদার এবং পুলিন বিশ্বাস। কিশোর বিজয় 'অনন্ত মাহাত্ম্য' যাত্রায় চিত্রাঙ্গদ-এর কিশোর পুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
স্থানীয় পাঠশালার পাঠ শেষ করার পর, তাঁর মেজ দাদা হৃদয়নাথের ইচ্ছায় তিনি হোগলাভাঙ্গা ইউ.পি স্কুলে ভর্তি হন। এই সময় নড়াইলের জমিদার মনীন্দ্রনাথ রায় নেপাল পণ্ডিতকে দিয়ে একটি যাত্রাদল তৈরি করেন। এই দলে বিজয়-সহ অপর তিন কিশোর স্থান পেয়েছিল। এই দলের সাথে থেকে তিনি 'হরিশ্চন্দ্র', 'সুরথ উদ্ধার,' রাম বনবাস,' সীতা হরণ' নাটকে অভিনয় করেন। তবে এসব যাত্রায় তিনি বিবেকের গান গেয়ে বিশেষ সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন।
হোগলাভাঙ্গা ইউপি স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হন বাঁশগ্রাম এম.ই স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভুবনমোহন ঘোষ, বিজয়ের সঙ্গীত চর্চার বিশেষ সুযোগ দিয়েছিলেন। এই স্কুলে তিনি কিছুদিন লেখাপড়া করার পর তিনি সংগাশোলপুরের কে.পি. ইনস্টিটিউটশনে ভর্তি হন। এই সময় এই স্কুলের হেড মাস্টার বিজয় বাবু, শিক্ষক অরুণেশ্বর রায় এবং হেড পণ্ডিত কিরণচন্দ্র বিজয় সরকারকে কবিতা ও গান রচনায় উৎসাহিত করেন।
কিশোর
বয়সে তিনি পুলিনবিহারী, পঞ্চানন মজুমদার প্রমুখ স্থানীয় কবিয়ালদের সাথে পাঁচালি
গানের পাল্লা দিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। এই সময় নন্দকোল গ্রামের গিরিশচন্দ্র সরকার
বিজয়ের গানে মুগ্ধ হয়ে গানের জগতে আনার চেষ্টা করেন।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন।
এর কিছুদিন পর, বিজয় তাঁর পিতাকে হারান। এই অবস্থায় সংসারের
অভাব মোচনের জন্য তিনি ট্যাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর
জানকীনাথের চেষ্টায় তিনি গোপালপুর কাচারির নায়েবের চাকরি পান। সে সময় একবার
হোগলাডাঙাতে ফরিদপুরের মনোহর সরকার ও খুলনার রাজেন সরকারের মধ্যে কবিগানের পাল্লা
হয়। এই আসরে বিজয় সরকার মনোহর সরকারে গান শুনে মুগ্ধ হন। পাল্লা শেষে বিজয় একতারা
বাজিয়ে মনোহর সরকারকে একটি গান শোনান। গানটি হলো-
আমি
গুরু বৈমুখ হইয়া রইলাম ভাই
এ-মুখ কেউ দেখ না,
আমার এ মুখ দেখলে
পরে
তার দুঃখ আর যাবে না।
বিজয়ের গান শুনে মনোহর সরকার তাঁকে কবি গান শেখাতে রাজি হন। ১৯২৬
খ্রিষ্টাব্দে তিনি
ফরিদপুরের দুর্গাপুর গ্রামের মনোহর সরকারের বাড়িতে কবিগান শিখতে যান। প্রায় দুই বছর
এখানে থেকে তিনি কবি গান শেখেন। তারপর তিনি রাজেন সরকারের কাছে কবি গান শেখেন। এরপর
গুরুদের অনুমতি নিয়ে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ১২ই অগ্রহায়ণ (১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি নতুন
কবি গানের দল করেন। তিনি তাঁর দল নিয়ে প্রথম ভেন্নাবড়ি গ্রামের কবিয়াল মহিম
সরকারের সাথে পাল্লা দেন। এরপর একের পর এক কবি গানের পাল্লা দিয়ে সুখ্যাতি অর্জন
করেন। তাঁর সুমধুর
ব্যাবহারের কারণে পুরানো দলের যন্ত্রী, দোহারের দল তাঁর দলে যোগ দেন। ফলে তিনি
বহু কবিয়ালের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় কবিয়ালরা রাজেন সরকারের বাড়িতে
বসে বিজয়কে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য, এই বয়কটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজেন সরকার। পরে অবশ্য এই গোলামাল মিটে গেলেও তাঁর সাথে কবিগানের পাল্লা দিতে
অনেক কবিয়াল রাজি
হন নি। এই অবস্থায় তিনি ফরিদপুরের ঘোষালকান্দি গ্রামের সঙ্গীতানুরাগী শ্যামলাল
রায়ের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শ্যামলাল নিজে উদ্যোগী হয়ে বরিশালের বিখ্যাত কবিয়াল
নকুল সরকারের সাথে বিজয়ের কবিগানের জোট তৈরি করে দেন। এই কবিয়ালের সাথে তিনি প্রায়
আড়াই বছর কবিগান গেয়েছিলেন।
১৩৪২ বঙ্গাব্দে (১৯৩৫-৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি বরিশাল জেলার বড়মগরা গ্রামের শশিভূষণ
পাণ্ডের কন্যা বীণাপাণিকে বিবাহ করেন। উল্লেখ্য বিবাহটি হয়েছিল শ্যামলাল রায়ের
উদ্যোগে। এই স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন কানন বালা (বুলবুলি) এবং মঞ্জুরাণী।
উল্লেখ্য, মঞ্জুরাণীর শৈশবেই মৃত্যু হয়েছিল। বিজয়ের শ্যালক অক্ষয়কুমার পাণ্ডের
যক্ষ্মা রোগ হলে, মঞ্জুরাণী তাঁর ভাইয়ের সেবার জন্য বরিশাল যান। এর ফলে মঞ্জুরাণীও
যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। পরে এই রোগে বীণাপাণি আক্রান্ত হলে, ডুমিদীতে ফিরে আসেন।
১৩৫২ বঙ্গাব্দের ২৪শে শ্রাবণ (১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) বৃহস্পতিবার বীণাপাণি মৃত্যুবরণ করেন।
১৩৫৩ বঙ্গাব্দে (১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ) বিজয়
ফরিদপুর জেলার সাতপাড় গ্রামের রমেশচন্দ্র বিশ্বাসের কন্যা প্রমদা বিশ্বাসকে বিবাহ
করেন। প্রমদার গর্ভে বিজয় দুটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। এঁরা হলেন কাজল অধিকারী ও
বাদল অধিকারী।
বিজয় কবি গানের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি বাংলাদেশে জমিজমা ক্রয় করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজন হলে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে জমি ক্রয় করেন।
শেষ জীবনে তিনি অন্ধ হয়ে যান। কলকাতার পিজি হাসপাতাল এবং ভারতের কয়েকটি চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা করান। কিন্তু সুফল পান নি। ক্রমে ক্রমে তাঁর দৈহিক অবস্থার অবনতি হলে, তিনি ভারতের কেউটিয়ায় তাঁর নিজ বাড়ি থেকে, তাঁর কন্যা কানন বিশ্বাসের বেলুড়ের বিধান পল্লীর বাসায় চলে আসেন। এই বাড়িতে ১৩৯২ বঙ্গাব্দের ১৮ই অগ্রহায়ণ (৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) বুধবার দিবাগত রাত ১০টা ৫৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।
বিজয় সরকারে ধর্মমত
১৯২৬
খ্রিষ্টাব্দে বিজয় সরকার ফরিদপুরের দুর্গাপুর গ্রামের মনোহর
সরকারের বাড়িতে কবিগান শিখতে যান। এই সময় তাঁর গুরুর সাথে তিনি ওড়াকান্দি গ্রামে
গিয়ে 'মতুয়া' ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেন। এরপর তিনি ফরিদপুরের 'কাঁথার ফকির-এর কাছে
দীক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি এক সময় 'খেজুর তলার মত-এ
বিশ্বাস স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি পাবনার হেমায়েতপুরের অনুকুল ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ
করেন। সবশেষে তিনি ভুবনগাঙ্গুলী মহাশয়ের কাছে সত্য ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য ধর্মের আচারানুষ্ঠানে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস
স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি নড়াইলের কালিয়া থানার পেড়লি গ্রামের পীর সাহেব কেবলার উপর
গভীর আস্থা রেখে ইসলামী মতে গোপন জিকিরে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি মূর্তি পূজায়
বিশ্বাসী ছিলেন না। তবে বৈষ্ণবধর্মে আস্থা ছিল তাঁর আমৃত্যু। তবে মূর্তির পরিবর্তে
তিনি কৃষ্ণকে মনে স্থান দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ছিলেন সর্বধর্মে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন
এবং সত্যিকারে অসম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই
সূত্রে বহু মানুষ তাঁকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
এখন পর্যন্ত বিজয় সরকারের প্রায় ৪ শতাধিক গান পাওয়া গেছে। অনেকে মনে করেন তাঁর গানের সংখ্যা অনেক। বিজয় সরকারে গান এবং তাঁর আধ্যাত্মিক দর্শনের উপর গবেষণার জন্য নড়াইলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজয় সরকার ফাউণ্ডেশান।
সূত্র :
কবিয়াল বিজয়
সরকারের জীবন ও সঙ্গীত। মহসিন হোসাইন। বাঙলা একাডেমী ঢাকা। আষাঢ় ১৪০১, জুন
১৯৯৪।