ক্রিস্টোফার কলম্বাস
Christopher Colombus
১৪৫১-১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দ
ইতালীয় নাবিক এবং স্পেনের নৌআভিযাত্রী। তার পুরো নাম ছিল ল্যাটিন ভাষায়--
ক্রিস্টোফোরাস কলোম্বাস। আর জেনোয়ার স্থানীয় ভাষায় তার নাম ছিল ক্রিস্টোফ্ফা
করোম্বো।
আনুমানিক ১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর মে, ইতালির জেনোয়াতে জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁর বাবা ডোমেনিকো কলম্বো ছিলেন মধ্যবিত্ত উল ব্যবসায়ী। মায়ের নাম ছিল সুজানা ফনটানারোজা।
পিতার বাণিজ্যের সেই সূত্রে কলম্বাস জানতে পেরেছিলেন- প্রাচ্যের উৎকৃষ্ট পোশাক,
নানা ধরনের মসলা ও বিপুল ধনসম্পদের কথা। তাই তিনি শৈশব থেকেই ভারতবর্ষে আসার
স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এর ভিতরে দশ বছর
বয়সে তিনি প্রথম সমুদ্রযাত্রায় যান তার ভাইয়ের সঙ্গে। ১৪৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে
চাকরি নেন। এই প্রতিষ্ঠানের কাজে বিভিন্ন সময় সমুদ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।
কলম্বাসের ভাই তখন
লিসবন শহরে বাস করত। তাঁর ভাইয়ের
আহ্বাবানে, ১৪৭৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি পর্তুগালের লিসবনে চলে যান। এখানে
ভাইয়ের সহায়তায় তিনি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে যান। এই সময় স্থানীয় গির্জায় তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল
ফেলিপা মোয়িস দ্য পেরেস্ত্রল্লো নামে এক তরুণীর। উল্লেখ্য, ফেলিপার বাবা
বার্তলোমিউ ছিলেন সম্রাট হেনরির নৌবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ অফিসার।
কিছুদিনের ভিতরে ফেলিপা'র সাথে তাঁর প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত বিবাহ
হয়। বিবাহের পর কলম্বাস শ্বশুরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। শ্বশুরের কাছে তাঁর প্রথম
যৌবনের সমুদ্র অভিযানের সব কাহিনি শুনে, নৌ অভিযানে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন।
অবসর সময়ে তিনি দেশ-বিদেশের নানা ভ্রমণ কাহিনি পাঠ করা শুরু করেন। দেশ ভ্রমণের
ইচ্ছা নিয়ে প্রথম তিনি সে যুগের বিখ্যাত ভূগোলবিদ পাগোলো টোস্ক্যানেল্লি
(Pagolo Toscanelli) কে একটি চিঠি লেখেন।
পাগোলো এই চিঠি পড়ে, তাঁকে সমুদ্র ভ্রমণে উৎসাহিত করেন এবং তাঁর তৈরি করা একটি
সমুদ্রপথের একটা নকশা পাঠান। তিনি এই সাথে আরও জানান যে, এই নকশা নির্ভুল নয়,
কিন্তু সমুদ্র পথে প্রাচ্যে যেতে এই নকশা বেশ সহায়ক হবে।
এরপর তিনি গোপনে সমুদ্রযাত্রা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পরে এটা জানাজানি হয়ে গেলে,
সকলে এটাকে অবাস্তব পরিকল্পনা হিসেবে উপহাস করা শুরু করেন। প্রথমে তিনি
পর্তুগালে সরকারি কর্মকর্তাদের তাঁর অভিযানের কথা বললে, তাঁরাও তাঁকে প্রত্যাখ্যান
করেন।
এই সময় তাঁর স্ত্রী ফেলিপা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যথাসাধ্য চিকিৎসার পরও ফেলিপা
মৃত্যুবরণ করেন। সংসারের বন্ধন কেটে যাওয়ার পর, তিনি পুনরায় আর্থিক সাহায্য চেয়ে
পর্তুগালের ভাইসরয়কে জানালেন। কলম্বাসের পরিকল্পনা শুনে অলাভজনক বিবেচনা ভাইসরয় এই
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
এই সময় কলম্বাসের সাথে পরিচয় ঘটে ফাদার পিরেজের। ফাদার পিরেজ ছিলেন স্পেনের
রাজপরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং রানি ইসাবেলা তাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। কলম্বাসের
ইচ্ছার কথা ফাদার রানি ইসাবেলাকে জানান এবং কলম্বাসকে সাহায্য করার কথা উত্থাপন
করেন। ফাদারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না ইসাবেলা। ফাদার পিরেজ, রানি
ইসাবেলা এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তবর্গের অনুরোধে সম্রাট কলম্বাসের অনুরোধ
গ্রহণ করেন। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল, সম্রাট এবং কলম্বাসের মধ্যে চুক্তি হয়।
এই চুক্তিতে বলা হয়- কলম্বাসকে নতুন দেশের শাসনভার দেয়া হবে এবং অর্জিত সম্পদের
এক-দশমাংশ অর্থ তাঁকে দেয়া হবে।
সম্রাটের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার পর, কলম্বাস তিনটি জাহাজ তৈরি করেন।
সবচেয়ে বড় জাহাজ সান্তামারিয়া ছিল ১০০ টনের। অপর দুটি জাহাজ ছিল পিন্টা ৫০ টন, নিনা
৪০ টন। এরপর মোট ৮৭ জন নাবিক নিয়ে, ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা আগস্ট কলম্বাস
অজানা সমুদ্রের পথে যাত্রা করলেন।
দীর্ঘদিন চলার পরও তিনি কোনো ডাঙার সন্ধান পেলেন না। ফলে নাবিকরা একসাথে বিদ্রোহ
করে, জাহাজ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কলম্বাস নাবিকদের শেষ
পর্যন্ত সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন। ১২ই অক্টোবর রোডারিপো নামক একজন নাবিক স্থলের
চিহ্ন দেখতে পান। ১৩ই অক্টোবর কলম্বাস বাহমা দ্বীপপুঞ্জের একটি অজানা দ্বীপে পৌঁছান।
পরবর্তীকালে তিনি সেই দ্বীপের নাম রেখেছিলেন সান সালভাদর। বর্তমান নাম ওয়েস্টলিং
আইল্যান্ড। এই দিনটি আজও উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় কলম্বাস দিবস হিসেবে উদযাপন করা
হয়।
কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি এশিয়ার কোনো নতুন অংশে এসে পৌঁছেছেন। যেখানে তিনি তন্ন তন্ন
করে খুঁজেও কোনো ধনসম্পদ পেলেন না। এরপর কলম্বাস কিউবা এবং অন্যান্য দ্বীপে যান।
এরপর সিদ্ধান্ত নেন যে, এখানে সাময়িক আস্তানা স্থাপন করে স্পেনে ফিরে যাবেন। এরপর
আরো বহু লোক এনে ধনরত্বের অনুসন্ধান করবেন। তিনি একটি দ্বীপকে হিস্পানিওয়ালা নাম
দেন এবং এই
দ্বীপে ৪২ জন নাবিকের থাকার ব্যবস্থা করে, স্পেনে ফিরে যান। নতুন দ্বীপে পৌঁছাবার
প্রমাণস্বরূপ তিনি কিছু স্থানীয় আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। কলম্বাস এদেরকে ইন্ডিয়ান
নামে অভিহিত করেছিলেন। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল, এই আদিবাসীরা ছিলেন পূর্বভারতীয়
দ্বীপপুঞ্জের মানুষ।
শূন্য হাতে ফিরে এলেও দেশে অভূতপূর্ব সম্মান পেলেন কলম্বাস। তার সম্মানে রাজা-রানি
বিরাট ভোজের আয়োজন করলেন। স্বয়ং পোপ কলম্বাসকে আশীর্বাদ জানিয়ে ঘোষণা করলেন, নতুন
আবিষ্কৃত সমস্ত দেশ স্পেনের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এরপর সম্রাট ফার্দিনান্দ নতুন অভিযানের জন্য বিশাল আয়োজন করলেন। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দের
২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি দ্বিতীয় সমুদ্র অভিযানে যাত্রা করলেন। হিস্পানিওয়ালা গিয়ে
দেখলেন তাঁর রেখে যাওয়া নাবিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে
সংঘাতে মারা পড়েছে। এই
দ্বিতীয় অভিযানের সময় কলম্বাস চারদিকে ব্যাপক অনুসন্ধান করেও কোনো ধনসম্পদের
সামান্য মাত্র চিহ্ন খুঁজে পেলেন না। শুধু নতুন কিছু দ্বীপ আবিষ্কার করলেন।
কোনো অর্থ সম্পদ না পেয়ে জাহাজ ভর্তি করে স্থানীয় আদিবাসীদের দাস হিসেবে বন্দি করে
স্পেনে পাঠালেন। উল্লেখ্য, এই সময় ইউরোপের দাস ব্যবসায় বেশ লাভজনক ছিল।
কিন্তু কলম্বাসের এই কাজকে অনেকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করতে পারল না। কারণ আদিবাসীদের
বিরাট অংশই নতুন পরিবেশে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যে মারা গিয়েছিল।
এই সংবাদ পেয়ে ১৪৯৬
খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জুন কলম্বাস স্পেন ফিরে আসেন। এবারে তিনি কোনো সংবর্ধনা পেলেন না।
তারপরেও কলম্বাস নতুন অভিযানের জন্য আবেদন জানালেন। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও শেষ
পর্যন্ত সম্মতি দিলেন সম্রাট।
১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে মে, তৃতীয়বারের মতো তিনি অভিযানে বের হলেন। এবারে তার
সঙ্গী হিসেবে ছিলে, হলো তাঁর পুত্র এবং ভাই। এবারে তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন যে,
ভারত নয়- অন্য কোনো নতুন দেশে এসে পৌঁছেছেন। তবে তিনি এই ধারণাও পোষণ করেছিলেন যে,
এই দ্বীপাঞ্চলটি এশিয়া থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
হিস্পানিওয়ালার আদিবাসীরা স্পেনীয় নাবিকদের সাথে ক্রমে ক্রমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
কলম্বাস আদিবাসীদের কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। তিনি শত শত আদিবাসী মানুষকে
নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন। এই অবস্থায় কলম্বাসের সহযোগীরাও তাঁর কাজে ক্ষুব্ধ হয়ে
উঠেছিল। তাঁরা স্পেনের সম্রাটের কাছে কলম্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। একই সাথে কলম্বাস
স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন একথাও জানান। রাজা ফ্রান্সিসকো দ্যা বোবদিলা
নামে একজন রাজকর্মচারীকে সৈন্যসামান্ত দিয়ে পাঠালেন কলম্বাসের বিরুদ্ধে তদন্ত করার
জন্য। ব্যাপক অনুসন্ধান করার পরও রাজ্য স্থাপনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেল না। এরপর
তদন্তকারী দল কলম্বাসের বিরুদ্ধে নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ আনেন। কারণ কলম্বাস কোনো
সম্পদশালী দেশ আবিষ্কার করার পরিবর্তে সম্পদহীন দেশ আবিষ্কার করেছেন এবং এর ফলে
সম্রাটের বিরাট পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে। এই অভিযোগে কলম্বাসের ভাই ও পুত্রকে
বন্দী করা হয়। এরপর কলম্বাসকে শৃঙ্খলিত করে নিয়ে আসা হয় স্পেনে এবং একটি নির্জন
কারাগারে রাখা হয়। এই কারাগার থেকে কলম্বাস রানি ইসাবেলাকে চিঠি লিখে তাঁর
দুরবস্থার কথা জানান।
তাঁর চিঠি পড়ে রানি ক্ষমা করা আদেশ দিলেন। এরপরও তিনি চতুর্থ বারের জন্য
সমুদ্রযাত্রার আবেদন করলেন সম্রাটের কাছে। সম্রাট শেষবারের মতো সম্মতি দিলেন। তবে শর্ত দিলেন যে, কলম্বাস
হিস্পানিওয়ালাতে প্রবেশে করতে পারবেন না।
১৫০২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে মে কলম্বাস তার চতুর্থ সমুদ্রযাত্রা শুরু করলেন। তাঁর
ইচ্ছা ছিল আরো পশ্চিমে যাবেন। পথে তুমুল ঝড় উঠল। নিরুপায় কলম্বাস আশ্রয় নিলেন এক
অজানা দ্বীপে। এবারে কলম্বাস পৌঁছেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপে। সেখান থেকে
তিনি যান জ্যামাইকা দ্বীপে। এই সময় তাঁর দেহ ভেঙে পড়েছিল। অজানা রোগে তাঁর সঙ্গীদের
অনেকেই মারা গিয়েছিলেন। ফলে, ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্পেনে ফিরে আসেন।
১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে মে ভ্যাসাডোলিড শহরে এক সাধারণ কুটিরে সকলের অগোচরে শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কলম্বাস। পরে সেখান থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে ডেমিঙ্গোতে
সমাধি দেয়া হয়