কনফুসিয়াস
প্রাচীন চীনের দার্শনিক। প্রকৃত নাম খুন ছিউ। পারিবারিক উপাধি খুন কনফুসিয়াস হলো তাঁর সম্মানসূচক নাম। বর্তমানে তিনি এই সম্মানসূচক নামেই সর্বাধিক পরিচিত।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫১ অব্দে  কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন বছর, তখন তার বাবা মারা যান। তাঁর শৈশব কেটেছে বর্তমান চীনের সাংতুং প্রদেশে। মায়ের তত্ত্বাবধানেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। প্রাচীন চীনে পড়াশুনার সুযোগ পেতো শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা। স্বশিক্ষিত কনফুসিয়াস এই প্রথা ভেঙে দেন।

তিনি সমাজের সকল শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে ি িলেন। এক্ষেত্রে যে কোনো লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প কিছু খাবার বা অন্য দ্রব্য জমা দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে পারতেন। কনফুসিয়াস নিজের ছাত্রদের ভিতরে ি রাজনৈতিক মতবাদ ও নৈতিক চিন্তাধারা প্রচার করেন। িি এত গভ ি িা দান করতেন যে, তিনি প্রায় তিন হাজার উল্লেখযোগ্য জ্ঞানী ব্যক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় চীনের একীভূত রাজ্যগুলো ভেঙ্গে অনেক ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এই ভাঙনের ফলে তিনি তখনকার লু রাজ্যের নাগরিক ছিলেন সেই আমলে লু রাজ্যের সংস্কৃতি সবচেয়ে সমৃদ্ধতর ছিল কনফুসিয়াস লু রাজ্যের সে ঐতিহ্যকে একটি উচ্চতর স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

সাধারণ মানুষ ছাড়া তৎকালীন রাজ পরিবারগুলোও তাঁকে সম্মান করতো। কারণ তাঁর চিন্তাভাবনা সাধারণ মানুষকে রাজদ্রোহী আচরণকে সংযমিত করতে সহায়তা করতো। কনফুসিয়াস মনে করতেন, নিচু স্তরের কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মান্য করবে, যেমনটা পুত্র তার পিতার কথা মান্য করে। আর এটা না করাটা হবে গুরুতর অপরাধ। তাঁর মতে, রাজাকে ভালো করে দেশ শাসন করতে হবে এবং সাধারণ অধিবাসীরাও রাজাকে মান্য করবে। বিভিন্ন অবস্থায় সামাজিক শ্রেণী ও পারিবারিক অবস্থান অনুসারে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এইভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার প্রজাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালনের রীতিকে ঠিক মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর সময় চীন যখন একটি একত্রীভূত হয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত হলোতখন শাসকরা কনফুসিয়াসের মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে অনুকুল বলে গ্রহণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তাধারাকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭৯ (মতান্তরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭৮) অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন

কনফুসি্য়াস মন্দির
তাঁর মৃত্যর প্রায় দুই বছর পর
লু রাজ্যের রাজা কনফুসিয়াসের বসতবাড়ীটিকে ি মন্দিরে পরিণত করেন। এর ভিতরে কনফুসিয়াসের কাপড়-চোপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা হয়। স্থানীয় লোকের কনফুসিয়াসকে দেবতা জ্ঞানে পূজা শুরু করে। ফলে কালক্রমে এই বাড়িটা কনফুসিয়াস মন্দিরে পরিণত হয়। এবং প্রতি বছর দূর দূরান্ত থেকে এই মন্দিরে বহু লোক কনফুসিয়াসকে পূজা করার জন্য আসতেন।

ছিন রাজবংশের রাজা রনসেন কর্তৃক নির্মিত মন্দির

প্রথম দিকে এই মন্দিরটিতে মাত্র তিনটি ঘর ছিল। পরে কনফুসিয়াসের প্রতিষ্ঠিত লু দলের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে পরিণত হলে, বিভিন্ন আমলের রাজারা এই মন্দিরকে সম্প্রসারিত করেন। যার ফলে কনফুসিয়াসের ভবন একটি বিরাটাকারের স্থাপত্যের সংগ্রহশালায় পরিণত হয়। আঠার শো শতাব্দীর প্রথম দিকে ছিন রাজবংশের রাজা রনসেন কনফুসিয়াসের ভবনে বড় ধরনের সংস্কার করেন ে এটি একটি নান্দনিক রূপ পায়।

ন এই ভবনের -দক্ষিণ বরাবর দৈর্ঘ্য প্রায় এক হাজারাধিক মিটার। আয়তন প্রায় এক লক্ষ বর্গমিটার। ভবনটিতে রয়েছে প্রায় ৫০০টি ঘর

চীনের সামন্ত সমাজের সবোর্চ্চ স্থাপত্যের শৈলী অর্থাৎ রাজকীয় প্রাসাদের স্থাপত্যের শৈলী অনুসরণ করে কনফুসিয়াসের মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিলএই মন্দিরের ভিতরে নয়টি পূজার ঘর, আর নয়টি উদ্যান আছে। প্রধান পূজার ঘরের ভিতরে আবার নয়টি ছোট ঘর আছে। নয় নম্বর ঘরটি হলো একক অঙ্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অঙ্কএই কারণে চীনের সামন্ত সমাজে নয় অঙ্ককে রাজার অঙ্ক বলা হতোভুল বা ইচ্ছা করে াধারণ মানুষদের কেউ যদি নয় অঙ্ক ব্যবহার করতো, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো তবে কনফুসিয়াসের মন্দিরের ব্যতিক্রম ছিল। কনফুসিয়াসের মন্দিরের প্রধান পূজার কক্ষের সামনে পাঁচটি দরজা নিমির্ত হয়। সামন্ত সমাজের নিয়ম অনুযায়ী, কেবল রাজকীয় প্রাসাদের স্থাপত্যে পাঁচটি দরজা নি করা যেতো

কনফুসিয়াসের মন্দিরের কেন্দ্র স্থাপত্য ডাজেন হলের উচ্চতা ৩০ মিটার
পূর্ব-পশ্চিম বরাবর প্রস্থ প্রায়ঞ্চা মিটার। ভবনের ছাদ চকচকে সোনালি টালি ব্যবহার করা হয়েছে। দেখতে পেইচিংএর রাজকীয় প্রাসাদের তেইহো ভবনের মত মনে হয় এই ভবনটিকে চীনের তিনটি বড় প্রাচীন প্রাসাদগুলোর মধ্য অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। ডাজেন হলের্ সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়লো- হলের সামনের দশটি ড্রাগন-বেষ্টিত ি পাথরের স্তম্ভ। এ স্তম্ভটির উচ্চতা ৬ মিটার। প্রায় এক মিটার ব্যাস পাথর দিয়ে এই স্তম্ভ তৈরি এবং সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম খোদাই করা হয়েছে


এই মন্দিরে প্রায় দু’হাজার চীনের বিভিন্ন রাজবংশ আমলের পাথর ফলক রয়েছে যাদের মধ্যে ৫০টিরও বেশি পাথর ফলকে রাজার অভিলেখন থাকে। এ থেকে বুঝা যায়, চীনের সামন্ত সমাজে কনফুসিয়াসের মযার্দা খুব বেশী।


কনফুসি্য়াস

কনফুসিয়াসের মন্দিরের কাছেই রয়েছে কনফুসিয়াস প্রাসাদ। সন আর সোং আর কিন রাজবংশ আমলে (খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ –ত্রয়োদশ শতাব্দী) নিমির্ত হয়। এটা হল চীনের সামন্তকালের অভিজাত শ্রেণির বসতবাড়ির মতো করে নির্মাণ করা হয়েছিল। এর আয়তন প্রায় ৫০হাজার বর্গমিটার। এই প্রাসাদে বিভিন্ন ধরনের ঘর প্রায় ৫শো কক্ষ আছে। প্রাসাদের সামনের অংশ অফিসের কাজে ব্যবহৃত হয়। আর পিছনের অংশ রয়েছে বসবাসের উপযোগী ঘর। প্রধান হলের স্থাপত্যে মিন আর ছিন রাজবংশ আমলের শৈলী দেখা যায়। এই প্রাসাদে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলপত্র, বিভিন্ন আমলের কাপড়চোপড় , আসবাবপত্র ইত্যাদি। এখানে কনফুসিয়াসের বংশধররা বসবাস করেন।

কনফুসি্য়াস সমাধিস্থান
এর পাশেই রয়েছে কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান। এখানে কনফুসিয়াস এবং তাঁর বংশধরদের সমাধি রয়েছে। বতর্মানে এটা হল পৃথিবীতে সবচেয়ে সুদীর্ঘকাল আর সবচেয়ে ব্ড় আকারের পরিবারিক সমাধিস্থান। প্রায় ২৫০০ বছর ধরে এই সমাধিস্থান ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রায় দুই বগর্কিলোমিটার জায়গায় মোট এক লক্ষটি কনফুসিয়াসের বংশধরের সমাধি আছে।

কনফুসিয়াসের মন্দির, কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান এবং কনফুসিয়াসের প্রাসাদ জুড়ে রয়েছে ১৭ হাজারেরও বেশি প্রাচীন গাছ। ১৯৯৪ সালে 'কনফুসিয়াসের মন্দির, কনফুসিয়াসের সমাধিস্থান আর কনফুসিয়াসের প্রাসাদ ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতি উত্তরাধিকার তালিকাভূক্ত করা হয়।   

সূত্র :
http://bengali.cri.cn/chinaabc/chapter17/chapter170204.htm