হাসন রাজা, দেওয়ান
অন্যান্য নাম : হাসুন রাজা, হাসান রাজা।
বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী।

১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ, ১২৬১ বঙ্গাব্দ), দেওয়ান হাসন রাজা, তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন অত্র এলাকার প্রতাপশালী জমিদার। মায়ের নাম
মোসাম্মত হুরমত জান বিবি।

হাসন রাজা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র। উল্লেখ্য আলী রাজা তার খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাসন রাজার জন্ম হয়। হাসনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা, তাঁর অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তাঁরই নামের অনুকরণে তাঁর নামকরণ করেন অহিদুর রাজা। উল্লেখ্য হাসন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাঁদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাসন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার অধিবাসী ছিলেন।

হাসন রাজার শৈশবকালে সিলেট অঞ্চলে আরবী-ফার্সি ভাষার ব্যাপক চর্চা প্রবল ছিল। সিলেটের ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লাহ নামক একজন বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে, তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন হাসন রাজা নামে। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।

উত্তারিধাকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হন। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে (১২৭৬ বঙ্গাব্দ), তাঁর পিতা এবং বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি জমিদারি লাভ করেন। প্রথম যৌবনে তিনি ভোগবিলাসী জীবনযাপন করেন। অপরিমিত রমণী সম্ভোগের কারণে তিনি যৌবনে আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন বলে অনেকে বলে থাকেন। প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় বসবাস করতেন। এই সময় তিনি ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত।


হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। 'কুড়া' ছিল তার প্রিয় পাখি। তিনি ঘোড়া পুষতেন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি।

তাঁর সৌখিনতার পাশাপাশি, অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কথিত আছে এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শনে, হাসন রাজার জীবন দর্শন পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে তিনি বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করতে থাকেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দেন এবং বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে আল্লাহ্‌র প্রেমে মগ্ন হন। এই সময় তিনি তাঁর সকল ধ্যান ধারণা স্বরচিত গানে প্রকাশ করতে থাকেন। পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে 'হাসন এম.ই. হাই স্কুল' এবং অন্যান্য অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। উল্লেখ্য এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পুর্বেই নিজে প্রস্তুত করেছিলেন।

বিভিন্ন সূত্রে তাঁর একাধিক স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এঁদের নাম আজিজা বানু, বোরজান বিবি, সাজেদা বানু, জোবেদা খাতুন, লবজান চৌধুরী। তাঁর সন্তানরা ছিলেন

পুত্র :
খান বাহাদুর দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী (১২৮৩-১৩৩৯ বাংলা)
দেওয়ান হাসিনুর রাজা চৌধুরী (১২৮৫-১৩৫১ বাংলা)
খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী (১২৯৬-১৩৭১ বাংলা)
দেওয়ান আফতাবুর রাজা চৌধুরী (১৩০৩-১৩৬২ বাংলা)

কন্যা
রওশন হুসেইন বানু, রওসন হাসান বানু, আলী হুসেইন বানু, রওশন আখতার বানু।
কবরস্থানঃ হাসন রাজা যাদুঘরে রক্ষিত কিছু জিনিষ-পত্রের ছবি।

হাসনরাজার গান
হাসন রাজার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলো 'হাসন রাজার গান' নামেই পরিচিত। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচিত ২০৬টি নিয়ে গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল 'হাছন উদাস' । এর বাইরে আর কিছু গান 'হাসন রাজার তিনপুরুষ' এবং 'আল ইসলাহ্‌' সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ 'সৌখিন বাহার'-এর আলোচ্য বিষয ছিল
'স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার (লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,'মরমী কবি হাসন রাজা')। 'হাছন বাহার' নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।


বহিঃসূত্র :