হেমেন্দ্রনাথ বসু
ব্যবসায়ী এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের যান্ত্রিক উপকরণের বাজরজাতকরণের জন্য
খ্যাত।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে তাঁর জন্ম। এঁদের আদি নিবাস ছিল ময়মনসিংহের
জয়সিদ্ধিতে। তাঁর পিতার নাম হরমোহন। হেমন্দ্রমোহনের
পুত্রকন্যাদের ভিতরে চিত্রপরিচলক নীতীন বসু, ক্রিকেটার কার্তিক বসু এবং সঙ্গীত
শিল্পী মালতী ঘোষাল খ্যাতিলাভ করেছিলেন ।
হেমেন্দ্রনাথ বসু আইএ পাস করার পর মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় চোখে
অ্যাসিড ছিটকে পড়ায় কিছুদিন অসুস্থ থাকেন।
১৮৯০-৯১ খ্রিষ্টাব্দে 'কুন্তলীন কেশ' তৈল নিয়ে ব্যবসায় অবতীর্ণ হন। এইচ. বোস পারফিউমার কারখানা থেকে
সে সময় তৈরি হতো−কুন্তলীন, দেলখোস, ল্যাভেণ্ডার ওয়াটার, ও-ডি কোলন, মিল্ক অফ রোজ
প্রভৃতি সুগন্ধি দ্রব্য ।
বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম কলকাতার হ্যারিসন রোডে সাইকেলের দোকান খোলেন। সে সময়
বাঙালিদের ভিতরে সাইকেল চালানোর বিষয়টিই অভিনব ছিল। তিনি
নিজে সাইকেল চড়তেন এবং বন্ধু বান্ধবদের চড়তে শেখাতেন। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
টু-সিটার ড্যাকার গাড়ি কিনেন। এই সূত্রে পরে তিনি গ্রেট ইষ্টার্ন মোটর কোম্পানি
স্থাপন করেন। গাড়ি মেরামতের জন্য পার্ক স্ট্রীটে গ্রেট ইষ্টার্ন মোটর ওয়ার্কস নামে তাঁর একটি
মেরামতির কারখানা ছিল ।
আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে যখন সঙ্গীতের রেকর্ডের ক্রমেই বেড়ে চলেছিল, এই সময়, ভারতীয় শিল্পীদের গানের চাহিদা বুঝে, হেমেন্দ্রনাথ বসু কলকাতাস্থ 'ধর্মতলার
মার্বেল হাউসে দ্য টকিং মেশিন হল (The
Talking Machine Hall) নামে
রেকর্ড তৈরির
কারখানা স্থাপন করেন। এই রেকর্ড ছিল
ফনোগ্রামের সিলিন্ডার। পরে বৌবাজার স্ট্রীটের দেলখোস হাউসে এই কারখানা স্থানন্তরিত হয়।
তাঁর রেকর্ড কোম্পানির নাম ছিল এইচ.বোসেস।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর, এইচ. বোসেস রেকর্ডের আত্মপ্রকাশ
এবং বন্দেমাতরম গান সহ শুধু দেশাত্মবোধক গানই এতে প্রচার করা হয়েছিল । স্বদেশী গান
প্রচারের জন্য তিনি তাঁর প্রধান শিল্পী হিসাবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে । তাঁর তৈরি রেকর্ডে লালচাঁদ বড়াল বহু গান দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের গীত গানের সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত বিজ্ঞাপনটি এরূপ ছিল -H. Bose's Records/songs composed and sung by babu Rabindra Nath Tagore.
এই রেকর্ডের গানগুলো ছিল
১।
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
২।
ও আমার
দেশের মাটি,
তোমার
’পরে
ঠেকাই মাথা।
৩।
নিশিদিন ভরসা রাখিস,
ওরে মন,
হবেই হবে
৪।
এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে
৫।
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
৬।
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
৭।
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
৮।
যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা-না
and many others.
সিদ্ধার্থ ঘোষ যন্ত্ররসিক এইচ বোস প্রবন্ধে
মার্চ
১৯০৬ এ প্রকাশিত এইচ বোস
রেকর্ডস-এর
ক্যাটালগের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত আটটি গান ছাড়া আরও ছটি গানের
সন্ধান দিয়েছেন।
১।
পথের গান-আমরা পথে পথে যাব সারে সারে
২।
দ্বিধা-বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি
৩।
বাউল-২,
যে তোরে পাগল বলে
৪।
আপনি অবশ হলি,
তবে বল্ দিবি তুই কারে
৫।
প্রয়াস-তোর আপন জনে ছড়াবে তোরে
৬।
বাউল-ঘরে মুখ মলিন দেখে।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তাঁর কোম্পানির নামকরণ
হয়, Pathe/H.Boses's
Records এগুলো
ছিল সাড়ে ৮ ইঞ্চি মাপের সমতল ডিস্ক।
হেমেন্দ্রকুমার প্রতিষ্ঠিত কুন্তলীন প্রেসেরও খুব সুনাম ছিল । তিনি নিজে দক্ষ
আলোকচিত্রী ছিলেন । রঙিন আলোকচিত্র গ্রহণে তিনি এদেশে পথিকৃৎ । তাঁর তোলা কয়েকটি
অটোক্রোম স্লাইড পাওয়া যায় । তিনি কুন্তলীন ও দেলখোসের প্রচার এবং সাহিত্যসৃষ্টিকে উৎসাহ দেবার জন্য
১৩০৩ বঙ্গাব্দে কুন্তলীন পুরস্কার প্রবর্তন করেন। গল্প লিখে প্রথম বছরের পুরস্কার পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র
বসু । শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মুদ্রিত গল্প মন্দিরা কুন্তলীন পুরস্কার
বিজয়ী ।
হেমেন্দ্রকুমার খেলাধুলাতেও উৎসাহী ছিলেন । স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের তিনি ছিলেন
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগষ্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র :