হেনা দাস
সাহিত্যিক, বিপ্লবী ও সমাজ সংস্করক
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সতীশচন্দ্র
দত্ত ছিলেন একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। তাঁর মা মনোরমা দত্ত ছিলেন চুনারুঘাট থানার
নরপতি গ্রামের জমিদার জগৎচন্দ্র বিশ্বাসের বড়ো মেয়ে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে
হেনা দাস ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন সিলেট সরকারি
বালিকা বিদ্যালয়ে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের
সাথে যুক্ত হন। এই সময় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে প্রভাবিত হন।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি ছাত্রসংগঠনের যোগ দেন। ১৯৪৮-১৯৪৯
খ্রিষ্টাব্দে তিনি নানাকার আন্দোলনে নানাকার মেয়েদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন
করেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাধ্যমিক পাসের পর তিনি সুরমা ভ্যালি গার্লস্ স্টুডেন্টস্
কমিটি গঠনের কাজে যুক্ত হন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে হেনদাসের জীবনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বৎসরেই তিনি প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বৎসরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির
সদস্যপদ লাভ করেন আর আগষ্ট মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আইনসঙ্গত বলে ঘোষিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গদেশে ভয়ঙ্কর মন্বন্তর (বাংলা ১৩৫০) দেখা দেয়।
এই সময়ে তিনি যথাসাধ্য ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে নেত্রকোণা জেলায় 'নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন' হয়। ওই সম্মেলনে লক্ষাধিক সংগ্রামী জনতার সামনে 'গণনাট্য সংঘে'র শিল্পী হিসেবে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এই সময় তিনি সিলেট জেলায় ছাত্র আন্দোলনকে আরো জোরদার করার জন্য পার্টির নির্দেশে ছাত্র ফ্রন্টে কাজ করা শুরু করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি বিএ পাস করেন। শিক্ষকতা করার সময় তিনি ময়মনসিংহ মহিলা ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড
ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন গড়ে তোলার চেষ্টা
করা হয়। এই সূত্রে ময়মনসিংহে ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলন। হেনা দাস ওই
সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক
নির্বাচিত হন। এরপর তিনি আত্মগোপন অবস্থায় গ্রামে চলে যান। এই সময় হেনা দাসের বাবা
অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মেয়েকে বিয়ে করার অনুরোধ করেন। অসুস্থ বাবার অনুরোধ রাখতে
তিনি বিয়ের জন্য রাজি হন। সিলেট জেলা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা এবং
কমিউনিষ্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী কমরেড রোহিনী দাসের সাথে তাঁর বিবাহের আয়োজন হয়।
রাজনৈতিক কারণে উভয়ই আত্মগোপন করে থাকতেন। এই অবস্থায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন
ঘরোয়াভাবে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর উভয়ই বেশিরভাগ
সময় পার্টির গোপন আস্তানায় বা বিশ্বস্ত কোনো কর্মীর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের হেনা দাসের প্রথম মেয়ে বুলু জন্মগ্রহণ করে। ১৯৫২
খ্রিষ্টাব্দে গোপন আস্তানা থেকে তিনি মেয়েদেরকে ভাষা-আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন।
কিন্তু গ্রেফতারের হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু কন্যাকে
বুলুকে নিয়ে এভাবে আত্মগোপন করে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
ফলে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কন্যাকে নিয়ে
কলকাতায় পিসীর বাড়িতে যান। কিন্তু দলীয় কর্তব্যবোধে সেখানে সেখানে তিনি থাকতে
পারলেন না। সেই কারণে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকার 'গেণ্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা
বিদ্যালয়'-এ শিক্ষকতার চাকরি নেন। সে সময় তাঁর মাসিক বেতন ছিল ১১৫ টাকা। কিন্তু
স্বামী রোহিনী দাস তখনো আত্মগোপনে। ছুটি পেলে বছরে দু'একবার হেনা দাস বুলুকে নিয়ে
সিলেটে যেয়ে স্বামীর সাথে দেখা করতেন।
১৯৬০-৬২ খ্রিষ্টাব্দে সারা দেশে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হলে, তিনি শিক্ষক সমিতির
আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর 'নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়'-এ তিনি প্রধান
শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন। ওই স্কুল থেকে তাঁর নামে একটি কোয়ার্টার বরাদ্দ করা হয়। এরপর
'মহাখালী ওয়ারলেস স্টেশন স্কুলে'-ও তিনি কিছুদিন
প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন
এরপর ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএ প্রথম পর্ব শেষ করেন। এই সময় তাঁর স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হেনা দাসের কোয়ার্টারে চলে আসেন। এই অসুস্থতার কারণে তাঁর স্বামী আর রাজনীতিতে আর সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন নি। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে চম্পা জন্মগ্রহণ করে। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি 'মহিলা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করেন। এসময় তাঁর কর্ম এলাকা ছিল প্রধানত নারায়ণগঞ্জ।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন ও
নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলনে 'বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ'-এর যুক্ত হন ।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, তিনি ভারতে চলে যান এবং
উদ্বাস্তু শিক্ষকদের সাথে 'উদ্বাস্তু শিক্ষক সমিতি' গঠন করেন। পরে এই সমিতির
মাধ্যমে রিলিফের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ সমিতির মাধ্যমে উদ্বাস্তু শিবিরে ৫০টি
ক্যাম্প স্কুল স্থাপন করে শিশু-কিশোরদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও তিনি সে সময়
কলকাতা মহিলা পরিষদের রিলিফ আন্দোলন ও নারীদের সংগঠিত করতে ব্যস্ত ছিলেন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন করার জন্য হেনা দাস তিন দিন জেলে বন্দি থাকেন। তিনি জানান, এই তিন দিন বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর মারাত্মকভাবে নির্যাতন করা হয়। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তী ১৪ বছরে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক-সহ আরও বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হয়ে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ডঃ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে রোহিণী দাস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং প্রায় দুই বৎসর রোগে ভুগে, ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ৩ জানুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকদের নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে তৎকালীন 'এরশাদ সরকার' এই আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই আন্দোলনের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১ মাস ৮ দিন তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি থাকেন এবং পরে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে চাকুরি থেকে অবসর নেন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও শিক্ষক
সমিতির মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি মহিলা পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই ৮৫ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সন্তান
তাঁর দুই মেয়ে৷ বড় মেয়ে দীপা ইসলাম (বুলু) স্বনামধন্য গাইনোকোলোজিস্ট এবং ছোট
মেয়ে চম্পা জামান কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রি অর্জন করেছেন৷
সম্মাননা
রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি 'রোকেয়া পদকে' সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়া সুনামগঞ্জ পৌরসভা,
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, আহমেদ
শরীফ ট্রাস্টসহ তিনি বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। রাজশাহীর
একটি প্রতিষ্ঠান হেনা দাসের ওপর একটি অডিওভিজু্য়াল ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে।
নারীপক্ষ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত দুটি বই-এ হেনা দাসের সংক্ষিপ্ত
জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক 'মাতৃমুক্তি পথিকৃত'
নামে তাঁর জীবনের উপর একটি বই প্রকাশ করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি :
উজ্জ্বল স্মৃতি'
শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন
স্মৃতিময় দিনগুলো
নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা
স্মৃতিময়-'৭১ এবং
চার পুরুষের কাহিনী
তথ্যসূত্র :
http://www.gunijan.org/GjProfDetails_action.php?GjProfId=7
http://bn.wikipedia.org/