হেরাসিম লেবেদেফ
(১৭৪৯-১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলা নাটকের আদি পুরুষ। পুরোনাম
হেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ (Гера́сим Степа́нович Ле́бедев)। ইংরেজিতে এর দুটি বানানে নাম পাওয়া যায়। বানান দুটি হলো-
    Gerasim Stepanovich Lebedev
    Herasim Steppanovich Lebedeff

   

১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার ইয়ারোস্লাভ্ল্
(Yaroslavl) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতামাতার প্রথম সন্তান। তাঁর ছোটো দুই ভাইয়ের নাম ছিল আফানাসি এবং ট্রেফিল। একমাত্র বোনের নাম ছিল আন্তোনিডা। পিতার কর্মস্থল ছিল সেন্ট পিটারসবার্গের একটি গির্জায়। লেবেদেফ শৈশবেই তাঁর পরিবারের সাথে সেন্ট পিটারসবার্গে চলে আসেন। এখানে থাকাবস্থায় তিনি নিজের চেষ্টায় ইংরেজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষা শেখেন। এখানে প্রথম স্থায়ী রাশিয়ার থিয়েটার দলের প্রতিষ্ঠাতা ফিয়োদর ভোল্কোভ-এর সাথে পরিচিত হন। এই সময় তিনি ভোল্কোভের নাট্যদলে দলগত সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করতেন। এরপর তিনি নিজের চেষ্টায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের নানা বিষয়ে নানা জনের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বেহালা বাদনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। এই সূত্রে তিনি সঙ্গীতদলের সাথে বেহালাবাদক হিসেবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভিয়েনাতে আসেন। এরপর রুশদের সঙ্গ ত্যাগ করে, ইউরোপের নানাস্থানে ভ্রমণ করেন। পরে তিনি ইংরজেদের সামরিক ব্যান্ড দলে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশ সেনাদলের সাথে ভারতে আসেন। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাহাজে মাদ্রাজে পৌঁছান এবং সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সেখানকার মেয়র তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। কয়েকটি সঙ্গীত আসরে যোগদান করে তিনি কিছু অর্থ উপার্জনও করেন। কিন্তু মাদ্রাজের রক্ষণশীল সমাজে প্রবেশাধিকার না পেয়ে তিনি ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা আসেন এবং এক রুশ চিকিৎসকের সাহায্যে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। সে সময়ে তাঁর গানের আসরে প্রবেশমূল্য ছিল ১২ টাকা। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রে ভারতীয় সুর তুলে সবাইকে মুগ্ধ করেন। এই সময় তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী একজনকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজদের বিরাগভাজন হন।

গোলক দাস নামক একজন স্কুল শিক্ষককে তিনি কিছুদিন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পাঠদান শুরু করেন। বিশেষ করে তিনি গোলকদাসকে বেহালা শিখিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি গোলকদাসের কাছে বাংলা, সংস্কৃত এবং হিন্দি ভাষা শেখেন। এই সূত্রে তিনি একটি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। এই গ্রন্থটি ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি রচনা করেন 'অভিধান', 'কথোপকথন গ্রন্থ', 'বীজগণিত', 'বাংলা পঞ্জিকার অংশ', 'ভারতচন্দ্রের কাব্য' একটি আত্মজীবনী। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মলিয়ের '
Love of the best doctor' এবং জড্রেলের নাটক 'The Disguise' বাংলায় অনুবাদ করেন। এরপর কলকাতার ডোমতলায় (এজরা স্ট্রিট) একটি রঙ্গমঞ্চ তৈরি করেন। এই নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের 'ক্যালকাটা গেজেট'-এ ৫ই নভেম্বর একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল।

বাঙালি অভিনেতাদের দিয়ে তিনি ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর তাঁর অনূদিত নাটক দুটি মঞ্চস্থ করেন। এই নাটকে তিনি ভারতচন্দ্রের গানে নিজে সুরারোপ করে ব্যবহার করেছিলেন। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মার্চ নাটক ২টি পুনরায় মঞ্চস্থ হয়েছিল।

এটাই ছিল বাংলা তথা ভারতবর্ষের কোনো দেশীয়  নাটকের উপস্থাপন। এই নাটক মঞ্চস্থের সূত্রে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই সময় ইংরেজরা ঈর্ষান্বিত হয়ে সীন পেন্টার এবং মিস্টার হে নামক দুজন রাজকর্মচারীরকে দিয়ে এই রঙ্গমঞ্চ পুড়িয়ে দেন। এরপর জনৈকা ইংরেজ মহিলার সাথে প্রেম করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। নানা কারণে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে আদালতে যেতে হয়। পরে ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করেন। তিনি মাত্র ২৯৫ টাকা নিয়ে ভারত ত্যাগ করেন। ইউরোপে পৌঁছানোর টাকা না থাকায় তিনি কেপটাউনে নেমে কিছু অর্থ উপার্জন করেন এবং পরে লণ্ডনে পৌঁছান। লণ্ডনে অবস্থানকালে তিনি
Grammar of the Pure and Mixed East Indian Languages গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে যান ।

১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুলাই সেন্ট পিটার্সবার্গে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্র: