মীর্জা মুহাম্মদ ইউসুফ আলি
(১৮৫৮-১৯২০)
ব্রিটিশ ভারতের একজন বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীর জেলার দুর্গাপুর উপজেলার আলিয়াবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে শ্রীধর মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয় এবং এরপর রাজশাহী নর্মাল স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এই স্কুলের ত্রৈমাসিক পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তবে এরপর নানা কারণে নিয়মিতভাবে স্কুলের পাঠ গ্রহণ করতে অপারগ হওয়ায় তিনি প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে এফ.এ. পরীক্ষায় অকৃতকার্য‌ হওয়ার পর, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়াশোনা করা সম্ভব হয় নি। তবে নিজ চেষ্টায় বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি  আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা রপ্ত করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে কিছুদিন তিনি কুচবিহারের একটি বাংলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহীর লোকনাথ স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর  রংপুরের সরকারি নর্মাল স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর ১৮৯৩ -১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্কুল পরিদর্শক এবং সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।  

চাকরি জীবনের মাঝেই তিনি ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীর 'নূর-আল-ঈমান সমাজ' নামক সমিতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এরপর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠাত হয় 'আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম'। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে 'রাজশাহী জেলা মুসলমান শিক্ষাসমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'দুগ্ধসরোবর' প্রকাশিত হয়।
১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইমাম গাজ্জালির কিমিয়ায়ে সাআদাত গ্রন্থ সৌভাগ্যস্পর্শমণি নামে বঙ্গানুবাদ করেন। এই গ্রন্থটির অনুবাদ করার জন্য ছয় সদস্যের একটি অনুবাদক কমিটি গঠন করা হয়। এর মূল অনুবাদক ছিলেন মীর্জা ইউসুফ আলী।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ 'নূর-আল-ঈমান সমাজ'-এর মুখপত্র  '
নূর-অল ইমান'-এর সম্পাদনা করেন তিনি। এই পত্রিকার আখ্যাপত্রে লেখা হতো: 'নূর-অল ইমান সমাজ কর্তৃক সম্পাদিত ও মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী কর্তৃক শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সজ্জীকৃত।' পত্রিকাটি সমাজের সভ্যদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো।

 দিকে কেউ কেউ বাংলাদেশে উর্দুকে ইসলামী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। এই সময় রাজশাহী থেকে প্রকাশিত 'নুর-আল-ইমান' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি তাঁর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

এই পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায়, পত্রিকার সম্পাদক মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী 'বঙ্গীয় মোসলমান ভাই বহিনের খেদমতে নুর-আল-ইমানের আপীল' নামক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন-
'...শরীফ সন্তানেরা এবং তাহাদের খিদমাৎগারগণ উর্দু বলেন, বাঙ্গলা ভাষা ঘৃণা করেন, কিন্তু সেই উর্দু জবানে মনের ভাব প্রকাশ করা তো দূরে থাকুক, পশ্চিমা লোকের গিলিত চর্বিত লিখিত শব্দগুলিও অনেকে যথাস্থানে শুদ্ধ আকারে যথার্থ অর্থে প্রয়োগ করিতেও অপারগ। অথচ বাঙ্গলায় মনের ভাব প্রকাশ করিবার সুবিধা হইলেও ঘৃণা করিয়া তাহা হইতে বিরত হন।... সতেজ স্বাভাবিক বাঙ্গলা ভাষা স্বাধীনতা পাইলে তৎসঙ্গে পল্লীবাসি মোসলমান সমাজের উন্নতির যুগান্তর উপস্থিত হইবে। ...বঙ্গের মোসলমান ভ্রাতাভগ্নিগণ!.... বাঙ্গলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা বলিয়া ঘৃণা না করিয়া আপনাদের অবস্থা ও সময়ের উপযোগী করিয়া লউন। '
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল চতুর্মাসিক শিক্ষা সমবায় পত্রিকা।

এরপর থেকে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় তিনি লেখনী এবং প্রচারণার মাধ্যমে সংগ্রাম করে যান।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।