যিশুখ্রিষ্ট
হিব্রু: יֵשׁוּעַ য়েশুয়া।
আরবি : عيسى, ঈশা।
বাঙালি খ্রিষ্টানরা যিশু শব্দটি গ্রহণ করেছে বাইবেল থেকে। বাইবেলে উল্লিখিত শব্দটি নেওয়া হয়েছে হিব্রু יֵשׁוּעַ (য়েশুয়া) থেকে বা ইংরেজি শব্দ Jesus থেকে। হিব্রু מָשִׁיחַ (Māšîaḥ) শব্দ থেকে সৃষ্ট মসিহ শব্দটিও যিশুর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হিব্রু থেকে গ্রিক ভাষায় অনুবাদের সময় গ্রিক শব্দ Χριστός (Khrīstos) ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে ইংরেজিতে ওই শব্দটি নেওয়া Christ হয়েছে হিসেবে। বাঙালি মুসলমানরা ঈশা শব্দ ব্যবহার করে থাকেন আরবি عيسى, ঈশা থেকে। তবে মুসলমানরা যিশুকে নবী হিসেবে মান্য করেন বলেন- শ্রদ্ধার সাথে বলেন হযরত ঈশা (আঃ)।
সব মিলিয়ে যিশুখ্রিষ্টের সমার্থক নাম পাওয়া যায়, তা হলো- যিশু, খ্রিষ্ট, যিশুখ্রিষ্ট, ঈসা, ঈসা মসিহ, হযরত ঈসা (আঃ)।
খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের মতে যিশু যোশেফের স্ত্রী মরিয়মের গর্ভে জন্মেছিলেন। ঈশ্বরের ইচ্ছায় মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন। যোশেফ তাঁর স্ত্রী মরিয়মের সাথে মিলিত হওয়ার আগেই গর্ভবতী হয়েছিলেন। এই কারণে যোশেফ মরিয়মকে গোপনে ত্যাগ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু স্বপ্নের ভিতরে যোশেফ জানতে পারেন যে, মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছেন− ঈশ্বরের ইচ্ছায়। বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচার থেকে জানা যায়, পবিত্র আত্মা থেকে মরিয়ম গর্ভবতী হয়েছিলেন। [নূতন নিয়ম, মথি ২:২০]। মুসলমানরা মনে করেন, আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন তাই তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন এবং এর জন্য পবিত্র আত্মার সংস্পর্শে আসার দরকার পড়ে নাই। এ বিষয়ে কোরান-এর উক্তি হলো− 'আল্লাহ এমন নন যে, সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, তিনি যখন কোন কাজ করা সিদ্ধান্ত করেন, তখন একথাই বলেন: হও এবং তা হয়ে যায়।' [আল্ কোরআন। সুরা মরিয়ম ৩৫।] মূলত যিশু কুমারী মাতার পুত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
যিশুখ্রিষ্টের জন্ম তারিখ নিয়ে মতবিরোধ আছে। খ্রিষ্ট প্রথম শতাব্দীর প্রারম্ভের কাছাকাছি আর মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৩০-৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর। তিনি জন্মেছিলেন বেথেলহামে। এই সময় যিহুদিয়ার বেথেলহেম ছিল হেরোদ রাজার শাসনাধীন। হেরোদ কতিপয় জ্যোতিষির মাধ্যমে জেনেছিলেন যে, একটি অলৌকিক শিশুর জন্মের পর তার রাজত্বের অবসান হবে। এই সময় প্রাচ্যদেশের কয়েকজন ভাববাদী পণ্ডিত যিশুর জন্মের কথা জানতে পারেন। এবং আকাশের নবতারার উদয় দেখে যিশুর জন্মগ্রহণের কথা অনুমান করে, তাঁরা যিশুকে দেখার জন্য হেরোদের রাজদরবারে আসেন। এই সময় হেরোদ বিষয়টি জানতে পেরে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি ভাববাদীদেরকে যিশুর জন্মস্থান কোথায় তা জেনে, ফেরার পথে তাঁকে জানানোর অনুরোধ করেন। পণ্ডিতরা পরে বেথেলহেমে গিয়ে শিশু যিশুর সাথে দেখা করেন। পরে ভিন্ন পথে হেরোদকে না জানিয়ে দেশে ফিরে যান। রাতের যোশেফ স্বপ্নাদেশে মরিয়ম এবং যিশুকে মিশরে চলে গেলেন। এদিকে হেরোদ যখন জানলেন যে, পণ্ডিতরা তাঁকে কিছু না জানিয়ে ভিন্নপথে চলে গেছেন, তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বেথেলহেম এবং তৎসংলগ্ন স্থানের সকল ২ বৎসর বা তার চেয়ে সকল বালককে হত্যা করলেন। এরপর যোশেফ ইস্রায়েল প্রদেশে চলে যান। এরপর অপর এক স্বপ্নাদেশে তিনি গালিল প্রদেশে চলে যান এবং সেখানকার নাসারৎ নামক স্থানে বাস করা শুরু করেন। এই স্থানে যিশু বড় হন বলে- তিনি নাসারতের যিশু নামে পরিচিতি লাভ করেন।
তারপর দীর্ঘদিন যিশুর জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে জানা যায় না। সম্ভবত তিনি নাসারতে বড় হয়ে উঠেন। যিশুকে পুনরায় পাওয়া যোহনের বাপ্তাইজ কার্যক্রমের সময়। সমস্ত স্থানীয় মানুষকে যোহন পাপ স্বীকার করে জর্ডন নদীতে বাপ্তাইজ করার আহ্বান করেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে স্থানীয় বহুলোক বাপ্তাইজিত হতে থাকলেন। সেই সময় যোহন শিশু যিশুকেও বাপ্তাইজ করেন।
এরপর চল্লিশ দিন অনাহারে থেকে ক্ষুধার্ত হলেন। মথি লিখিত সুসমাচার মতে― এই সময় দিয়াবল (শয়তান) তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য দিয়াবল তাঁর কাছে এসে বলল, 'তুমি যদি ঈশ্বরের পুত্র হও, তবে এই পাথরগুলিকে রুটিতে পরিণত হতে বলো। যিশু এর উত্তরে বললেন: 'শাস্ত্রে একথা লেখা আছে, 'মানুষ কেবল রুটিতে বাঁচে না, কিন্তু ঈশ্বরের মুখের প্রত্যেকটি বাক্যেই বাঁচে৷[দ্বিতীয় বিবরণ ৮.৩]। এরপর দিয়াবল তখন পবিত্র নগরী জেরুশালেমের মন্দিরের চূড়ায় যিশুকে নিয়ে গেল এবং যিশুকে বলল, 'তুমি যদি ঈশ্বরের পুত্র হও তবে লাফ দিয়ে নিচে পড়, কারণ শাস্ত্রে তো একথা লেখা আছে: 'তিনি তাঁর স্বর্গদূতদের তোমার উপর দৃষ্টি রাখতে আদেশ দেবেন আর তারা তোমাকে তুলে ধরবেন, য়েন পাথরের উপর পড়ে তোমার পায়ে আঘাত না লাগে৷[গীতসংহিতা ৯১ :১১-১২]। যিশু তখন তাকে বললেন, 'শাস্ত্রে একথাও লেখা আছে, 'তোমার প্রভু ঈশ্বরকে তুমি পরীক্ষা করবে না [দ্বিতীয় বিবরণ ৬:১৬] । এরপর দিয়াবল আবার তাঁকে খুব উঁচু একটা পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে জগতের সমস্ত রাজ্য ও তার সম্পদ দেখালো। পরে দিয়াবল যিশুকে বলল, 'তুমি যদি আমার সামনে মাথা নত করে আমার উপাসনা কর, তবে এসবই আমি তোমায় দেব' তখন যীশু তাকে বললেন, 'দূর হও শয়তান! কারণ শাস্ত্রে লেখা আছে, 'তোমরা অবশ্যই প্রভু ঈশ্বরেরই উপাসনা করবে, একমাত্র তাঁরই সেবা করবে৷'" দ্বিতীয় বিবরণ ৬:১৩]। এরপর যিশু প্রকাশ্যে তাঁর ধর্ম প্রচার শুরু করেন।
তাঁর প্রচার কার্যের সময় তিনি মৃতলোককে জীবিত করেন এবং রোগগ্রস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলেন। তাঁর ধর্মপ্রচারণার সূত্রে বারজন একনিষ্ঠ শিষ্য তৈরি হয়েছিল। এই বার জন শিষ্য হলেন শিমোন (পিতর), আন্দ্রিয়, যাকোব, যোহন, ফিলিপ, বর্থলময়, থোমা, মথি, আলফেয়ের ছেলে যাকোব ও থদ্দেয় এবং যিহুদা। তিনি ১২জন শিষ্যকে ধর্মপ্রচারের জন্য নানাদিকে প্রেরণ করেন। এই সময় নানাধরনের উপমা, গল্প ইত্যাদির দ্বারা তাঁর দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেন।
ধর্ম প্রচারের সূত্রে তিনি জেরুজালেম আসেন।
এখানে তাঁর সাথে রাজশক্তির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিশেষ করে মন্দিরের ধর্মব্যবসা বন্ধ
হয়ে যায়। এছাড়া ইহুদী পুরোহিতদের সকল আজ্ঞা অগ্রাহ্য করে নিজের মত প্রচার করা শুরু
করেন। ফলে যিশুর বিরোধী পক্ষরা তাঁর শাস্তির জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। সেইসময়
মহাযাজক কায়াফার বাড়ির উঠানে প্রধান যাজকরা ও ইহুদী নেতারা এসে ষড়যন্ত্র করার
জন্য জড় হলো। তারা যিশুকে গ্রেপ্তার করতে পারে ও তাঁকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করতে পারে
তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।
যিশু শেষবারের মতো তাঁর ১২জন শিষ্য নিয়ে রাতের খাবার গ্রহণ (Last
Supper) করেন। এই সভাতে যিশু বলেন যে,
উপস্থিত বারজন শিষ্যের ভিতর একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে শত্রু হাতে ধরিয়ে দেবে।
শেষ পর্যন্ত যিহুদা নামক এক শিষ্য তাঁকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়।
যিশুকে গ্রেপ্তার করে মহাযাজক কায়াফার বাড়িতে নিয়ে এসে, এক প্রহসনমূলক বিচার শুরু করে। প্রথম দিকে যিশুর বিরুদ্ধে কোনো চরম অপরাধের প্রমাণ হাজির করা গেলো না। এরপর নানারকম অযৌক্তিক এবং মিথ্যা দ্বারা যিশুকে এমনভাবে উপস্থান করা হলো যে, সাধারণ মানুষ যিশুকে ভয়ঙ্কর অপরাধী হিসেব বিবেচনা করা শুরু করলো। পিলাতের প্ররোচনায়, জনসাধারণ যিশুর মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুললো। এরপর বিচারকরা যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি করলেন।
বিচার শেষে পিলাত যিশুকে চাবুক মেরে ক্রুশে দেবার জন্য রাজ্যপালের সৈন্যদের হতে তুলে দিলেন। সৈন্যরা যিশুকে প্রথমে রাজভবনের সভাগৃহে নিয়ে গিয়ে, যিশুর নিজস্ব পোশাক খুলে নিলো। এরপর তাঁকে একটা লাল রঙের পোশাক পরানো হলো। এরপর কাঁটা লতা দিয়ে একটা মুকুট তৈরী করে তা তাঁর মাথায় চেপে বসিয়ে দিল তারা। এই সময় সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ 'ইহুদীদের রাজা, দীর্ঘজীবি হোন্!' বলে ব্যঙ্গ করতে থাকলো। তারা তাঁর মুখে থুথু দিল ও তাঁর লাঠিটি নিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করতে থাকলো। এরপর ক্রুশে বিদ্ধ করার জন্য নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো।এরা প্রথমে 'গলগথা (মাথার খুলির স্থান)' নামক যিশুকে মাদক দ্রব্য মেশানো তিক্ত দ্রাক্ষারস পান করতে দিল; কিন্তু তিনি তা সামান্য আস্বাদ করে আর খেতে চাইলেন না। তাঁকে ক্রুশে দিয়ে তাঁর জামা কাপড় খুলে নিয়ে ঘুঁটি চেলে সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। সৈন্যরা তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ফলকটি তাঁর মাথার উপরে ক্রুশে লাগিয়ে দিল। ফলকে লেখা ছিল 'এ যীশু, ইহুদীদের রাজা'। এই সময় তারা দুজন দস্যুকেও যীশুর সঙ্গে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল। এই সময় নানা ধরনের লোক নানাভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ করা শুরু করে।
বাইবেলের মতে (মথি ২৭:৪৪-৫২) সেই দিন দুপুর
বারোটা থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত সমস্ত দেশ অন্ধকারে ঢেকে রইল। প্রায় তিনটের সময়
যীশু খুব জোরে বলে উঠলেন, 'এলি, এলি লামা শবক্তানী?' যার অর্থ, 'ঈশ্বর আমার, ঈশ্বর
আমার, তুমি কেন আমায় ত্যাগ করেছ?' যাঁরা সেখানে দাঁড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন
একথা শুনে বলতে লাগল, 'ও এলীয়কে ডাকছে৷' তাদের মধ্যে একজন তখনই দৌড়ে গিয়ে একটা
স্পঞ্জ কতকটা সিরকায় ডুবিয়ে দিয়ে একটা নলের মাথায় সেটা লাগিয়ে তা যীশুর মুখে
তুলে ধরে তাকে খেতে দিল। কিন্তু অন্যরা বলতে লাগল, 'ছেড়ে দাও, দেখি এলীয় ওকে
রক্ষা করতে আসেন কি না?' পরে যীশু আর একবার খুব জোরে চিৎকার করে প্রাণ ত্যাগ
করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের মধ্যেকার সেই ভারী পর্দাটা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত চিরে
দুভাগ হয়ে গেল, পৃথিবী কেঁপে উঠল, বড় বড় পাথরের চাঁই ফেটে গেল।
এই সময় আরিমাথিযার যোষেফ নামে এক ধনী ব্যক্তি জেরুশালেমে এলেন। তিনি পীলাতের কাছে গিয়ে যিশুর দেহ নিয়ে একটা কাপড়ে জড়ালেন। এবং পাহাড়ের গায়ে একটা নতুন সমাধিগুহা কেটে যিশুর মৃতদেহ রেখেদিলেন। বাইবেলের মতে তিনদিন পর যিশুর পুনরুত্থান হয়েছিল। মুসলমানরা মনে করেন, যিশুর আত্মাকে চতুর্থ আসমানে তুলে নেওয়া হয়েছিল।
সূত্র :
পবিত্র বাইবেল। পুরাতন ও নূতন নিয়ম।
বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি ঢাকা।
আল্ কোরান (অনুবাদ)
http://mormon.lds.net/mormon-beliefs/jesus-christ
http://en.wikipedia.org/wiki/Jesus