জহির রায়হান
(১৯৩৩-১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ)
শহিদ বুদ্ধিজীবী। চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সাহিত্যিক। প্রকৃত নাম আবু আব্দাল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাকনাম ছিল জাফর।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দর ১৯ আগস্ট (শনিবার, ৩ ভাদ্র ১৩৪০), বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মুদাররেস। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণিতে তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশানে লেখাপড়া করেন। এরপর আলিয়া মাদ্রাসার এ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের পরে, তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এই সময় জহির রায়হান নোয়াখালির গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এই সময় তিনি কবিতা ও গল্প লেখা শুরু করেন। যতদূর জানা যায়, তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ছিল 'ওদের জানিয়ে দাও'।   ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সেখানকার আমিরাবাদ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এই সময় তিনি 'যুগের আলো' পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি লেখাপড়ার জন্য ঢাকা চলে আসেন এবং জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। ঢাকাতে আসার পর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের অনুপ্রেরণায় তিনি, ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বামপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় তিনি দলের গোপন তথ্য আদান-প্রদানের কাজ করতেন। এই সময় কমরেড মনি সিং তাঁর নাম দেন রায়হান। পরে তিনি জহির রায়হান নামে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা লংঘনের দশ জনের প্রথম দলে তিনি ছিলেন। এই সময় পুলিশ অন্যান্যদের সাথে তাঁকেও গ্রেফতার করে। এরপর তিনি কিছুদিন কারাভোগ করেন। কিছুদিন পর তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এবারে তিনি ৩ মাস কারাভোগ করেন। এবারে কারাগারে বসে তিনি রচনা করেছিলেন 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে।   এরপর তিনি কলকাতা প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফি স্কুল ভর্তি হন চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখাপড়ার জন্য । কিন্তু আর্থিক অসুবিধার কারণে তিনি ঢাকাতে ফিরে আসেন। সেখান থেকে ফিরে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জগন্নাথ কলেজে থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন এবং পাশ করেন। এরপর বাবার ইচ্ছায় তিনি ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে। কিন্তু এই বিভাগ তাঁর ভালো না লাগায়, তিনি ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে বিএ অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে একই সাথে ডাক্তারি পড়াও শুরু করেন। একই সাথে তিনি 'প্রবাহ' নামক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। এর ভিতরে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়।

ইতিমধ্যে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে উর্দু ছবির পরিচালক কারদার-এর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় আসেন তাঁর 'জাগো সাবেরা' ছবির শুটি`-এর জন্য। তিনি এই পরিচালকের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি সালাউদ্দিন ও এহতেশামের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এই সময়ে দুটি ছবি 'যে নদী মরু পথে' ও 'এ দেশ তোমার আমার' মুক্তি পায়। এই বৎসরেই ঢাকায় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাম রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  বিএ (অনার্স) পাশ করেন। এরপর কিছুদিন এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমএ পরীক্ষা দেন নি।
  ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি 'কখনো আসেনি' মুক্তি পায়। এরপর তিনি চলচ্চিত্র তৈরিতে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন।   ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চিত্র নায়িকা সুচন্দাকে বিয়ে করেন।   ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।   দেশ স্বাধীন হবার পর তার নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, বিজয় দিবসের পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর 'আল বদর বাহিনী' শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করেছিল। ১৭ই ডিসেম্বর জহির রায়হান কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি, জহির রায়হান শহীদুল্লাহ কায়সার সন্ধানে হাবিলদার হানিফের সাথে নিয়ে মীরপুর ১২ নম্বর সেকশানে যান। এরপর তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।  

জহির রায়হানের নির্মিত চলচিত্র

কখনো আসেনি (১৯৬১)।
সোনার কাজল (১৯৬২) (কলিম শরাফীর সঙ্গে যৌথভাবে)
কাঁচের দেয়াল(১৯৬৩)
সঙ্গম (১৯৬৪ তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বপ্রথম রঙিন চলচিত্র)
বাহানা (১৯৬৫)
বেহুলা (১৯৬৬)
আনোয়ারা (১৯৬৭)
দুইভাই (১৯৬৮)
জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
 Let There Be Light । (১৯৭০ অসমাপ্ত) এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১)।
লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত) ।

পত্রিকা সম্পাদনা
এক্সপ্রেস (ইংরেজি সাপ্তাহিক)।
প্রবাহ (বাংলা মাসিক)।

পুরস্কার :
১৯৬৪: 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসের জন্য 'আদমজী পুরস্কার লাভ'।
১৯৭১: সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ (১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষিত)
১৯৭৭: চলচ্চিত্র শিল্পে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ।
১৯৯২: সাহিত্যে কৃতিত্বের জন্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ।
সাহিত্যকর্ম
শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০)।
হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)।
আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)।
বরফ গলা নদী (১৯৬৯)।
আর কত দিন (১৯৭০)।

অন্যান্য রচনা
সূর্যগ্রহণ। প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১৩৬২ বাংলা।
তৃষ্ণা (১৯৬২)।
একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০)।
কয়েকটি মৃত্য।
সূত্র :
জহির রায়হান রচনাবলী প্রথম খণ্ড। আহম্মদ পাব্লিশিং হাউস। জুন ১৯৮৮।
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান প্রথম খণ্ড। সাহিত্য সংসদ। জানুয়ারি ২০০২।