১৮৮১-১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ
আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে মে (আনুমানিক), তুরস্কের আহমেদ সুবাশির আশেপাশে অথবা ইসলাহান সড়কস্থ
কোকা কাসিম পাশার নিকটে, একটি তুর্কিভাষী মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার নাম আলি রিজা এফেন্দি। এবং মায়ের নাম জুবায়দা হানিম। কামালা কারো কারো মতে তাঁর গণিতের শিক্ষক
গণিত শিক্ষক ক্যাপ্টেন উসুকুপলু মোস্তফা এফেন্দি, পূর্ণতা অর্থে তাঁকে কামাল নাম দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে,
তুরস্কের জাতীয়তাবাদী কবি নামিক কামালের নামের সাথে মিল রেখে তিনি এই নাম তিনি নিজেই এই নাম গ্রহণ করেছিলেন।
শৈশবে তাঁর মা তাঁকে ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পড়ানোর আগ্রহী হলেও তাঁর পিতা তাঁকে শেমসি এফেন্দি নামক একটি ধর্মনিরপেক্ষ
স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে পিতামাতা উভয়েরই ইচ্ছা ছিল তাঁকে ব্যবসায়ী বানানোর। একটি বড় হওয়ার পর, ১৮৯৩
খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেলোনিকা সামরিক বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। তবে তিনি এখানে ভর্তি হতে পারেন নি। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায়
চেষ্টা করে তিনি সেলোনিকা সামরিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানের পাঠ শেষ করে তিনি ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ,
উসমানীয় মিলিটারি একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের স্নাতক হন। এরপর কন্সটান্টিনোপলের উসমানীয় মিলিটারি কলেজে
ভর্তি হন এবং এখান থেকেও তিনি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
এরপর তিনি দামেস্কে পঞ্চম বাহিনীর আলি ফুয়াত ও লুতফু মুফিতের কোম্পানিতে স্টাফ ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান করেন।
এই সময় তিনি এলভানের নেতৃত্বাধীন সংস্কারবাদী কর্মকর্তাদের গোপন বিপ্লবী সংঘ ভাতান ভে হুরিয়াতে তিনি যোগ দেন।
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন তিনি সিনিয়র ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পান এবং
১৯০৭ এর ১৩ অক্টোবর মানাসতিরে তৃতীয় বাহিনীর সদর দপ্তরে দায়িত্ব লাভ করেন। এই সময়ে তিনি,
ইস্তামবুলের মেডিকেল ছাত্র ইবরাহিম টেমো, আবদুল্লাহ জেভদেত, ইশাক সুকুটি ও আলি হুসাইনজাদে কর্তৃক প্রতিষ্ঠিঁত
গোপন সংগঠন 'কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস'-এর সাথে ঘনিষ্ট যুক্ত হন। তবে কিছুদিন পর এই সংগঠনের প্রতি
বিরক্ত হয়ে এই সংগঠনের ঘোরতর বিরোধিতা করা শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তুরস্কের রাজনীতিতে আলোচিত ব্যক্তিতে
পরিণত হন।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জুন তিনি পূর্ব রুমেনিলায় উসমানীয় রেলওয়ের পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পান।
এই বছরের জুলাই মাসে সংঘটিত তরুণ তুর্কি বিপ্লবে তিনি অংশ নেন। এই বিপ্লবে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ক্ষমতা
হারান এবং তুরস্কে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র সূচনা হয়।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উসমানীয় প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃত আলবেনিয়ার পাঠানো হয়। এই সময়, ঈসা বোলেতিনির নেতৃত্বে
আলবেনিয়ায় জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান হয় এবং আলবেনিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে তিনি
কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইস্তাম্বুলে যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে স্বল্পকালের জন্য দায়িত্বপালন করেন।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইতালি ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে, ২৮ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে বেনগাজি, দেরনা ও তোবরাকের কাছে
যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, এই সময় ইতালি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল ১ লক্ষ ৫০ হাজার। এই স্বল সৈন্য নিয়েও কয়েকটি যুদ্ধে
ইতালিকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬-১৭ জানুয়ারি দেরনার যুদ্ধের সময় মোস্তফা কামাল যখন কাসর-ই হারুনের ইতালীদের নিয়ন্ত্রিত দুর্গ আক্রমণ
করেন। এই সময় ইতালির বিমান আক্রমণে তিনি চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সুস্থ হওয়ার পর,তিনি ৬ মার্চ তিনি পুনরায় দেরনায় উসমানীয়
বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেন। ১৮ই অক্টোবরে ইতালি-তুর্কি যুদ্ধের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত তিনি এই অঞ্চলের দখল বজায় রাখতে
সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সার্বিকভাবে তুরস্ক পরাজিত হয়েছিল। এই কারণে, ত্রিপোলিতানিয়া, ফেজ্জান ও সিরেনকা প্রদেশ ইতালির হস্তগত হয়।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শুরু হয় প্রথম বলকান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বলকান লীগ রাষ্ট্রসমূহ (বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রিস ও মন্টেনিগ্রো)
তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১লা ডিসেম্বর মোস্তফা কামাল গেলিপলিতে সদরদপ্তরের দায়িত্ব লাভ করেন
। এই সময় তিনি থ্রেসের উপকূলে বুলাইরে অবতরণে অংশ নেন। এই অভিযান ফেতহি বে পরিচালনা করেন।
কিন্তু বুলাইরের যুদ্ধের সময় স্টিলিয়ান কোভাচেভের বুলগেরিয়ার চতুর্থ বাহিনীর নেতৃত্বাধীন জর্জি টোডোরভের সপ্তম রিলা
ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হন। এই যুদ্ধে বলকান রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী স্বল্পসংখ্যক
এবং কৌশলগতভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকা অটোমান বাহিনীকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধের ফলে বলকান লীগ সদস্যরা
অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত প্রায় সকল অঞ্চল দখল ও ভাগাভাগি করে নেয়।
এই ঘটনাবলির পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে বলকানে স্বাধীন আলবেনিয়া রাষ্ট্রেরও সৃষ্টি হয়।
তবে যুদ্ধে সাফল্য সত্ত্বেও বুলগেরিয়া মেসিডোনিয়ায় লব্ধ অংশ নিয়ে ক্ষুদ্ধ হয়, এবং এর ফলে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ শুরু হয়।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আর শেষ হয়েছিল ১০ই আগষ্ট। এই যুদ্ধে বুলগেরিয়া একাকী সার্বিয়া, গ্রিস, মন্টেনিগ্রো,
অটোমান সাম্রাজ্য ও রুমানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে মোস্তফা কামাল
বলকানের উসমানীয় সামরিক এটাচে হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই সময় তাঁর কার্যালয় ছিল বুলগেরিয়ার সফিয়ায়।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ কায়মাকাম (লেফটেন্যান্ট কর্নেল/কর্নেল) হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অটোমান সাম্রাজ্য অংশগ্রহণ করে।
এই যুদ্ধে মোস্তফা কামাল পঞ্চম বাহিনীর সাথে সংযুক্ত হন এবং ১৯তম ডিভিশনের পুনর্গঠন ও নেতৃত্বদানের দায়িত লাভ করেন।
এই যুদ্ধে তিনি কুশলতার পরিচয় দেন এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার হয়ে উঠেন।
গেলিপলির যুদ্ধের পর মোস্তফা কামাল এডির্নে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেন।
এরপর তিনি দ্বিতীয় বাহিনীর ১৬তম কোর্পসের নেতৃত্ব লাভ করেন এবং
আনাতোলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলতে রাশিয়ানদের ব্যাপক হামলা শুরু হলে,
৭ই আগস্ট মোস্তফা কামাল তার সৈনিকদের নিয়ে পাল্টা আঘাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
তিনি তাঁর দুটি ডিভিশন সৈন্য নিয়ে বিতলিস ও মুশ অধিকার করেন। এই বিজয়ের পর
কন্সটান্টিনোপলের কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস সরকার, হেজাজে একটি নতুন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে
এবং মোস্তফা কামালকে এর নেতৃত্বদানের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে
এই সেনাবাহিনী আর প্রতিষ্ঠা হয়নি।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ মোস্তফা কামাল ১৬তম কোর্পসের দায়িত্ব থেকে পদোন্নতি পেয়ে
পুরো দ্বিতীয় বাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ব পান। এই সময় রুশ বিপ্লব আরম্ভ হওয়ায় রাশিয়ার
জারের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে জার্মান জেনারেল এরিক ভন ফাল্কেনহাইনের অধীনে ইল্ডিরিম আর্মি গ্রুপে কর্মরত ফেভজি পাশার স্থলে
মোস্তফা কামাল সপ্তম বাহিনীর নেতৃত্বভার লাভ করেন। কিন্তু তিনি এবং ইসমত বে যৌথভাবে উজিরে আজম তালাত পাশার কাছে
চিঠিতে ফিলিস্তিন রণাঙ্গনের দুরবস্থা ও পর্যাপ্ত রসদের অভাবের কথা জানান। তালাত পাশা তাঁদেরকে তুর্কিদের মাধ্যমে
উত্তরে উসমানীয় সিরিয়ায় আরো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। এরপর
মোস্তফা কামাল সপ্তম বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন ও কন্সটান্টিনোপলে ফিরে যান।
এখানে এসে তিনি যুবরাজ ও ভবিষ্যত সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদের অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে রেলভ্রমণের সময় তার সহচরের দায়িত্ব পান।
জার্মানিতে অবস্থানকালে মোস্তফা কামাল পশ্চিম ইউরোপীয় রণাঙ্গনে জার্মান অবস্থানগুলো পরিদর্শন করে বুঝতে পারেন যে,
অক্ষশক্তি খুব শীঘ্রই যুদ্ধে পরাজিত হবে। একথা তিনি খোলাখুলিভাবে কাইজার দ্বিতীয় উইলহাম এবং তার অন্যান্য উচ্চপদস্থ
সেনানায়কদের কাছে উপস্থাপন করেন। এই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়রলে কার্লসবাদ ও ভিয়েনায় চিকিৎসার জন্য সাময়িকভাবে
অবস্থান করেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে সুলতান হন। এই সময় তিনি মোস্তফা কামাল পাশাকে
কন্সটান্টিনোপলে ডেকে পাঠান এবং আগস্টে তাকে ফিলিস্তিনে সপ্তম বাহিনীকে
নেতৃত্বদানের জন্য নিয়োগ করেন। মোস্তফা কামাল ২৬শে আগস্ট আলেপ্পোয় পৌছান এবং
নাবলুসে তার সদরদপ্তরে কাজ শুরু করেন। ১৯শে সেপ্টেম্বর মেগিড্ডোর যুদ্ধের
প্রাক্কালে অষ্টম বাহিনী উপকূলীয় অঞ্চলের দখল ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তারা ব্যর্থ
হলে লিমান পাশা সপ্তম বাহিনিকে উত্তর থেকে সরে জর্ডান নদীতে ব্রিটিশদের অগ্রগতিকে
বাধাদানের আদেশ দেন। সপ্তম বাহিনী জর্ডান নদীর দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু ২১শে
সেপ্টেম্বর নাবলুস থেকে পিছু হটার সময় ব্রিটিশদের বোমাবর্ষণের ফলে তারা পর্যুদস্ত
হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর মাদরুসের যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং উসমানীয়
সাম্রাজ্যে অবস্থানরত সকল জার্মান এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সৈন্যবহরকে অবস্থান
ত্যাগের জন্য সময় দেয়া হয়। ৩১শে অক্টোবর মোস্তফা কামাল লিমান ভন স্যান্ডার্সের
স্থলে ইল্ডিরিম আর্মি গ্রুপের নেতৃত্বদানের দায়িত্ব পান। তিনি মিত্রশক্তির হামলার
প্রতিহত করার জন্য এন্টিপের বেসামরিক জনগণকে অস্ত্রসজ্জিত করেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরের মাসের দিকে ইল্ডিরিম আর্মি
গ্রুপ দাপ্তরিকভাবে অবলুপ্ত হয়ে যায়। ১৩ই নভেম্বর
মোস্তফা কামাল অধিকৃত কন্সটান্টিনোপলে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধ
মন্ত্রণালয়ের সদরদপ্তরে কাজ করেন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল কামাল
পাশাকে নবম বাহিনীর পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। এই সময়
উসমানীয় সামরিক ইউনিটগুলোর আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
১৯১৯ সালের ১৬শে মে পর্যন্ত তিনি
এই কাজের সম্পৃক্ত থাকেন। ইতিমধ্যে মিত্রশক্তি
আনাতোলিয়া অধিকার করে নেয়। এরপর মিত্রশক্তি
কন্সটান্টিনোপল অধিকার করে নিলে তুরস্কের জাতীয়
আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা ও তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়।
১৯শে মে কামাল পাশা সামসুনে পৌছেন। তার প্রথম লক্ষ্য ছিল দখলদার বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে একটি জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করা।
জুন মাসে তিনি আমসইয়া ঘোষণার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন বলে ঘোষণা করেন।
৮ই জুলাই তিনি উসমানীয় সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে উসমানীয় সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে
এবং বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে উসমানীয় সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এতে মোস্তফা কামালের নেতৃত্বাধীন 'অ্যাসোসিয়েশন ফর ডিফেন্স অব রাইট ফর আনাতোলিয়া এন্ড রুমেলিয়া'
সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ সময় তিনি আঙ্কারায় অবস্থান করছিলেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি কন্সটান্টিনোপলে সংসদের চতুর্থ ও শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
মিসাক-ই মিল্লি (“জাতীয় চুক্তি”) ঘোষণার কিছুদিন পর ১৮ মার্চ ব্রিটিশরা এটিকে ভেঙে দেয়।
আঙ্কারায় নতুন তুর্কি সংসদ “গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি” (জিএনএ) প্রতিষ্ঠার জন্য মোস্তফা কামাল জাতীয় নির্বাচনের ডাক দেন।
২৩শে এপ্রিল মোস্তফা কামালকে স্পিকার করে এর কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এর ফলে রাষ্ট্রে দ্বৈত শাসনের সূচনা হয়।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০শে আগস্ট উজিরে আজম দামাত ফেরিদ পাশা সেভরে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
এর ফলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভক্তি চূড়ান্ত হয়। মোস্তফা কামাল তুর্কি জাতির স্বার্থে ও দেশের স্বাধীনতার জন্য এর প্রতিবাদ করেন।
এই সময় তিনি একটি জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য তিনি জিএনএ এর প্রতি আহ্বান জানান।
জিএনএ এর বাহিনী মিত্রশক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা খলিফার বাহিনীর মুখোমুখি হয়।
পূর্ব রণাঙ্গনে আর্মেনিয়ান বাহিনী এবং স্মারনা (আধুনিক ইজমির) থেকে পূর্বদিকে ধাবমান গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে
লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। গ্রিকরা ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে স্মারনা দখল করে।
জিএনএ'র সামরিক বাহিনী আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের হেমন্তকালে বিজয় লাভ করে।
পরবর্তী সময়ে গ্রীকদের বিরুদ্ধেও তারা বিজয়ী হয়।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের হেমন্তকাল থেকে রাশিয়ার বলশেভিক সরকার কর্তৃক কামালের লোকদেরকে
স্বর্ণ ও যুদ্ধোপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্য করে।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট জিএনএ মোস্তফা কামালকে প্রধান সেনানায়ক হিসেবে নিযুক্ত করে।
২৩শে আগস্ট সাকারইয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং গ্রীকরা এতে পরাজিত হয়।
এই বিজয়ের পর ১৯শে সেপ্টেম্বর গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি মোস্তফা কামালকে মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া
ও গাজি উপাধিতে ভূষিত করে।
কামালের সাফল্য সত্ত্বেও মিত্রশক্তি সেভরে চুক্তির কিছুটা পরিবর্তিত রূপে উত্থাপন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে আগস্টে কামাল গ্রিকদের উপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেন।
৯ই সেপ্টেম্বর তুর্কিরা স্মারনার অধিকার লাভ করে। ১০ই সেপ্টেম্বর মোস্তফা কামাল গণহত্যার জন্য
আঙ্কারা সরকার দায়ী থাকবে না বলে লিগ অব ন্যাশনসে টেলিগ্রাম পাঠান।
২১ নভেম্বর লোজান সম্মেলন শুরু হয়।
এতে তুরস্কের প্রতিনিধি ইসমত ইনানো তুরস্কের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জুলাই জিএনএকে তুরস্কের সরকার হিসেবে স্বীকার করে লোজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২৯শে অক্টোবর তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফত
বিলুপ্ত হয় এবং খিলাফতের ক্ষমতা জিএনএ'র এর আওতাভুক্ত করা হয়।
খিলাফতের অবলুপ্তির পর সরকার ও ধর্মীয় কাজের মধ্যে পৃথকীকরণ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে
শিক্ষাকে মূল হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে মুসলিম জাতিগুলো তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়।
এই সময় তুরস্কের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য
আমেরিকান শিক্ষা সংস্কারক জন ডেওয়েকে আঙ্কারায় আমন্ত্রণ জানান।
নতুন আইনের অধীনে শিক্ষাকে অধিকমাত্রায় বিস্তৃত করা হয়। এই নতুন
প্রক্রিয়ায় বিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠ্যক্রম জাতীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
একই সময় ধর্মীয় বিষয়গুলোকে সরকারের ধর্মীয় বিভাগের আওতাধীনে আনা হয়।
শিক্ষাব্যবস্থার একীভূতকরণের পরও তুরস্ক ধর্মীয় বিদ্যালয় চালু ছিল। এগুলো
উচ্চশিক্ষার দিকে অগ্রসর হয়।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ধনী কুর্দি গোত্রীয়
নেতা শেখ সাঈদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ সংগঠিত
হয়। শেখ সাঈদ ছিলেন একজন ব্যক্তি।
তিনি নকশবন্দি তরিকার নেতা ছিলেন। তিনি খিলাফতের বিলুপ্তির প্রতিবাদের সাথে
পাশ্চাত্য ধাচের নাগরিক আইন, ধর্মীয় রীতির অবলোপন, বহুবিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা ও
সিভিল ম্যারেজ রীতিরও প্রতিবাদ করেন।
এই দল ইসলামী আইনের পুনপ্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তার বাহিনী দেশময়
ছড়িয়ে পড়ে, সরকারের কার্যালয়গুলো অবরোধ করে ও এলাজিগ ও দিয়ারবাকিরের
গুরুত্বপূর্ণ শহরের অভিমুখে যাত্রা করে। সরকারের সদস্যরা শেখ সাঈদের বিদ্রোহকে
পাল্টা বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিদ্রোহকে দমন করার জন্য ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ
আইন পাশ হয়। এই আইনের ফলে সরকার ব্যতিক্রমী ক্ষমতা লাভ করে সেই সাথে ধ্বংসাত্মক
গ্রুপগুলো দমন করা কর্তৃত্ব লাভ করে।
১৯২৪ সালের ১৭ অক্টোবর কাজিম কারাবেকির তার বন্ধুদের নিয়ে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন।
এই দল নিন্দা সংসদে নিন্দা প্রস্তাব
উত্থাপন করে। ৮ নভেম্বর আস্থা ভোটের
মাধ্যমে এই নিন্দা-প্রস্তাব
প্রত্যাখ্যিত হয়। এরপর ১৭
নভেম্বর দলত্যাগীরা প্রগ্রেসিভ রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন। এর ফলে বহুদলীয়
ব্যবস্থা চালু হয়। পিআরপি এর অর্থনৈতিক কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের বদলে
ব্যক্তি উদ্যোগকে সমর্থন করে।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে মোস্তফা কামাল তুর্কিদেরকে
আধুনিক ইউরোপীয় পোষাক পড়তে উৎসাহ দেন। মোস্তফা কামাল
সর্বপ্রথম সরকারি চাকুরেদের জন্য হ্যাটকে বাধ্যতামূলক করেন। তার জীবদ্দশায়
শিক্ষার্থী ও সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য পোশাক বিধিমালা প্রণীত হয়।
সরকারি চাকরিজীবিদের অনেকেই হ্যাটকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে।
মোস্তফা কামাল নারীদের জন্য আধুনিক পোষাককে উৎসাহিত করলেও নারীদের
পোশাক কেমন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে তিনি মত দেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীরা
তাদের নিজস্ব পোষাকের ধরন বেছে নিতে পারবে।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ ইতালীয় দণ্ডবিধির
উপর ভিত্তি করে গঠিত তুরস্কের দণ্ডবিধি পাস হয়।
মে মাসে কায়রোতে 'খিলাফত সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। খিলাফতকে “ইসলামের জন্য অত্যাবশ্যকীয়” ঘোষণা করা হয়।
তবে এই ঘোষণা বাস্তব প্রয়োগের মুখ দেখেনি। এই বছরে
ইজমিরে মোস্তফা কামালকে হত্যা করার পরিকল্পনা ফাস হয়। খিলাফতের বিলুপ্তির বিপক্ষে
অবস্থানকারী একজন প্রাক্তন সাংসদ এর সূত্রপাত করেন। তদন্তের ফলে কারাবেকিরসহ অনেক
রাজনৈতিক কর্মীকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। চাভিদ, আহমেদ শুকরু ও ইসমাইল
কানবুলাতসহ কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা যারা তুর্কি বিপ্লবে
দ্বিতীয় সারিতে ছিলেন, দোষী সাব্যস্ত হন। তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
পিআরপি ও শেখ সাঈদের বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে যোগসাজোশ তদন্তে বের হয়ে আসে।
বিচারের ফলে পিআরপিকে বিলুপ্ত করা হয়। এর ফলে
নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীতার ধারা ভেঙে পড়ে।
৪ অক্টোবর তুরস্কে ইসলামী আদালতগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়
এবং তুরস্কের সিভিল কোড পাশ হয়। সুইস সিভিল কোডের উপর ভিত্তি করে এটি
প্রণীত হয়। নতুন আইনের অধীনে নারীরা উত্তরাধীকার ও তালাকের মত ব্যাপারে পুরুষের
সমান হিসেবে গণ্য হয়।
১৯২৬ ও ১৯৩১ সালে যথাক্রমে মক্কা ও জেরুজালেমে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু এগুলো কোনো সিদ্ধান্তে পৌছতে ব্যর্থ হয়।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে স্টেট আর্ট এন্ড স্কাল্পচার মিউজিয়াম
প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদিন ধরে তুরস্কে ইসলামী আদর্শের সাথে মিল রেখে ভাস্কর্যের চর্চা
খুবই কম ছিল। কামাল বিশ্বাস করতেন যে সংস্কৃতি হচ্ছে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি।
প্রাক-ইসলামী যুগের তুর্কি সংস্কৃতি গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে।
সেলজুক ও উসমানীয় সভ্যতার পূর্বের তুর্কি সংস্কৃতির উপর জোর দেয়া হয়।
লোকসংস্কৃতির উপরও জোর দেয়া হয়।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মোস্তফা কামাল সমগ্র তুরস্ক থেকে আসা
বেশ কয়েকজন ভাষাবিদ ও অধ্যাপকের সাথে আঙ্কারায় বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে তিনি তুর্কি
ভাষা লেখার জন্য ল্যাটিন বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে নতুন বর্ণমালা গঠনের বিষয়টি
উত্থাপিত করেন। এই নতুন বর্ণমালা তুরস্কের স্বাক্ষরতা সমস্যা সমাধানকল্পে পূর্বে
ব্যবহৃত আরবি বর্ণমালার স্থলে ব্যবহারের কথা বলা হয়। ১লা
নভেম্বর নতুন তুর্কি বর্ণমালা চালু ও আরবি বর্ণমালার ব্যবহার বিলুপ্ত করা হয়।
এসময় জনগণে ১০ শতাংশ শিক্ষিত ছিল। ১৫ ডিসেম্বর নতুন বর্ণমালা ব্যবহার করে
তুরস্কে সর্বপ্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নাগরিকদেরকে নতুন পন্থা শিক্ষাদানের জন্য
কামাল নিজে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই
আগস্ট মোস্তফা কামাল বহুদলীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। এ
উদ্দেশ্যে তিনি আলি ফেতহি ওকয়েরকে নতুন দল গঠন করতে বলেন। নবগঠিত লিবারেল
রিপাবলিকান পার্টি দেশজুড়ে সাফল্য লাভ করে। তবে এবারেও এটি আতাতুর্কের সংস্কারের
বিরুদ্ধাচারীদের কেন্দ্র হয়ে উঠে, বিশেষত ব্যক্তিজীবনে ধর্মের অবস্থানকে কেন্দ্র
করে। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি সহিংস ঘটনা সংঘটিত
হয়। মেনেমেন শহরে ইসলামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী এর সূচনা করে। ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারের
প্রতি একে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে ১৯৩০
খ্রিষ্টাব্দে নভেম্বরে আলি ফেতহি ওকয়ের তার দলকে
বিলুপ্ত করেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে
দেশজুড়ে পিপলস হাউস খোলা হয় যাতে ৪ থেকে ৪০ বছরের মধ্যের মানুষেরা নতুন বর্ণমালা
শিখতে পারে। কপিরাইট, গণশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক প্রকাশনীর উপর সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাক্ষরতা সংস্কারের জন্য নতুন কপিরাইট আইনে ব্যক্তিগত উদোগে প্রকাশনীকে সাহায্য
করা হয়। মোস্তফা কামাল প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন করেন।
তিনি বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তুর্কি নারীদেরকে সন্তান প্রতিপালন,
পোষাক তৈরী ও গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি ঘরের বাইরে কাজে অংশ নেয়ার জন্যও শিক্ষা
দেয়া হয়। শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্র কর্তৃক তত্ত্বাবধান করা হয়।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারকাজ চালিয়ে যান।
এর মাধ্যমে তিনি তুরস্ককে আধুনিক, গণতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিতে পরিণত করেন।
এই বছরের ১৯শে মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।