বাংলাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী,
সংস্কৃতসেবী।
পুরো নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। কলিম শরাফী নামে সর্বাধিক পরিচিত
ছিলেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউড়ী মহকুমার খয়রাডিহি
গ্রামে, নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মা আলিয়া বেগম শিল্পীর শৈশবেই মারা যান। এই কারণে
কলিম শরাফীর পুরো ছেলেবেলাই কাটান নানাবাড়িতে। খয়রাডিহি গ্রামে সারা বছর জুড়েই
বিভিন্ন উৎসব হতো। এসব উৎসবের সূত্রে ইনি লেটোর গান, ঝুমুর গান, আলকাফ্, মর্সিয়া
কীর্তন ইত্যাদি লোক-সঙ্গীতের সাথে পরিচিত হন।
তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আরবি ওস্তাদজী আর বাংলা পণ্ডিত
মশাইয়ের হাতে। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁতীপাড়া পাঠশালায় ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে আসেন কোলকাতায়,
বাবার কাছে। এখানে এসে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে (ক্যালকাটা
মাদ্রাস) ভর্তি হন। এরপর তিনি অ্যাংলো পার্শিয়ান বিভাগে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
এই স্কুলে তিনি সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন শহীদুল্লা কায়সারকে। কলিম শরাফী যখন দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী,
তখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু 'হলওয়েল মনুমেন্ট' অপসারণের আন্দোলন শুরু করেন।
নেতাজীর ডাকে তরুণ বাঙালি ছাত্রসমাজের সঙ্গে তিনিও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
একবার এক মিছিলে হঠাৎ করেই পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও আহত
হন। এসময় তাঁর এবং বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রউফ ভাইয়ের। এই 'রউফ
ভাই'-ই পাড়ে এঁদের রাজনীতির শিক্ষাগুরু হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কোলকাতায়
বোমা বর্ষণ শুরু হলে তিনি বীরভূমে ফিরে যান এবং সেখান থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে
তিনি পাশ করেন।
পরীক্ষার পরই তিনি গান্ধীজীর ব্রিটিশবিরোধী 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত
হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের
আগষ্ট মাসে তিনি 'ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট'-এর আওতায় গ্রেফতার। গ্রেফতারের পর
তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় শিউড়ি জেলে। উল্লেখ্য অন্যসব
আন্দোলনকারীর মধ্যে ঐ জেলে তখন একমাত্র মুসলমান রাজবন্দী ছিলেন তিনি। জেলে সঙ্গী
হিসেবে পান বীরভূম জেলার কংগ্রেস নেতা কামদা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতি রাণী চন্দ, শ্রীমতি নন্দিতা কৃপালিনী (বুড়িদি),
চিত্রশিল্পী সুহাস দে, মহারাষ্ট্রের দীনুকর কৌশিক, কুমিল্লার অভয় আশ্রমের হেনাদি, কবিরাজ
নৃসিংহ সেন, আনন্দ গোপাল সেনগুপ্ত, প্রণব গুহঠাকুরতা প্রমুখ। জেলে দীনুকর কৌশিক, আনন্দ
গোপাল সেনগুপ্ত, প্রণব গুহঠাকুরতার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। প্রণব গুহ
জেলে সব সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতেন কলিম শরাফীও। এখান
থেকেই মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে উঠেন। ১১ মাস পর তিনি জেল
থেকে মুক্তি পান। কারামুক্তির পর
প্রণব গুহঠাকুরতা তাঁকে ভর্তির উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান। কিন্তু রাজনৈতিক
জীবনের পটভূমির কারণে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হতে পারেন নি।
এরপর তিনি বীরভূম জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব নেন।
এরই মধ্যে দেশজুড়ে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ (পঞ্চাশের মন্বন্তর)।
এই সময় দল বেঁধে গান গেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষজনের জন্য
অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করা শুরু করেন। পরে সংগৃহীত অর্থ ও চাল দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন
লঙ্গরখানা চালু করলে, তিনি লঙ্গরখানায় খাদ্য বিতরণে
আত্মনিয়োগ করলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি তখন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। অক্লান্ত
পরিশ্রমের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পরলে, পার্টির পক্ষ থেকে নিয়মানুযায়ী তাঁকে দার্জিলিংয়ের কালিম্পং- এ
পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কালিম্পংয়ে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জনক
কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। আর সবার মতো মুজফ্ফর আহমদকে তিনি 'কাকা বাবু'
ডাকতেন।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি ভর্তি হন হেতমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। পরে তিনি ভর্তি হন
ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে। অর্থনৈতিক কারণে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলেন না। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে
তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন ( আইপিটিএ)-তে দেন। এর বাংলা নাম ছিল
গণনাট্য সংঘ। মূলত দেশের মানুষকে রাজনীতি-সচেতন করার জন্য এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক
সংগঠন। পরে সংগঠনের কার্যক্রম সারাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সংগঠনে তিনি
গান শেখেন এবং একই সাথে গান পরিবেশনেওই করতেন। গণনাট্য সংঘের ব্যানারে তাঁরা
দেশাত্মবোধক ও সাম্রাজ্যবিরোধী গান ও পুরনো দিনের গানের চর্চা হতো। একই সাথে
তিনি উদ্দীপনামূলক নাটকেও অংশগ্রহণ করতেন। পরে আইপিটিএ-র সঙ্গীত বিভাগের দায়িত্ব নেন সলিল চৌধুরী ও কলিম
শরাফী।
তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও স্বদেশী গান শিখেছিলেন মূলত শুভ গুহঠাকুরতা, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর কাছ থেকে।
অন্যদিকে আইপিটিএ-র গণনাট্য
আন্দোলনের সূত্রে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, অভিনেতা-পরিচালক শম্ভু
মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মুলুকরাজ আনন্দ, খাজা আহমদ আব্বাস, রবিশঙ্কর, শান্তিবর্ধন,
বুলবুল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত
বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। এই সময়
গণমুখী গান আর ছায়ানাট্য 'শহীদের ডাক' নিয়ে তখন ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলা ও আসাম অঞ্চল।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আবার সিটি কলেজের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এসময় তিনি শম্ভু মিত্র ও সুধী প্রধানদের
সঙ্গে উত্তর কোলকাতার 'কমিউন'-এ থাকতেন। এবছরই শুরু হলো ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা শুরু হলে, আইপিটিএ-র সদস্য হিসেবে জনাব শরাফী 'বর্ডার গার্ড'-এর দায়িত্ব
পালন করেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করতে থাকেন মহল্লায়-মহল্লায়।
দাঙ্গার প্রথম দিকে তিনি আশ্রয় নেন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। পার্ক সার্কাস এলাকা
ছিল মুসলিমপ্রধান। এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়েকে যেন দাঙ্গা স্পর্শ করতে না পারে,
সেজন্য তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পার্ক
সার্কাসের পামপ্লেসে বসবাসরত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক কেপি
চট্টোপাধ্যায়-এর বাসা পাহারা দিতেন।
এ বছরই গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে বের হয় তাঁর প্রথম গণসঙ্গীতের একটি
রেকর্ড। এ সময় নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কোলকাতা বেতারে। পার্ক সার্কাসের এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে তড়িৎ চৌধুরী
মুগ্ধ হন এবং তিনি কলিম শরাফীকে সঙ্গীতগুরু শুভ গুহঠাকুরতার কাছে নিয়ে যান।
তখন 'দক্ষিণী' নামে শুভ গুহঠাকুরতার রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার একটি প্রতিষ্ঠান
ছিল। তিনি দক্ষিণী'তে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন। এই সময় তিনি সকালে দক্ষিণী
আর বিকেলে গণনাট্য সংঘে যেতেন। একসময় তিনি দক্ষিণীতে
শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরে এখানেই পরিচয় ঘটেছিল সঙ্গীতগুরু দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত
মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রকে। এঁরা সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত, গণসঙ্গীত, আধুনিক- সব
ধরনের গানই গাইতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে কলিম শরাফী তখন পেলেন বিশেষ অনুপ্রেরণা।
এসময় কলকাতার প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং গণজাগরণের গান গাওয়ার দরুন
স্থানীয় প্রশাসন তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতো।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের
পর কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে কর্মহীন হয়ে পড়েন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নীতিগত বিরোধের কারণে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র,
তৃপ্তি মিত্র, অশোক মজুমদার, মোহাম্মদ ইসরাইল, কলিম শরাফী প্রমুখ আইপিটিএ থেকে
বেরিয়ে এসে গঠন করেন নাট্যসংস্থা 'বহুরূপী' এই বৎসরেরই তাঁকে আবার গ্রেফতার করা
হয়।পরে অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
কামেলা
খাতুনকে বিয়ে করেন। মুসলমান
হওয়ার কারণে, তিনি কলকাতায় একটি অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। এর পরের বছর
অর্থাৎ ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করে
তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী কামেলা খাতুন ও একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়।
ঢাকায় এসেই ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন রেডিওতে।
এরই মধ্যে তিনি কবি সুকান্ত
ভট্টাচার্যের 'অবাক পৃথিবী' গানটি গেয়ে পাকিস্তান গোয়েন্দা দফতরের সন্দেহের চোখে
পড়েন। এ পরিস্থিতিতে তাঁর ঢাকায় বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অবশ্য কোলকাতায় থাকতে
প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং গণজাগরণের গান গাওয়ার ফলে প্রশাসন যে
তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতো, তা যেন ঢাকায় এসেও তাঁকে তাড়া করে। এতকিছুর পরও কিন্তু
কলিম শরাফীর গান কখনো থেমে থাকেনি।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে
চলে যান।
তারপর গেট্জ ব্রাদার্স নামে একটি আমেরিকান কোম্পানিতে চাকুরিতে যোগ দেন।
চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন 'প্রান্তিক' নামে
একটি সংগঠন। মূলত পূর্ববাংলায় তিনি নবনাট্য আন্দোলনের প্রথম প্রতিনিধি। প্রান্তিকে
সহযোদ্ধা হিসেবে পেলেন তরুণ সংগঠক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, মাহবুব হাসান, কাজী আলী
ইমাম, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, রমেন মজুমদার, অচিন্ত্য চক্রবর্তী, এমএ সামাদ, ফওজিয়া
সামাদ, নিত্যগোপাল দত্ত প্রমুখকে। তারপর ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য
ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন দু'বাংলার প্রথিতযশা
শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ। সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল। আর
যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কথাশিল্পী শওকত ওসমান ও সায়ীদুল হাসান।
সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল শহরের হরিখোলার মাঠে। এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসে আলো
ছড়িয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র।
শিল্পী-সংগঠক কলিম শরাফীর 'প্রান্তিক'ও এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে জয় করে নেয়
দর্শক-শ্রোতার অকুণ্ঠ ভালবাসা।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন। এ সম্মেলনে মাহবুব
উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলনটি
অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার কার্জন হলে। কলিম শরাফীর প্রান্তিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে
নাচ-গান ও 'বিভাব' নাটকের এক ব্যাপক আয়োজন নিয়ে। প্রান্তিকের এ আয়োজন সেবার অর্জন
করে বিশেষ খ্যাতি।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শেরে বাংলার মন্ত্রিসভাকে বাজেয়াপ্ত করে সেকশন নাইনটি টু জারি
করা হয়। এই সময় তিনি আত্মগোপন করেন এবং বছরের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। তারপর
'হ-য-ব-র-ল' নামে গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। এ সংগঠনের ব্যানারেই মঞ্চস্থ হয় 'তাসের
দেশ' নাটকটি। সে সময় তাঁর সহযোগী ছিলেন ড. আনিসুর রহমান ও ড. রফিকুল ইসলাম।
১৯৫৭
খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানে নির্মিত 'আকাশ আর মাটি' নামক চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের
'দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে' গানটির দু'লাইনে কণ্ঠ দেন। এই বৎসরে স্ত্রী কামেলা খাতুনের সঙ্গে
তাঁর বিবাহ
বিচ্ছেদ ঘটে।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হলে, রেডিওতে তাঁর গান সম্প্রচার
নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন না
হওয়া পর্যন্ত ঐ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরিচালনা করেন 'সোনার কাজল' নামক একটি চলচ্চিত্র। এই ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন জহির রায়হান। এসময় কলিম শরাফীর সঙ্গীত পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র 'ভেনিস' আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। তারপর 'সূর্যস্নান' ছবিতে 'পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে' গানটি গেয়ে তিনি শ্রোতামহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এছাড়া কবিয়াল রমেশ শীলের জীবন নিয়ে একটি তথ্য চিত্রও নির্মাণ করেন কলিম শরাফী।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ডকুমেন্টরি ফিল্ম তৈরি
করা শুরু করেন। শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার তাঁর তৈরি পাপেট যুক্ত করেছিলেন এবং শিল্পী মনোয়ার তাঁর পাপেট
নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে 'মেঘ ভাঙ্গা
রোদ' ছবিতে তিনি কণ্ঠ দেন 'রংধনু রংঙে আঁকা' গানে। একই বছরে তাঁর দুটি
গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। গান দুটি হলো- 'কুহেলী রাত মায়া ছড়ায়' এবং 'আজ হলো
শনিবার'। এসময় কোলকাতায় অনুষ্ঠিত 'রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলনে'ও তিনি যোগ দেন। এবছর
নাওশাবাকে বিয়ে করেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রথম টিভি সেন্টার চালু হলে- তিনি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর
হিসাবে যোগদান করেন। কিন্তু
বেশি বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করা হচ্ছে এমন অভোযোগ উঠায় এবং নানাবিধ ষড়যন্ত্রের
কারণে তিনি এই চাকরি ত্যাগ করেন এবং ঢাকাস্থ এইচএমভি'র তিনি প্রতিনিধি হিসাবে
কাজ করা শুরু করেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় এবং তখন
পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এসময় তিনি জাপানে প্রশিক্ষণের সুযোগ
পান। কিন্তু সরকারি রোষানলে পড়ে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হলে জাপান যাওয়া বন্ধ হয়ে
যায়।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কলিম শরাফী ইএমআই নামে ব্রিটিশ গ্রামোফোন রেকর্ডিং কোম্পানিতে যোগাদন করেন। প্রথমে ছিলেন ম্যানেজার ইস্ট পাকিস্তান'। পরে এ কোম্পানিতে জেনারেল ম্যানেজার এবং আরও পরে ডিরেক্টর এন্ড জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পান।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উদীচীর সাথে
সম্পৃক্ত হন। এই বৎসরে তিনি পাকিস্তান গ্রামোফোন কোং লিঃ -তে পরিচালক ও জেনারেল
ম্যানেজার হিসাবে যোগদান করেন। এই বৎসরে ঢাকা থেকে সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন,
আফসারী খানম, রাখী চক্রবর্তীকে নিয়ে তিনি করাচিতে যান । তারপর গ্রামোফোন কোম্পানি
এইচএমভি থেকে এঁদের রেকর্ড বের করার ব্যবস্থা করেন। এই সময় তিনি তাঁর রেকর্ড উন্মোচন করান
বঙ্গবন্ধুকে
দিয়ে। এই
কারণে পাকিস্তান সরকারের বিরাগভাজন হন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লন্ডনে অবস্থান
ছিলেন। পরে এখানে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে তোলেন জনমত। গান গেয়ে, বিভিন্ন
সভা-সমিতিতে অংশ নিয়ে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনি লন্ডন থেকে পাড়ি
জমান আমেরিকায়। সেখানেও তিনি এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। অতঃপর দেশ স্বাধীন হলে
কলিম শরাফী দেশে ফেরেন।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিল্পকলা পরিষদের উপদেষ্টা সদস্য পদ লাভ করেন। দেশ স্বাধীন
হবার পর থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ
কর্পোরেশনে। এখানে তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা ও জেনারেল ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের একুশে
ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে গঠিত একুশে উদযাপন কমিটিতে তাঁর নাম রয়েছে এমন খবর পত্রপত্রিকায়
প্রকাশিত হলে একঘণ্টার নোটিশে তাঁকে বরখাস্ত করা হয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল
ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন থেকে।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় 'জাহিদুর রহিম
স্মৃতি পরিষদ'। শিল্পী শরাফী উক্ত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক। পরবর্তী সময়
'জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ'ই রূপান্তরিত হয় 'জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন
পরিষদ'-এ। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে অর্থাৎ ১৩৯০
বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ 'সঙ্গীত ভবন' নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন
করছেন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেতার-টিভি শিল্পী সংসদ-এর কার্যকরী পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত
হন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির গণসমাবেশে অংশগ্রহণ
করায় দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁকেও আসামী করা হয়।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর দুপুরে ঢাকার বারিধারার বাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এই দীর্ঘ জীবনে মাত্র ৫টি গানের ক্যাসেট/অ্যালবাম বেরিয়েছে বরেণ্য শিল্পী কলিম
শরাফীর। শিরোনামগুলো হলো- এই কথাটি মনে রেখো; আমি যখন তার দুয়ারে; কলিম শরাফীর যত
গান; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা ও সুরে নবজীবনের গান।
কলিম শরাফীর পরিবার:
প্রথম স্ত্রী কামেলা খাতুন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এই স্ত্রীর
গর্ভজাত সন্তানের নাম- আলেয়া শরাফী। কানাডায় দোভাষীর কাজ করেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী : নাওশাবা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজিতে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। পুত্র আজিজ শরাফী। ক্যানসাসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টসের প্রফেসর।
রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি স্বীকৃতি
একুশে পদক (১৯৮৫)
স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯)
'নাসিরউদ্দিন স্বর্ণ পদক' (১৯৮৮)
'বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক' (১৯৮৭)
সত্যজিত রায় পুরস্কার (১৯৯৫)
শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হতে 'কৃতি বাঙ্গালী সম্মাননা পদক' (১৯৮৮)।
এছাড়া বাংলা একাডেমী ফেলোশীপ, রবীন্দ্র সুবর্ণ জয়ন্তী পাটনা, কলিকাতার শিল্প
মেলার বঙ্গ সংস্কৃতি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, সিকোয়েন্স এওয়ার্ড অব অনার,
রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এওয়ার্ড, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গুণিজন
সংবর্ধনা, পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫তম জন্ম বার্ষিকী, ডি-৮ আর্ট এন্ড
কালচার ফেস্টিভেল, পাকিস্তান ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সম্মানিত হন। সর্বশেষ তিনি বাংলা
একাডেমী প্রবর্তিত 'রবীন্দ্র পুরস্কার-২০১০' এ তাঁকে ভূষিত হন।
সূত্র : মতিন রায়হান। http://www.gunijan.org.bd/GjProfDetails_action.php?GjProfId=82