কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
সঙ্গীতশিল্পী। বিশেষ করে রবীন্দসঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে বিশে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়, মায়ের নাম মা অনিলা দেবী। পাঁচ বোন এবং তিন ভাইয়ের ভিতরে তিনি ছিলেন বড়। অন্য তিন বোনের নাম ছিল সুরেখা, সুহিতা, ঝর্না ও বীথিকা। ভাইদের নাম শান্তময়, সুমন ও পান্নালাল।

কণিকার বাবা ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী ও মা অনিলা দেবী ছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজননী। তাঁর শৈশবের শুরুতে বিষ্ণুপুরের মামাবাড়ির যৌথ পরিবারে ছিলেন। পরে খুব অল্পবয়সে পিতার কর্মস্থল শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর পৈতৃক নাম ছিল অণিমা মুখোপাধ্যায়। পারাবারিক ডাক নাম ছিল মোহর। রবীন্দ্রনাথ এই নাম পরিবর্তন করে নাম দেন কণিকা। এই নামে পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অবশ্য তাঁর কাছের লোকেরা তাঁকে ডাকতেন মোহর নামে।  বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিবাহের পর নাম হয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সহজাত প্রতিভায় তিনি শৈশবে গান শিখেছলেন শুনে শুনে। শান্তিনিকেতনে আসার পর, গান শেখেন। এই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রায়ই নতুন গান শিখতে যেতেন। একারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত নতুন গান শেখানোর জন্য ডাকতেনও।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে শিশুশিল্পী হিসাবে শান্তিনিকেতনের শারদোৎসবে প্রথম মঞ্চে গান করেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জুলাই বোলপুর টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গান করেন 'ওগো তুমি পঞ্চদশী'। উল্লেখ্য এই অনুষ্ঠানটি বেতারে সম্প্রচারিত হয়। এই বিচারে এটাই ছিল তাঁর প্রথম বেতার অনুষ্ঠান।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ছায়া সিনেমা হলে আয়োজিত বর্ষামঙ্গল উৎসবে, তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশন করেন 'ছায়া ঘনাইছে বনে বনে'। এই বৎসরে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি তাঁর গাওয়া দুটি গানের রেকর্ড করে। রেকর্ড নম্বর ছিল
H 584। এই গান দুটির গীতিকার ছিলেন নীহারবিন্দু সেন। সুরকার ছিলেন হরিপদ চট্টোপাধ্যায়। এই গান দুটির শিরোনাম ছিল
            ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার
            গান নিয়ে মোর খেলা
উল্লেখ্য এই তাঁর রেকর্ডটি গান প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে। এই বছরের আগষ্ট মাসে 'ফুলপরী' গীতিনাট্যের রেকর্ডে তিনি কণ্ঠ দেন। রেকর্ড নম্বর ছিল
H 638এই সময় শিল্পী হিসেবে তাঁর নাম ছিল 'কুমারী কণিকা'। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আনন্দধারা গ্রন্থ থেকে জানা যায়- আধুনিক গান গাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ দুঃখ পেয়েছিলেন। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর ছিল H 648  এই গান দুটি হলো
     ডাকব না, ডাকব না
     মনে কী দ্বিধা রেখে গেল

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের দ্বিতীয় রেকর্ড। রেকর্ড নম্বর ছিল H 1021। এই রেকর্ডটিতে তিনি দুটি গানে কণ্ঠ দেন। গান দুটি ছিল
 
      ওই মালতি লতা দোলে
       
ঘরেতে ভ্রমর এলো

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর নির্দেশ মতো 'সমুখে শান্তিপারাবার  গানটি দলগতভাবে পরিবেশন করা হয়। এই দলে কণিকা ছিলেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর শেষ রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর
 H 1021।  এই রেকর্ডটিতে তিনি দুটি গানে কণ্ঠ দেন। গান দুটি ছিল
 
         ওগো তুমি পঞ্চদশী
           এসো শ্যামলসুন্দর

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একক এবং সহশিল্পীদের সাথে তাঁর রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল ২৮টি। এই রেকর্ডগুলোর পৃথক কোনো শিরোনাম ছিল না।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে (১৬ বৈশাখ) বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ টাকা বেতনে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম 'জেমস ফ্রম টেগোর' শিরোনামে রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর  EALP 1267 এরপর ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর ৫৯টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে এইচএমভি তাঁর গানের ক্যাসেট প্রকাশ করে। এই কোম্পানি থেকে তাঁর প্রায় ৪০টি ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর গাওয়া অনেকগুলো গানগুলো সিডি প্রকাশিত হয়।

একক এবং দ্বৈতকণ্ঠের রেকর্ডের পাশাপাশি তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন 'শ্যামা', 'মায়ারখেলা', 'তাসের দেশ', চিত্রাঙ্গদা, 'কালমৃগয়া' নৃত্যানাট্য ও গীতিনাট্যে। গীতি-আলেখ্য হিসেবে প্রকাশিত শাপমোচনেও তাঁর গান রয়েছে। এছাড়া তিনি গেয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, অতুলপ্রসাদের গান, নজরুলসঙ্গীত।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন। এই চলচ্চিত্রগুলো হলো তথাপি (১৯৫০), নিমন্ত্রণ (১৯৭২) এবং বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা (১৯৭২), আহবান (?)।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পুরস্কার:

রচিত গ্রন্থাবলি
রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে স্বামী বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রচিত গ্রন্থ :

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের তালিকা
[পূর্ণাঙ্গ গানের তালিকা তৈরির কাজ চলছে]

নীহারবিন্দু সেনের গান। সুরকার ছিলেন হরিপদ চট্টোপাধ্যায়

  1. ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার [১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 584]

  2. গান নিয়ে মোর খেলা [১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 584]

রবীন্দ্রসঙ্গীত

  1. ডাকব না, ডাকব না [১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 648]

  2. মনে কী দ্বিধা রেখে গেল [১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 648]

  3. ওই মালতি লতা দোলে [১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 754]

  4. ঘরেতে ভ্রমর এলো [১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 754]

  5. ওগো তুমি পঞ্চদশী [১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 1021]

  6. এসো শ্যামলসুন্দর [১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড H 1021]

অতুলপ্রসাদ সেনের গান

  1. ওগো নিঠুর দরদী [১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N83109]

  2. রইল কথা তোমারি নাথ [১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N83109]

  3. মোরা নাচি ফুলে ফুলে [১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N82800]

  4. যখন তুমি গাওয়াও গান [১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N82800]

  5. মিছে তুই ভাবিস মন [১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N83031]

  6. পাগলা মনটারে তুই বাঁধ [১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N83031]

নজরুল সঙ্গীত

  1. তোমার মহাবিশ্বে [১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ ]

  2. হে বিধাতা হে বিধাতা [১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ]

  3. কেউ ভোলে না কেউ ভোলে [১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N83109]

  4. কেন আন ফুল ডোর [১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N83109]

হিন্দি ভজন

  1. প্রভু জায় বসে [১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N 80046]

  2. মেরা পিয়া মুঝে [১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N 80046]

কীর্তন

  1. কালিন্দী পুলিনে বনে [১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N 82526]

  2. বৃন্দাবনে বিলাসিনী রাই [১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ, রেকর্ড N 82526]

কাঙাল হরিনাথের গান

  1. যদি ডাকার মতো ডাকতে [১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ]


সূত্র:

  • আনন্দধারা। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকাল পাবলিশার্স, কলকাতা। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ।
  • প্রবন্ধ শেষ গানেরই রেশ, শুচিস্মিতা মজুমদার, পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা (সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রবীন্দ্র-স্মরণ সংখ্যা, 'ক্রোড়পত্র: শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়' অংশ), জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় সংখ্যা ১৪০৭ বঙ্গাব্দ
  • কার গান কার সুর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, দলছুট, জানুয়ারি,২০১১
  •