কণিষ্ক
প্রাচীন ভারতের কুষাণবংশীয় সম্রাট।
ইনি তাঁর সিংহাসনে আরোহণের সময়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি বর্ষগণনা শুরু করেন।
তাঁর সিংহাসন আরোহণ সম্পর্কে মতভেদ আছে। ইতিহাসবিদ ফ্লিটের মতে ইনি ৫৮ খ্রিষ্টাব্দে
সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সিংহাসনে আরোহণের সময়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি
বর্ষগণনা শুরু করেন। এই অব্দটি শকাব্দ নামে চিহ্নিত। তবে এ বিষয়ে কোনো ঐতিহাসিক
প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। ভাণ্ডারকরের মতে কণিষ্ক ২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যারোহণ করেন।
কিন্তু চৈনিক ও তিব্বতীয় সূত্রে এই বিষয়ে কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। মার্শাল, স্মিথ
ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে ইনি ১২৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যারোহণ করেন। এই মতবাদও বাতিল
করা হয়ে থাকে ।
অধিকতর গ্রহণযোগ্য মতবাদ হলো, কণিষ্ক ৭৮
খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন এবং এই অব্দ থেকে শকাব্দ শুরু হয়। এই কারণে
খ্রিষ্টাব্দের সাথে ৭৮ বৎসর যুক্ত করলে শকাব্দ পাওয়া যায়। প্রকৃত অর্থে তিনি
কুষাণবংশীয় ছিলেন কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে কুষাণদের সাথে তাঁর অত্যন্ত সুসম্পর্ক
ছিল। এই কারণে পরবর্তী সময় কণিষ্কের রাজ্যারোহণের সম্পর্কিত অব্দ শকাব্দ নামে
পরিচিত লাভ করেছিল।
কণিষ্কের রাজ্যারোহণের সময় কুষাণ রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো আফগানিস্থান, সিন্ধুর
অধিকাংশ অঞ্চল, পাঞ্জাব, পার্থিয়া এবং ব্যাক্ট্রীয়ার অংশ। রাজ্যলাভের পর তিনি
কাশ্মীর অধিকার করেন। চৈনিক এবং তিব্বতীয় সূত্র অনুসারে জানা যায়, তিনি মগধ আক্রমণ
করে পাটলিপুত্র দখল করেন। তাঁর প্রচলিত মুদ্রা থেকে জানা যায়- তিনি গাজীপুর ও
গোরখপুর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তৃত লাভ করেছিল। তিনি পার্থিয়ার রাজাকে পরাজিত করেন।
অনেকের মতে তিনি উজ্জয়িনী দখল করতে সক্ষম হন। ইনি তুর্কিস্তানে অভিযান পরিচালন করেন
এবং তুর্কিস্থানের অন্তর্গত কাশগড়, খোটান এবং ইয়ারকন্দ জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
হিউয়েন সাং-এর বিবরণীতে থেকে জানা যায়, চীনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযানে ইনি পরাজিত
হন। পরবর্তী অপর একটি অভিযানে তিনি চীন সম্রাটের এক রাজপুত্রকে বন্দী করতে সক্ষম
হয়েছিলেন।
কণিষ্কের রাজ্যের রাজাধানী ছিল
পুরুষপুর বা পেশোয়ার।
কণিষ্ক বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি আছে। তিনি নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
করেন ও পুরুষপুরে একটি বহতল চৈত্য নির্মাণ করেন । অশোকের পর তাঁর সময়েই বৌদ্ধধর্ম
পুনরায় রাজানুগ্রহ লাভ করে । তাঁর সময়ে বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান- এই দুই ভাগে ভাগ
হয়ে যায় । ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে কণিষ্ক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । তাঁর
প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম খোটান, চিন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে । বৌদ্ধধর্মের
পৃষ্ঠপোষক হলেও কণিষ্ক অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল ছিলেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কণিষ্কের খ্যাতি রয়েছে। বুদ্ধচরিত রচয়িতা
অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধসাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক
চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীগণ তাঁর রাজত্ব কালেই তাঁদের
সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, স্তুপ ও চৈত্য নির্মাণে
উদ্যোগী হয়েছিলেন । তাঁরই সময়ে সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি পৃথক
শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল।
ধারণা করা হয় কণিষ্ক ১৫১ খ্রিষ্টাব্দে
মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর
ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। তাঁর পরবর্তী রাজা বিশিষ্ক, হুবিষ্ক,
দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ পরবর্তী
রাজাদের যোগ্যতা কখনোই কণিষ্কের মতো ছিল না । বিশেষত শেষ দুজনের আমলে কুষাণরা খুবই
দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে অসংখ্য আঞ্চলিক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। উত্তরপ্রদেশে নাগ ও
মাঘ বংশীয় রাজারা পাঞ্জাবে বৌধেয় প্রমুখরা বিদ্রোহে শামিল হয় । পশ্চিম ভারতে শকগণ
স্বাধীনতা লাভ করে । এছাড়া পারস্যের সাসনীয় সম্রাটদের হাতে কুষাণরা পরাস্ত হয়।
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অর্থনৈতিক ক্রমাবনতি, বৈদেশিক আক্রমণ— সব মিলিয়ে কুষাণ
সাম্রাজ্য ক্রমশ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় ।
সূত্র : ভারতের ইতিহাস। অতুলচন্দ্র রায়।