কণক
দাশ (বিশ্বাস)
রবীন্দ্র সংগীতের একজন অগ্রণী শিল্পী
১৯০৩
খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। মাতার নাম
সরলা দাশ । তাঁর মা ছিলেন একজন সুগায়িকা। শৈশবে মায়ের উৎসাহেই তিনি কণক দাশকে গান
শিখিয়েছিলেন। তাঁর ছোট মাসি সুবলা আচার্য এবং মেসোমশাই প্রাণকৃষ্ণ আচার্য বাড়িতে
রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা ছিল। সেই পরিবেশে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন।
তাঁর বালিকা বয়সের গান শুনেই রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হন এবং তিনি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে কণক
দাশকে গান শেখান। পরবর্তী সময়ে তিনি রবীন্দ্র সংগীতের দীক্ষা নেন দীনেন্দ্রনাথ
ঠাকুর, শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে। রবীন্দ্র সংগীতের পাশাপাশি
উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, সত্যকিঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যামিনীরঞ্জন মজুমদার। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাহানা দেবীর
মাধ্যমে আলাপের সূত্রে দিলীপকুমার রায়ের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এরপর কিছুকাল তিনি
লক্ষ্ণৌতে থেকে দিলীপকুমার রায়ের কাছে গান শিখেছিলেন। সমকালীন দুই স্বনাসধন্য
রবীন্দ্র সংগীত গায়িকা সাহানা দেবী ও সতী দেবীর সাথে তাঁর ছিলো পারিবারিক আত্মীয়তা।
বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থপতি ও খেয়ালরসের স্রষ্টা সুকুমার রায় ছিলেন
তাঁর ভগ্নিপতি।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। তার আগেই তিনি সাহানা দেবীর সাথে
জোড়াসাকোঁয় ঠাকুরবাড়িতে যান এবং সেখানেই 'বর্ষামঙ্গল' উৎসবে প্রথম গান করেন
'অশ্রু ভরা বেদনা'। এরপর ঠাকুরবাড়ির বহু অনুষ্ঠানেই তিনি গান করেছেন।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কণক দাশের প্রথম গানের রেকর্ড—
'দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে' এবং 'কবে তুমি আসবে বলে' বের হয়। রবীন্দ্র
সংগীত ছাড়াও হিমাংশু দত্ত ও মাসতুতো দাদা অতুল প্রসাদের কয়েকটি গানের রেকর্ড
করেছেন। তারপরেও তাঁর পরিচয় ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে। তাঁর রেকর্ড-কৃত
গানের সংখ্যা ৬৮টি। তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশী রবীন্দ্র
সংগীত রেকর্ড করেছেন। একক গানন ছাড়াও দেবব্রত বিশ্বাসের সাথেও কণক দাশের বেশ কয়েকটি
রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড আছে। এই গানগুলি হলো—
হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি, ঐ ঝঞ্ঝার
ঝংকারে, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা, সংকোচেরও বিহ্বলতায় নিজের অপমান।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে কণক দাশের সাথে আয়কর বিভাগের কর্মী এবং সঙ্গীতপ্রেমিক অজয়
বিশ্বাসের (দেবব্রত বিশ্বাসের ভাই) সাথে বিয়ে হয়। কোলকাতার রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার
বিদ্যালয় 'গীতবিতান' এর প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর) থেকেই এর
কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন অজয় বিশ্বাস। স্বামীর উৎসাহেই কণক দাশ এই বিদ্যালয়টির সাথে যুক্ত
হন। প্রথমে সংগীত শিক্ষিকা হিসাবে যুক্ত হন এবং পরবর্তীতে এই বিদ্যালয়েরর অধ্যক্ষ
হন।
রবীন্দ্রসংগীতে সুরের বিশুদ্ধতা এবং গভীর ভাব ও আবেগের ছোঁয়া কণক দাশের পরিবেশিত
গানগুলোকে এক অন্যরকম বিশিষ্টতা দিয়েছিলো। অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ এবং রাবীন্দ্রিক
গায়কীর প্রকাশভঙ্গি ও পরিবেশনার মাধুর্যে তাঁর গানগুলো হয়ে উঠেছিলো অসাধারণ। গান
করবার সময় সমস্ত খুটিঁনাটি বিষয়কে মনে রেখে গানের ভাবনাকে আত্মস্থ করে গান গাওয়ার
চেষ্টা করতেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীতকে যথার্তভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে শৈলজারঞ্জন
মজুমদার এবং নীহরিবিন্দু সেনের পাশাপাশি কণক দাশের নামটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাঁর গান রেকর্ড করার জন্য যখন 'ডেকো না আমারে ডেকো না' গানটির জন্য সম্মতি নিতে
রবীন্দনাথ ঠাকুরের কাছে যাওয়া হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, 'পাসড উইথ
অনার্স'।
শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য গান গাওয়াতে তাঁর নিজের এবং পরিবারের সকলেরই আপত্তি ছিলো।
রেকর্ড বেরোনোর পর প্রথম একবছর তিনি কোন পারিশ্রমিক বা সম্মানী নেন নি।
নারীর অগ্রগতির প্রতি তাঁর ছিলো দৃঢ় সমর্থন। গান গাওয়ার জন্য মেয়েদের সর্বদা সাহস
যুগিয়েছেন এবং নিজে হাতে ধরে তাদের গান শিখিয়েছেন। গানকে উপজীব্য করে জীবনের আলো
খুজেঁ নিতে তাদেরকে নিরলস অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন তিনি। একজন রবীন্দ্র অনুরাগী হিসেবে
রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি সর্বদা
সচেষ্ট ছিলেন, পাশাপাশি ভারতের আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের
পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগষ্ট কোলকাতার শিশুমঙ্গল হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র :
শতবর্ষের কৃতি বঙ্গনারী
।
শ্যামলী গুপ্ত সম্পাদিত ।
ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। কলিকাতা। ফেব্রুয়ারি ২০০১।