ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে যাবার পথে ৪২ বছর বয়সে মাদাম তুসো। জন থিওডর তুসো কর্তৃক অঙ্কিত প্রতিকৃতি (১৯২১)

মেরি টুস্যাড
প্রখ্যাত মোমের ভাস্কর্যশিল্পী এবং মোমের যাদুঘরের প্রতিষ্ঠতা।

এঁর পুরো নাম আন্না মারিয়া টুস্যাড (Anna Maria Tussaud)। মেরি টুস্যাড নামেই সর্বাধিক পরিচিতা। ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর, ফ্রান্সের  স্ট্রাসবার্গে (Strasbourg)-এ জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতা জোসেফ গ্রোসোল্জ (Joseph Grosholtz) ফ্রান্সের ৭ম বর্ষব্যপী যুদ্ধে প্রাণ হারান। তাঁর পিতার মৃত্যুর প্রায় দুই মাস আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা আন্নে মারিয়া ওয়াল্ডার (Anne-Marie Walder) তাকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন-এ চলে আসেন। এই সময় তাঁর ডাঃ ফিলিপ কার্টিয়াসের (Dr. Philippe Curtius) বাড়ীতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ নেন। উল্লেখ্য কার্টিয়াস ছিলেন একজন চিকিৎসক ও মোমের ভাস্করশিল্পী। শৈশবে টুস্যোড কার্টিয়াসের কাছে মোমের মূর্তি তৈরির কলাকৌশল শেখেন।

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কার্টিয়াস প্যারিসে এসে মোমের চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এই বৎসরে তিনি লুইস পঞ্চদশের শেষ স্ত্রী
 Madame du Barry-এর মোমের চিত্রকর্ম তৈরি করেন। এই সময় টুস্যাড ও তাঁর মা বার্নে ছিলেন। ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে উভয়ই প্যারিসে কার্টিয়াসের কাছে চলে আসেন। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে কার্টিয়াসের প্রথম মোমের মূর্তি প্রদর্শন করে বিপুল সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রদর্শনী প্যালিয়াস রয়্যাল-এ স্থান্তরিত হয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে টুস্যাড প্রথম তাঁর মোমের মূর্তি তৈরি করেন। এই মূর্তিটি ছিল ভলতেয়ারের (Voltaire)। এরপর থেকে তিনি একের পর এক মোমের মূর্তি তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এই সময় ধীরে ধীরে ফ্রান্সের রাজ পরিবারের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে কার্টিয়াস এর দ্বিতীয় প্রদর্শনী-স্থান স্থাপন করেন Caverne des Grands Voleurs-এতে। এই সময় তিনি কার্টিয়াসে সহযোগিনী হিসাবে ছিলেন।

ফরাসী বিপ্লবের সাথে টুস্যাড ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় নেপোলিয়ান-সহ ফার্ন্সের অনেক বিখ্যাত লোকের সাথে পরিচিত হন। ফরাসী বিপ্লব চলাকালীন সময়ের অনেকগুলো ঘটনার চিত্রকর্ম মূর্তি হিসেবে তৈরী করেন। ঐ বিপ্লবের সময়, প্রয়োজনে মৃতদেহের মুণ্ডু খোঁজ করতেন ও সেগুলো দিয়ে মুখোশ তৈরী করতেন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুলাই, তাঁর তৈরি নেকার এবং ডাক ডি'অরলিয়েন্স লুইস ফিলিপ জোসেফের মোমের আবক্ষ মূর্তি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। 
১৪ জুলাই বিপ্লবীরা বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করেন। এই সময় টেরর (
Terror) অঞ্চলে তিনি Joséphine de Beauharnais-এর সাথে গ্রেফতার হন। বিচারে তাঁকে গিলেটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এমনকি গিলেটিনে মাথা দেওয়ার পূর্বে তাঁর মাথার চুল ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই টেরর অঞ্চলের জননিরাপত্তা কমিটির সদস্য  Jean-Marie Collot d'Herbois-এর সমর্থনে তিনি সে যাত্রায় বেঁচে যান। এরপর গিলেটিনে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মৃত্যু-মুখোশ তৈরির কাজ পান। এই মুখোশগুলোর ভিতরে ছিল লুইস চতুর্দশ, মেরি এ্যান্টোনেট, মারাট, রোবেস্পিয়ের। পরবর্তীতে মৃতদেহের মুখোশগুলো শোভাযাত্রার পতাকায় আটকে প্যারিসের রাস্তায় প্রদর্শন করা হয়েছিল।

টুস্যাডের সৃষ্ট মোমের আত্ম-প্রতিকৃতি
লণ্ডন টুস্যাড মোম-যাদুঘর

১৭৯৪ তাঁর শিক্ষাগুরু এবং অভিভাবক কার্টিয়াস মৃত্যুবরণ করেন। এই সূত্রে কার্টিয়াসের মোমের মূর্তিগুলোর অধিকারী হন। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফ্রাঙ্কোইস টুস্যাড (François Tussaud) -কে বিবাহ করেন। এঁদের দুই সন্তানের নাম ছিল জোসেফ ও ফ্রাঙ্কোইস।

১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত ভাস্কর পল ফিলিডোরের তাঁর সন্তান জোসেফের সাথে লণ্ডনে আসেন। এই বৎসরেই পল ফিলিডোর (Paul Philidor)-এর আমন্ত্রণে লন্ডনের লাইসিয়াম থিয়েটারে (Lyceum Theatre) তাঁর মোমের মূর্তি প্রদর্শনের জন্য, লণ্ডনে আসেন। এই প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের অর্থেক পল ফিলিডোর নিয়ে নেন। এই সময় নেপোলিয়ানের যুদ্ধ শুরু হয়। তাঁর যথেষ্ঠ আর্থিক সঙ্গতি না থাকার জন্য বহু কষ্টে লণ্ডনে থেকে যান। নেপোলিয়নের যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পরও, তিনি আর্থকি অসুবিধার কারণ, তিনি তাঁর মূর্তিগুলো নিয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসতে পারেন নি। এই সময় গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন অংশে এবং আয়ারল্যান্ডে তাঁর মোমের সংগ্রহশালা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। সম্ভবত ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অপর ছেলে  ফ্রাঙ্কোইস তাঁর মায়ের কাছে আসেন। এরপর ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেকার স্ট্রিট বাজারের উপরতলায় একটি মোমের মূর্তিগুলো রাখেন এবং ধীরে ধীরে তা যাদুঘরে রূপ দিতে থাকেন। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর আত্মকথা রচনা করেন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তিনি নিজের মোমের মূর্তি তৈরি করেন। পরে এই মূর্তিটি টুস্যাডের যাদুঘরের প্রবেশ দ্বারে স্থাপিত করা হয়েছে।

১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ এপ্রিল তিনি লণ্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।

 লণ্ডনের টুস্যাড-এর যাদুঘর।

টুস্যাডোর যাদুঘর
১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডনের বেকার স্ট্রিট বাজারের উপরতলায় টুস্যাডো যে যাদুঘরটি তৈরি করেছিলেন, সেটাই তাঁর মূল যাদুঘর হিসাবে নির্দেশিত হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের রাজধানী, লণ্ডন শহরের (সেন্ট্রাল লন্ডনের উত্তরে) অলসপ প্লেস এবং মেরিলিবোন রোডের কোণায় এই জাদুঘরটি অবস্থিত। জুবিলী, ব্যাকারলু, মেট্রোপলিটন, সার্কেল এন্ড হ্যামারস্মিথ এবং সিটি লাইনের নিকটবর্তী পাতাল স্টেশন থেকে এই যাদুঘরে যাওয়া যায়। সবুজ ও অর্ধ-গোলাকার ছাদ বা গম্বুজে মোড়ানো জাদুঘরটির পার্শ্বেই লন্ডন গ্রহগৃহ অবস্থিত।

এই মোমের যাদুঘরটির কয়েকটি শাখা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে। এর ভিতরে আমস্টারডাম, ব্যাংকক, হংকং (ভিক্টোরিয়া পীক), লাস ভেগাস, সাংহাই, বার্লিন, ওয়াশিংটন ডি.সি, নিউ ইয়র্ক সিটি এবং হলিউড অন্যতম। মার্লিন এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপ মাদাম তুসো যাদুঘরের বর্তমান স্বত্ত্বাধিকারী।


 

তথ্যসূত্র:
http://en.wikipedia.org/wiki/Marie_Tussaud