মান্না দে
(১৯১৯-২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম প্রবোধ দে। পিতার নাম পূর্ণ চন্দ্র এবং মায়ের নাম মহামায়া দে।

তিনি 'ইন্দু বাবুর পাঠশালা' নামক একটি ছোট প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ছোটোবেলায় তাঁর কাকা তৎকালীন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণ চন্দ্র দে-এর কাছে সঙ্গীতের পাঠ নেন।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে স্কটিশ চার্চ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি কলেজের গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এই প্রতিযোগিতায় আধুনিক গান ছাড়া সকল বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

সঙ্গীতশিক্ষায় তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি কাকার কাছে নিয়মিত প্রথাগতভাবে সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া শুরু করেন। এই বছরে তিনি কলেজের এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রথম গান করেন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওস্তাদ দাবির খানের কাছে রাগ সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে শৈলেন রায়ের রচিত একটি গানে সুরারোপ করেন। এই গানটি সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে রেকর্ড হয়।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণ চন্দ্র দে'র সাথে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) যান। এই বছরে তিনি ওস্তাদ আমান আলি খাঁ-এর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে'র সঙ্গীত পরিচালনায় 'তামান্না' চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে'র অভিষেক ঘটে। এই গানে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন সুরাইয়া। ঐ সময়ে গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। গানটি ছিল
'জাগো আঈ ঊষা'। এই বৎসরে শঙ্কর রাও ব্যাস-এর সঙ্গীত পরিচালনায় 'রামরাজ্য' ছবিতে প্রথম একক কণ্ঠে গান পরিবেশন করেন করেন। এই গানটি ছিল 'ভারত কি এক'।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ওস্তাদ আমন আলি খাঁ-এর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। এর পরবর্তী প্রায় সাত বৎসর তিনি হরিপ্রসন্ন, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ, শচীনদেব বর্মন, অনিল বিশ্বাস প্রমুখের সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পায় হিন্দি ছবি 'তমান্না'। এই ছবিতে তিনি প্রথম নেপথ্যে কণ্ঠদান করেন। গানটি ছিল 'জাগো আঈ উষা'। এই বছরেই 'মশাল' ছবিতে কবি প্রদীপের রচনায় এবং শচীনদেব বর্মণের সুরে 'উপর গগন বিশাল' নামে একক গান গেয়েছিলেন। এই বৎসরে মুম্বাই প্রবাসী মালয়ালি মেয়ে সুলোচনা কুমারণের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ছবিতে কণ্ঠ দেন। সেই সূত্রে রাজকাপুরের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভি, শান্তারাম পরিচালিত 'অমর ভূপালী' নামক ছবিতে একটি গানে কণ্ঠ দান করেন। উল্লেখ্য এই ছবিটি বাংলা এবং মারাঠী ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। এই গানটি ছিল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের 'ঘনশ্যাম সুন্দর'। এটাই ছিল তাঁর গাওয়া প্রথম বাংলা গান।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ-এর কাছে শাস্ত্রী সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। পরে তিনি তালিম নেন গোলাম মুস্তাফা খাঁর কাছে।

 স্ত্রী সুলোচনা দের সাথে মান্নাদে

সুলোচনা কুমারনের সাথে প্রণয়ের সূত্রে তিনি ১৮ ডিসেম্বর তাঁক বিয়ে করেন। এই বৎসরে 'দো বিঘা জমি' ছবিতে গান গাওয়ার সূত্রে সলিল চৌধুরীর সাথে পরিচিত হন। বম্বে ইয়থ কয়ারের সদস্য হন এই বৎসরে। এই বৎসরে চলচ্চিত্রের বাইরে  তাঁর প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই গানটি ছিল 'কতদূরে আর নিয়ে যাবে বল'।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ছবি 'গৃহ প্রবেশ;-এ কণ্ঠদান করেন। এটি ছিল তাঁর প্রথম বাংলা ছবিতে গাওয়া প্রথম নেপথ্য-গান।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর তাঁর প্রথম কন্য  সুরমা'র জন্ম হয়।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ জুন তাঁর দ্বিতীয় কন্যা সুমিতা'র জন্ম হয়।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরবর্তী সময়ে এই জুটি বহু অসাধারণ বাংলা আধুনিক গান উপহার দেয়।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ঠাকুমা, বাবা এবং কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা চলচ্চিত্র 'কাঞ্চন রঙ্গ' ছবিতে কণ্ঠ দান করেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মালায়াম ভাষার 'চেম্মিন'-এ কণ্ঠ দান করেন এবং জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সুধীনদাশ গুপ্তের সঙ্গীত পরিচালনায় 'শঙ্খবেলা' ছবিতে উত্তম কুমারের ওষ্ঠাধরে প্রথম কণ্ঠ দান করেন। এই গানটি হলো

        
কে প্রথম কাছে এসেছি।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে 'এ্যান্টনী ফিরিঙ্গী' ছবিতে কণ্ঠ দান করেন এবং বি.এফ.জে..এ পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দী 'মেরে হুজুর' ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা চলচ্চিত্র 'চিরদিন'-এ কণ্ঠ দান করেন এবং বি.এফ.জে..এ পুরস্কার লাভ করেন। এই বৎসরে তাঁর প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল 'ওগো স্বপ্নরূপিণী' ।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে নচিকেত ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় 'নিশিপদ্ম' ছবিতে 'না না না আজ রাতে আর যাত্রা দেখতে যাব না' এবং 'ও যা খুশী ওরা বলুক' পরিবেশন করেন। এই বৎসরে মারাঠি ভাষার 'ঘরকুল' ছবিতে কণ্ঠদান করে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে রাজকাপুরের 'মেরা নান জোকার' ছবিতে কণ্ঠ দেন। ছবির 'এ ভাই, জরা দেখকে চলো' গানটির জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। এবং ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি.ভি.গিরির হাত থেকে পদ্মশ্রী খেতাব গ্রহণ করেন।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ছবি 'যুগমানব কবীর'- ছবিতে কণ্ঠদানের জন্য বি.এফ.জে..এ পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ছবি '[ব্রজবুলি' ছবিতে কণ্ঠদানের জন্য বি.এফ.জে..এ পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ তাঁর প্রথম নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক প্রদেয় লতা মঙ্গেশকার পদক লাভ করেন। এই বৎসরে ২৩ জানুয়ারি কতিপয় দুর্বিত্ত কর্তৃক ছোরা আঘাতে আহত হন। এই বৎসর তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার রেনেঁসা সাংস্কৃতিক পরিষদ, থেকে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে মিঠুন ফ্যানস এসোসিয়েশনের তরফ থেকে শ্যামল মিত্র পুরস্কার পান। এই বৎসরে এক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ৫ ডিসেম্বর মুম্বাই ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে তাঁর বাই-পাস-সার্জারি হয়। এই বৎসর থেকে এইচ.এমভি থেকে রেকর্ডে গান গাওয়া ছেড়ে দেন। এর পরিবর্তে তিনি
Paramount Music Cassatte থেকে গান গাওয়া শুরু করেন।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রী ক্ষেত্রকলা প্রকাশিকা, পুরী থেকে 'সঙ্গীত স্বর্ণচূড়' উপাধি লাভ করেন।
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল 'পি.সি চন্দ্র গ্রুপ পুরস্কার' লাভ করেন। এই বৎসর তাঁকে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কমলাদেবী গ্রুপ থেকে 'কমলাদেবী রায়' পুরস্কার লাভ করেন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ‍আনন্দবাজার গ্রুপ 'আনন্দলোক' সম্মাননা লাভ করেন।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ কর্তৃক 'বিভাকর' পুরস্কার লাভ করেন। ১ মে সঙ্গীত জীবনের ষাট বৎসর পূর্তি অনুষ্ঠানে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ৪ আগষ্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদেয় 'আলাউদ্দিন খান' পুরস্কারে ভূষিত হন।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় গায়কের পুরস্কার পান। ৭ই মে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদেয় ডি.লিট সম্মাননা লাভ করেন। মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে 'লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট' পুরস্কার প্রদান করে।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তাঁর আত্মজীবনী 'জীবনের জলসাঘরে' প্রকাশিত হয়। এই বৎসরে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদেয় পদ্মবিভূষণ খেতাব প্রদান। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। দীননাথ মঙ্গেশকর পুরস্কার লাভ করেন। ২৫তম আমেরকা বঙ্গ সম্মেলনে তাঁকে 'লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট' পুরস্কার দেওয়া হয়। এই বৎসরে ১৩৮তম কানাডা ডে সেলিব্রেশন, প্যানোরোমা ইন্ডিয়া, টরেন্টো কানাডা থেকে 'লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট' পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার কর্তৃক দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ওড়িষ্যা সরকার কর্টরক প্রদেয় 'প্রথম অক্ষয়' পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মান প্রদান।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জুন ফুসফুসের জটিলতা দেখা দেয়ায় মান্না দেকে ব্যাঙ্গালোরে একটি হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়। এই বৎসরের ২৪ অক্টোবর ব্যাঙ্গালোরে মৃত্যুবরণ করেন।