ফ্রেডরিক ম্যাক্স মুলার
(৬ই ডিসেম্বর, ১৮২৩ - ২৮শে অক্টোবর, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ)
Friedrich Max Müller

জার্মান বংশোদ্ভুত প্রখ্যাত বিখ্যাত ভারতবিশারদ, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত ও অনুবাদক।

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর, তৎকালীন প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আন্‌হাল্ট রাজ্যের রাজধানী ডেসাউ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা উইলহেম মুলার ছিলেন একজন বিশিষ্ট রোমান্টিক কবি ও গ্রন্থাগারিক। তাঁর মা এডেদলহেইড মুলার ছিলেন অ্যানহাল্ট-ডেসাউ শহরের মূখ্যমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠা কন্যা।

মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর পিতা মৃত্যুর হয়। ফলে শৈশবকাল আর্থিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে কেটেছে। শৈশবে মাক্স মুলার সঙ্গীত শেখা শুরু করেন এবং দ্রুত সঙ্গীতে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু গান শিখে ভবিষ্যতে আর্থিক উন্নতির সম্ভাবনা নেই, এ বিবেচনায়, পারিবারিক বন্ধুদের পরামর্শে তাকে গান শেখার পরিবর্তে প্রথাগত লেখাপড়ার স্কুলে ভর্তি করা হয়। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পাঠ শেষ করে লিপজিগের একটি স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ভাষাতত্ত্বে আগ্রহী হয়ে উঠেন। উচ্চতর ভাষা শিক্ষার জন্য তিনি লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে তিনি বিভিন্ন প্রাচীন ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই সূত্রে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন ভাষা শেখেন। এরপর আরবি, ফার্সি ভাষা নিয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। সে সময়  এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষার পাঠ্যক্রম শুরু হয়েছিল। তাই আগ্রহের সাথে তিনি সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করেন। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বারুখ স্পিনোজা'র দর্শন-চিন্তার উপর লিখিত অভিসন্দর্ভের জন্য 'লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে পি.এইচ-ডি লাভ করেন।

১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিষ্ণু শর্মা'র সংস্কৃত ভাষায় রচিত ভারতীয় উপকথার সংগ্রহশালা ও হিতোপদেশ গ্রন্থ, জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। লিপজিগে সংস্কৃত ভাষা পাঠের বেশি সুযোগ ছিল না, তাই তিনি ওই বছরেই বার্লিন নগরে চলে আসেন। সেখানে তিনি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবিশারদ অধ্যাপক ফ্রাঞ্জ বোপ্‌ ও দার্শনিক ফ্রেডরিখ শিলিংয়ের কাছে যথাক্রমে সংস্কৃত এবং দর্শন অধ্যয়ন করেন। এই সময় তিনি শিলিংয়ের অনুরোধে উপনিষদ অনুবাদ করতে শুরু করেন। এর এক বছর পর তিনি প্যারিস নগরে আসেন এবং এখানে প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ইউগেনি বার্নোফের তত্ত্বাবধানে উচ্চতর সংস্কৃত ভাষা শেখা শুরু করেন। এই সময় বার্নোফ ইংল্যান্ডে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে সংস্কৃত ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ঋগ্বেদ প্রকাশের জন্য তাঁকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের সন্ধানে প্যারিস থেকে লণ্ডনের ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অফিস লাইব্রেরির সাথে যুক্ত হন। এই সময় তিনি 'জার্মান লাভ' নামক একটি উপন্যাস লিখে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই সূত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে লন্ডন থেকে তিনি অক্সফোর্ডে চলে আসেন। একই সাথে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতিবিদ যোগদান করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ব্রিটিশশাসিত ভারতের শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক অন্যতম বুদ্ধিজীবী ও ভাষ্যকার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর সাথে ব্রিটিশ এবং ভারতের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাথে সখ্য গড়ে উঠে। এখানে থাকার সময়েই তিনি প্রখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হোরেস হেম্যান উইলসন প্রমুখের চেষ্টায়, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ মাক্স মুলার সম্পাদিত ঋগ্বেদ প্রকাশের ব্যয়ভার গ্রহণে সম্মত হয়। এই সূত্রে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় সায়নাচার্যের ভাষ্য সহযোগে ঋগ্বেদের একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে।

১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইউরোপীয় ভাষা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ক্রাইষ্ট চার্চ কলেজের সদস্য হন। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অক্সফোর্ড  বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রধান অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন।

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর 'প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, উক্ত গ্রন্থের নির্ঘণ্ট প্রস্তুত করে দেন বয়ঃকনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রাচ্যবিদ যোহান জর্জ বুল। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি র‌য়্যাল ইন্সটিটিউশনে ভাষাবিজ্ঞান ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব চর্চার সাথে যুক্ত হন। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এখানে গবেষণার কাজ করেন। এই সময় তিনি ধর্মতত্ত্বে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীয় বিভাগ পরিবর্তন করে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই বিভাগে অধ্যাপনা করেন।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ অক্টোবর, অক্সফোর্ড নগরে দেহত্যাগ করেন।

মাক্স মুলারের স্ত্রীর নাম ছিল জর্জিনা এডিলেইড। তাঁর একমাত্র পুত্র উইলহেম মাক্স মুলার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচ্যভাষাবিৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।

তাঁর প্রকাশিত মৌলিক ও অনূদিত গ্রন্থাদির তালিকা

  • মেঘদূতম্‌ (১৮৪৭)
  • ঋগ্বেদ উইদ সায়ান'স কমেনটারী (৬ষ্ঠ খণ্ডঃ ১৮৪৯-৭৩)
  • এসেজ অন কম্পারেটিভ মিথোলোজি (১৮৫৬)
  • এ্যা হিস্ট্রি অব এনসিয়েন্ট সংস্কৃত লিটারেচার (১৮৫৯)
  • এ্যা সংস্কৃত গ্রামার (১৮৬৬)
  • দ্য সায়েন্স অব ল্যাঙ্গুয়েজ (২য় খণ্ড, ১৮৬১, ১৮৬৩)
  • ঋগ্বেদ সংহিতা (১৮৬৯)
  • দি উপনিষদাস (১৮৭৯)
  • ঋগ্বেদ (কেবলমাত্র মূল পাঠ, ২য় খণ্ড, ১৮৭৩)
  • দি অরিজিন এণ্ড গ্রোথ অব রিলিজিয়ন (১৮৭৮)
  • ফিজিক্যাল রিলিজিয়ন (১৮৮১)
  • ইণ্ডিয়া - হুয়াট ক্যান ইট টিচ আজ? (১৮৮৩)
  • ন্যাচারেল রিলিজিয়ন (১৮৮৯)
  • ইন্ট্রুডাকশন টু দ্য সায়েন্স অব রিলিজিয়ন (১৮৯৩)
  • দ্য সিক্স সিস্টেমস্‌ অব হিন্দু ফিলোসোফি (১৮৯০)
  • থ্রী লেকচার্স অন দ্য বেদান্ত ফিলোসোফি (১৮৯৪)
  • মাই ইন্ডিয়ান ফ্রেণ্ডস্‌ (১৮৯৯)
  • এসেজ অন মিথোলোজি এন্ড ফোকলোর (১৯০০)
  • মাই অটোবায়োগ্রাফী (অসমাপ্ত, ১৯০১)
  • চিপস্‌ ফ্রম এ্যা জার্মান ওয়ার্কশপ
  • অল্ড ল্যাং সাইন
  • এ্যান্ড রামকৃষ্ণ, হিজ লাইফ এন্ড সেয়িংস্‌