মধুসূদন দত্ত, মাইকেল
(১৮২৪-১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)।
কবি, নাট্যকার, বাংলা কাব্যের সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক।

১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী সাগরদাঁড়ি গ্রামে, জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল এবং সাগরদাঁড়ি অঞ্চলের জমিদার। মায়ের নাম জাহ্নবী দেবী। শৈশবে মায়ের তত্ত্বাবধানে তার শিক্ষারম্ভ হয়। এরপর তিনি সাগরদাঁড়ির পাঠশালায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর সাত বছর বয়সে তিনি কলকাতা যান এবং সেখানকার খিদিরপুর স্কুলে দুবছর লেখাপড়া করেন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুল ত্যাগ করে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন।

১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইংরেজি ‘নাট্য-বিষয়ক প্রস্তাব’ আবৃত্তি করে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য, তিনি বরাবর বৃত্তি পেতেন। এ সময় নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন।

হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময়েই মধুসূদন কাব্যচর্চা শুরু করেন। তখন তাঁর কবিতা জ্ঞানান্বেষণ,
Bengal Spectator, Literary Gleamer, Calcutta Library Gazette, Literary Blossom, Comet প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।

এই সময় থেকেই তিনি স্বপ্ন বিলেত গিয়ে লেখাপড়া করার স্বপ্ন দেখতেন। এছাড়া তাঁর ধারণা ছিল বিলেতে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া যাবে। সন্তানের এই মনোভাব লক্ষ্য করে, তাঁর পিতা তাঁর বিবাহ ঠিক করেন। কিন্তু তিনি ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি তিনি খ্রিষ্টান ধর্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর নামের শুরুতে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত করেন। এই ঘটনায় তাঁর পিতা তাঁকে ত্যাগ করেন। সে সময়ে হিন্দু কলেজে খ্রিষ্টানদের অধ্যয়ন নিষিদ্ধ থাকায়, মধুসূদনকে এই কলেজ ত্যাগ করতে হয়। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশপ্স কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যয়ন করেন। এখানে তিনি ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখার সুযোগ পান।

ধর্মান্তরের কারণে, পিতার কাছ থেকে তাঁর আর্থিক সাহায্য পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই কারণে ভাগ্যান্বেষণে তিনি ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাদ্রাজ চলে যান। মাদ্রাজে এসে তিনি প্রথমে মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান এ্যাসাইলাম স্কুলে (১৮৪৮-১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পরে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা (১৮৫২-১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) করেন। এ ছাড়া এখানে তিনি তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি
Eurasion (পরে Eastern Guardian), Madras Circulator and General Chronicle ও Hindu Chronicle পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত Madras Spectator-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাজে অবস্থানকালেই Timothy Penpoem ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Captive Ladie (১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ Visions of the Past প্রকাশিত হয়। এখানে থাকাকালে প্রথমে রেবেকা পরে হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। মাদ্রাজে থাকাবস্থায় তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা শিক্ষা করেন।

এরমধ্যে মধুসূদনের পিতামাতা উভয়ের মৃত্যু হয়। এরপর তিনি তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি  কলকাতা আসেন। সেখানে তিনি প্রথমে পুলিশ কোর্টের কেরানি এবং পরে দোভাষীর কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী (১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে, তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন। এই সময় তিনি বাংলায় নাটক রচনার সংকল্প করেন। এই সূত্রে তিনি কলকাতার পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি মহাভারতের দেবযানী-যযাতি কাহিনী অবলম্বনে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন 'শর্মিষ্ঠা' নাটক। এটিই ছিল প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। এই অর্থে মধুসূদনকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার বলা হয়।

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুটি প্রহসন রচনা করেন। এই দুটি প্রহসন হলো  'একেই কি বলে সভ্যতা' ও 'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'। এই বছরেই তিনি গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচনা করেন 'পদ্মাবতী' নাটক। এ নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার বরেন। এই বছরেই তিনি একই ছন্দে  রচনা করেন 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য'। এই বৎসরে জ্ঞাতিশত্রুদের বিরুদ্ধে মামলা করে পিতৃসম্পত্তি উদ্ধার করেন।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে তিনি রচনা করেন 'মেঘনাদ বধ কাব্য'। এই বৎসরেই আরও দুটি রচনা 'কৃষ্ণকুমারী' ও 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য।
১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে নারী প্রগতিবাদী নাটক বীরাঙ্গনা রচনা করেন। এই বছরে তিনি কিছুদিন হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই বৎসরের ৯ই জুন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যান এবং গ্রেজ-ইন-এ যোগদান করেন।
১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান এবং সেখানে প্রায় দুবছর অবস্থান করেন। এখানে ভার্সাইতে অবস্থানকালে তিনি ইতালীয় কবি পেত্রার্কের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন। তাঁর এই সনেটগুলি ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী নামে প্রকাশিত হয়।

ফ্রান্সে থাকাকালীন সময়ে অর্থকষ্টে পড়লে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে অর্থ দিয়ে সাহা্য্য করেন। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর তিনি ব্যারিষ্টারি পাশ করেন।

১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় ইংল্যান্ড যান এবং ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেজ-ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ৫ই জানুয়ারি দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। কিন্তু ওকালতিতে সুবিধে করতে না পেরে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। কিন্তু দুবছর পর এ চাকরি ছেড়ে তিনি পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবারে তিনি সফল হন, কিন্তু অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর ঋণগ্রস্ত হয়ে বিপদে পড়লে, মধুসূদন তাঁর সম্পত্তি কুড়ি হাজার টাকায় বিক্রয় করে বিদ্যাসাগরকে বিপদমুক্ত করেন।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে তিনি রচনা করেন হেক্টরবধ।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহ দেও-এর আইন-উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।

১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে  তাঁর শেষ রচনা মায়াকানন রচনা করেন। 

তাঁর শেষজীবন অত্যন্ত দুঃখ-দারিদ্রের মধ্যে কেটেছে। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জুন তাঁর স্ত্রী হেনরিয়েটা মৃত্যুবরণ করেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জুন মধুসূদন মৃত্যুবরণ করেন।

মধুসূদন দত্তের রচনাবলি
বাংলা রচনা

ইংরেজি রচনা


সূত্র :
মধুসূদন-রচনাবলী। সাহিত্য সংসদ। কলিকাতা। জুলাই ১৯৮২