মহেশচন্দ্র রায়
ভাওয়াইয়া গীতিকার, সুরকার, শিল্পী।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি (শনিবার, ১৯ মাঘ, ১৩২৫ বঙ্গাব্দ), নীলফামারী জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী গ্রামে, তপশীল শ্রেণিভুক্ত রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বাবুরাম রায়। মায়ের নাম বিমলা রাণী। শিল্পীর জন্মের পাঁচ বছর পরই তার মা মারা যান এবং দাদির আদর যত্নে প্রতিপালিত হন।

পাঁচ-ছয় বছর বয়সে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হন এবং ওই স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। এরপর তিনি কিশোরীগঞ্জ মধ্য ইংরেজী স্কুলে ভর্তি হন। প্রায় এগারো-বারো বছর বয়সে ঐ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন। এরপর তিনি গ্রাম্য যাত্রা, সংকীর্তন প্রভৃতির দলে যোগদান করেন এবং এরই মাধ্যমে গায়ক হিসেবে জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ঠেন। এসময় ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য, তাঁর বাবা তাঁকে নীলফামারীর প্রবীণ উকিল সুরথ কুমার ঘোষের তত্ত্বাবধানে রাখেন। সেখানে সুরথ কুমারের ভাই কামিনী কুমার ঘোষ, তাঁর মাতৃহীন সন্তানের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি অবসর সময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক, নানাবিধ ধর্মগ্রন্থ এবং দৈনিক ও মাসিক সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করতেন। ঘটনাক্রমে দৈনিক বসুমতীর বিশিষ্ট লেখক বলাই দেব শর্ম্মা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভারতবর্ষ অবতার পত্রিকার লেখক বাবু তারা প্রসন্ন মুখার্জীর সাথে পরিচয় হয়। তাঁরা তাঁকে উত্তর বাংলার প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি পুঁথি সংগ্রহ শুরু করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পর সুরথ কুমার ঘোষ পরলোক গমন করলে, তিনি আবারও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নীলফামারী উপজেলার জয়চণ্ডী পুটীহারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে শিক্ষকতা করেন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে, তিনি সংগল্‌শী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামের জোতদার গগণ রায়ের একমাত্র কন্যা বীণাপাণি রায়কে বিয়ে করেন এবং শ্বশুড়বাড়িতে থেকে যান। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে (১৩৪৯ বঙ্গাব্দ) শ্বশুরের মৃত্যু হলে, তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) তাঁর স্ত্রী বীণাপাণি রায় দুটি সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি মাতৃহীন সন্তানদের প্রতিপালন ও সংসার রক্ষারর জন্য ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ) কামিনী বালা রায়কে বিয়ে করেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ছয়টি ছেলে সন্তান রেখে দ্বিতীয় স্ত্রীও মারা যান। এরপর নিজ গ্রামের সরলা বালা নামের এক বিধবাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

তিনি বিগত ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যথাক্রমে দারোয়ানী ঋণ সালিশী বোর্ডের সদস্য (তৎকালীন ঐ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রাক্তন কৃষি মন্ত্রী মরহুম খয়রাত হোসেন), সংগলশী ইউনিয়ন জুট কমিটির চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন ফুড কমিটির সেক্রেটারি, রেলওয়ে হোমগার্ড ক্যাপ্টেন, পরে পাকিস্তান আমলে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য প্রভৃতি পদে নিযুক্ত থেকে প্রমাণ করেছেন কতটা জনসম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। একদিকে নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখা অন্যদিকে শিল্পচর্চা দুটি সমান তালে চলেছে। সমকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেও মহেশ রায় নিজের অবস্থান করে নিয়েছিলেন পাকাপোক্ত। তাঁর নিজ হাতে লেখা আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি জাতীয় গুরু রায় পঞ্চানন বর্ম্মা এম এ.বি.এল. এম বি. ই এম এল সি মহোদয়ের অনুপ্রেরণায় উত্তর বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় ভাওয়াইয়া গান ও কবিতা লেখা শুরু করেন এবং স্বরচিত গান সুর করেন। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শিল্পী জীবনে যাঁরা কাছে এসেছেন, গান গেয়েছেন এবং বন্ধু হয়ে পাশে থেকেছেন, তাঁরা হলেন
উত্তর বাংলার প্রখ্যাত শিল্পী হরলাল রায়, শাহ আফতাব উদ্দিন আহম্মদ (বি এ নজরুল পাঠাগার), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী), অধ্যাপক দীনেশ পাল, অধ্যাপক জাকারিয়া, এমাজ উদ্দিন আহমেদ (সাবেক ভিসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মোস্তফা জামান আব্বাসী, কবি নূরুল ইসলাম (কাব্যবিনোদ), কবি বন্দে আলী মিঞা এবং আরও অনেকে।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিমাসে অনিয়মিত শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী বেতারে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি রংপুর বেতারকেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ির সবকিছু ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে অসুস্থতার কারণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করতে পারেন নি। ভারতের বন্ধুনগর শরনার্থী শিবিরে অবস্থানকালে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ সময় তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের সংকলন 'রক্তলাল' (পুস্তিকা আকারে ভারতে প্রকাশিত) ও প্রচারিত বহু মূল্যবান বইপত্র ও রচনাবলী নষ্ট হয়ে যায়।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে রেডিও বাংলাদেশ ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস আয়োজিত লোকসঙ্গীত অনুষ্ঠানে তিনি যোগাদান করেছিলেন।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাসিক ১০০ টাকা ভাতা দেওয়া শুরু করে। তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম এই ,ভাতা ৫০০ টাকায় পৌঁছেছিল।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল লোকগীতি পরিবেশনের জন্য। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি রংপুর বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি রংপুর কেন্দ্রের বিশেষ শ্রেণীর তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। এ কেন্দ্রে তিনি শেষ অনুষ্ঠান রেকর্ড করেন ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি । ১৬ই মাঘ ১৩৯৯, ১৯৯৩ সালে ২৯ জানুয়ারি, ৫ই শাবান ১৪১৩ শিল্পী মহেশ রায় মৃত্যু বরণ করেন।


গ্রন্থনা : জেসমিন বুলি