মমতাজ আলী খান
লোকসঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার, সুরকার।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার অন্তর্গত ইরতা
কাশিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আফসার আলী খান, মায়ের নাম বেদৌরা খান।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে পিতার কলের গানে গান শুনে শুনে গানের প্রতি বিশেষ
অনুরাগের সৃষ্টি হয়। সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে তিনি গান শেখার জন্য কলকাতা যান।
সেখানে তিনি ওস্তাদ নেসার হোসেন খানের কাছে টানা পাঁচ বৎসর রাগ সঙ্গীতের তালিম নেন।
এর পাশাপাশি ওস্তাদ জমির উদ্দীনখানের কাছে খেয়াল, ঠুমরী, ও গজলের তালিম নেন। এরপর
তিনি প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এন্ট্রাস পাস করেন। বিএ পরীক্ষার সময় তিনি বসন্ত রোগে
আক্রান্ত হন। এরপর তিনি আর এই পরীক্ষা দেন নি।
রাগসঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি তিনি লোকগানের চর্চা করতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি
লোকগানের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। প্রচলিত লোক সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি
তিনি নিজে লোকগান রচনা করা শুরু করেন। একই সাথে অন্যের রচনাতেও সুরারোপ করতে থাকেন।
এই সময় তিনি ওস্তাদ মোহম্মদ হোসেন খসরুর সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর সহায়তায় তিনি
সরকারের সং পাবলিসিটি বিভাগের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে দুটি গান- ‘ওরে শ্যাম কেলে সোনা’ এবং
‘আমি যমুনাতে যাই বন্ধু’ প্রকাশিত হয়।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতার সঙ্গীত হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এই বৎসরে তিনি
অভিযাত্রী ছবিতে কণ্ঠদান করেন। এরপর তিনি মধুচন্দ্রিমা, অশ্রু দিশারী, কলঙ্ক ছবিতে
কণ্ঠদান করেন। কলকাতা বেতারে গান করার সূত্রে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে কে, মল্লিকের
সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। কে. মল্লিকের সূত্রে তাঁর সাথে নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে। এরপর
নজরুল ইসলাম তাঁকে দিয়ে দুটি ইসলামী গান রেকর্ড করান।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতন যান। তিনি রবীন্দ্রনাথকে
ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী ইত্যাদি লোকগান শুনিয়ে আশীর্বাদ লাভ করেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ওস্তাদ আয়েত আলী খানের কাছে দুই বছর সরোদ শেখেন।
সং পাবলিসিটির এক অনুষ্ঠানে তাঁর পরিবেশিত ‘আমার বন্ধুরে আগে বলিস’ গানটি শুনে জসিম
উদ্দীন মুগ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে তিনি জসিম উদ্দীনের বহু গানে সুরারোপ করেছেন।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সং পাবলিসিটি বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন এবং কলকাতা বেতারে স্টাফ
আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন প্রখ্যাত এস্রাজ বাদিকা কাজল খানকে বিয়ে করেন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়, তিনি কলকতা ত্যাগ করে
সপরিবারের ঢাকায় চলে আসেন। এই সময় ঢাকা বেতারকেন্দ্রের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে
তালিকাভুক্ত হন।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে লালন গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন আহমেদের অনুরোধে তিনি
বেশ কিছু লালন শাহের গান বিভিন্ন শিল্পীদের কণ্ঠে রেকর্ড করান।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পিআইএ'র আর্টস একাডেমীতে সঙ্গীত
শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২০ তারিখে তিনি ছুটি না নিয়েই গোপনে করাচি থেকে
ঢাকা চলে আসেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বহু উদ্দীপনামূল গান রচনা করেন এবং
সুরারোপ করেন। তাঁর রচিত 'বাংলা মায়ের রাখাল ছেলে বাঁশী দিল টান,' 'বাংলাদেশের মাটি
ওগো তুমি আমার জন্মস্মৃতি' প্রভৃতি গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে, ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে লোকসঙ্গীত বিভাগ খোলা হলে,
তিনি এই বিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে লোকসঙ্গীত শেখান।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রেডিও টেলিভিশনের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। এছাড়া ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গীত পরীক্ষার অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে আগষ্ট তিনি মৃত্যবরণ করেন।
বিশেষ অবদান
তিনি কবি জসিম উদ্দীন, পাঞ্জুশাহ, পাগলা কানাই, শানাল শাহ ফকির, ভবাপাগলা,
কালুশাহ ফকির, রাধারমন, বাবু হর্ষনাথ গাঙ্গুলি, রঙ্গু শাহবুদ্দিন-সহ অনেকের গানে
সুর করেন। এছাড়া কিছু লালনের গানও সুর করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর সুরে সেসময়
যাঁর লোকগীতি রেকর্ড করেছিলেন, তাঁরা হলেন আব্দুল আলিম, আব্দুল লতিফ, নীনা হামিদ,
লায়লা আর্জুমান্দ বানু, মাহবুবা রহমান, নিলুফার ইয়াসমিন, মীনা বড়ুয়া প্রমুখ।
সম্মাননা :
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে গীতিকবি সংসদ পদক লাভ করেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক লাভ করেন।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কালু শাহ পদক পান।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি যে সকল সম্মাননা পান, তা হলো
−
জাতীয় রবীন্দ্র পরিষদ পদক, লালন একাডেমী পদক, নজরুল একাডেমী পদক, পতাকা পদক,
মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সঙ্গীত একাডেমী পদক।