হাজী মোহাম্মদ মহসিন
১৭৩২-১৮১২ প্রখ্যাত বাঙালি জনহিতৈষী ব্যক্তি। দানশীলতার জন্য তিনি দানবীর খেতাব পেয়েছিলেন। ধর্মের দিক থেকে তিনি ছিলেন শিয়া মতাদর্শী মুসলমান।

১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি'র হুগলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজি ফয়জুল্লাহ ছিলেন একজন ধনী জায়গিরদার। তিনি ইরান থেকে বাংলায় এসে হুগলীতে বসবাস শুরু করেন এবং জয়নাব খানমকে বিবাহ করেন। উল্লেখ্য জয়নাব ছিলেন ফয়জুল্লাহ'র দ্বিতীয় স্ত্রী। ফয়জুল্লাহ ছিলেন । তিনি জয়নব ছিলেন ফয়জুল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রী। আবার জয়নবেরও পূর্বে বিয়ে হয়েছিল। জয়নবের আগের স্বামীর নাম ছিল আগা মোতাহার। এঁদের মন্নুজান খানম নামৈ একটি মেয়ে ছিল। আগা মোতাহারও বিপুল সম্পদের মালিক ছিলেন। হুগলী, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় তার জায়গির ছিল। আগা মোতাহারের সম্পত্তি তার মেয়ে মন্নুজান উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন।

তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল সৎ বোন মন্নুজানের কাছে। পরে স্থানীয় প্রাধমিক শিক্ষালায়ে শিক্ষা শুরু হয়েছিল । পিতার মৃত্যুর পর তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব নেন মন্নুজান। স্থানীয় স্কুলের পাঠ সম্পন্ন করার পর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি তৎকালীন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ যান। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি দেশ ফিরে আসেন এবং তাঁর বোনের সাথে হুগলীর নায়েব ফৌজদার মির্জা সালাহউদ্দিনের বিবাহ দেন। এরপর তিনি দেশভ্রমণের সফরে বের হন। এই সফরকালে তিনি হজব্রত পালন করেন। এরপর তিনি মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করেছেন। সফর শেষে তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর পর দেশে ফিরে আসেন।

তাঁর স্বামীর অকালমৃত্যুর পর, তিনি পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাঁর নিজের সম্পত্তি এবং বিধবা বোনের সম্পত্তির দেখাশোনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সম্পত্তি লাভের পর থেকে তিনি দুঃস্থ মানুষের কল্যাণের জন্য উপার্জিত অংশ ব্যয় করার ব্রত গ্রহণ করেন। এই সময় সাহায্যের জন্য তাঁর কাছে আগত কোনো লোককে বিমুখ করতেন না। এছাড়া নিজে খোঁজখবর নিয়ে বিভিন্ন মানুষকে সাহায্য করতেন। ১৭৬৯-৭০ খ্রিষ্টাব্দের সরকারি দলিল অনুযায়ী তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি বহু লঙ্গরখানা স্থাপন করেছিলেন। এছাড়া সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেছিলেন।

১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে মন্নুজানের মৃত্যুর পর মহসিন তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদের মালিক হন। এরপর থেকে তাঁর সাহায্যের পরিমাণও বেড়ে যায়। এই সহায়তার কার্যক্রম যথাযথভাবে প্রতিপালন যাতে হয়, সে কারণে তিনি ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে 'মহসিন ফান্ড' নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাতে দুইজন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। বিষয় হিসেবে তহবিলের সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করেছিলেন। এগুলো হলো- ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের জন্য তিনটি ভাগ, পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডের জন্য চারটি ভাগ এবং মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য দুইটি ভাগ। পরবর্তী সময়ে এই তহবিল থেকে দান করা হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জন্য। হুগলীর হুগলী মহসিন কলেজ, চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় মহসিনের ওয়াকফকৃত অর্থ ব্যবহৃত হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠেছিল দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও মহসিন ফান্ডের অর্থে অসংখ্য দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামরাখা হয়েছিল 'মহসিন হল'। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাটির নাম 'বিএনএস হাজি মহসিন' রাখা হয় তাঁর স্মরণে

১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে নভেম্বর হুগলীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে হুগলী ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।