মুজতবা আলী, সৈয়দ
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট রম্যলেখক।

১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ সিকান্দার আলী, মায়ের নাম আয়তুল মান্নান খাতুন।  তাঁর অপর দুই বড় ভাইয়ের নাম সৈয়দ মোস্তফা আলী এবং সৈয়দ মুর্তজা আলী। একমাত্র বোন সৈয়দা হাবিবুল্লাহ। বর্তমানে সবাই মৃত।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুনামগঞ্জ শহরের পাঠশালাতে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মৌলবীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পিতার চাকারীর কারণে তিনি কিছুদিন পর সিলেটে চলে আসেন এবং তিনি সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম দিকের ছাত্র। এখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দী, গুজরাটি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও ইটালিয়ান ভাষাশিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর তিনি উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ অধ্যাপনার জন্য কাবুলে যান। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে তিনি ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষার শিক্ষক ছিলেন। 

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি-সহ জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এই অধ্যায়ন চলাকালীন সময়ে, তিনি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কিছুদিন প্যারিস ও লণ্ডনে অধ্যায়ন করেন। এরপর বন-এ ফিরে যান এবং ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ডি.ফিল লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব । এরপর ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতা ও মৌলবী বাজারে তাঁর পিতা মাতার সাথে কিছুদিন কাটান। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। প্রথমে চার মাস তিনি জার্মান ও অস্ট্রিয়া ভ্রমণ করেন। পরবর্তী ছয়মাস তিনি ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে কাটান। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য শহরগুলো হলো ডেসড্রেন, ভেনিস, লজান, মন্ত্রো, লুৎসেন,  জুরিখ ইত্যাদি। ১৯৩৪-১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিশরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর থিসিসপত্র "The origin of the Khojalis and their religious life today" গ্রন্থাকারে জার্মানী থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আবার ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতে ফিরে এসে প্রথমে তিনি সিলেটে তাঁর পিতার সাথে দেখা করতে যান। এর তিনি বরোদা কলেজে পূর্বপদে যোগদান করেন এবং ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই কলেজেই শিক্ষক হিসাবে ছিলেন। এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের পর তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু বৈরী পরিবেশে এখানে তিনি টিকতে না পেরে আবার ভারতে ফিরে যান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ  ঢাকাস্থ রাবেয়া আলীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। ১৯৫০- ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীতে
Secretary Indian Council For Cultural Relations সাকায়তুল হিন্দ্ (ভারতীয় সংস্কৃত) নামক একটি আরবী পত্রিকা সম্পাদন করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী অলইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি করেন। ১৯৫৪-১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এয়ার কটক স্টেশনের ডিরেক্টর হন। এরপর ১৯৫৫-১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এয়ার পাটনা স্টেশনের ডিরেক্টর হন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মান ভাষার অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। পরে তিনি ইসলামী সংস্কৃতির অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যাণ্ড যান এবং বিবিসিতে বক্তৃতা করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান ভ্রমণ করেন। ১৯৬৪-৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বোলপুরে বসবাস করেন। এর ভিতরে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মানী ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারিতে তিনি ঢাকা আসেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর তিনি কলকাতায় ফিরে যান এবং ডিসেম্বরে আবার ঢাকাতে ফিরে আসেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকাতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যকালে তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্র উপস্থিত ছিলেন।

পুরস্কার
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নরসিং দাস পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে পান আনন্দ পুরস্কার।

তাঁর রচনা
শান্তিনিকেতনে পড়ার সময়, বিশ্বভারতী নামক হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন। পরবর্তীতে তিনি 'সত্যপীর' , 'ওমর খৈয়াম', 'টেকচাঁদ',  'প্রিয়দর্শী' প্রভৃতি ছদ্মনামে
দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতিতে কলাম লিখেন।

গ্রন্থতালিকার বর্ণানুক্রমিক সূচি

অবিশ্বাস্য (জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১)
কত না অশ্রুজল (নববর্ষ ১৩৭৮)
চতুরঙ্গ (ভাদ্র ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ)
চাচা কাহিনী (আষাঢ় ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)
জলে ডাঙ্গায় (মাঘ ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ)
টুনিমেম (চৈত্র ১৩৭০)
তুলনাহীনা (বৈশাখ ১৩৮১ )
ধূপছায়া (পৌষ ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ)
দু-হারা (ফাল্গুন ১৩৭২)
দেশে বিদেশে (বৈশাখ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ)
দ্বন্দ্ব মধূর (বৈশাখ ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ)
পঞ্চতন্ত্র (প্রথম পর্ব। আষাঢ় ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)
           (দ্বিতীয় পর্ব। চৈত্র ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ)
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় (ফাল্গুন ১৩৮২)
পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (বৈশাখ ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ)
প্রেম (অনুবাদ). (শ্রাবণ ১৩৭২)
বড়বাবু (ফাল্গুন ১৩৭২)
ভবঘুরে ও অন্যান্য (জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৯)
ময়ূরকণ্ঠী  (চৈত্র ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)
মুসাফির (অগ্রহায়ণ ১৩৭৮)
রাজা-উজির (বৈশাখ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ)
শবনম (রাখী পূর্ণিমা ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ)
শহর-ইয়ার (ভাদ্র ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ)
হিটলার (রথযাত্রা ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)


সূত্র : সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।