নজরুল ইসলাম, সৈয়দ
বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) জসোদল দামপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।


তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে। এরপর তিনি কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করেনপরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হন।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে দুইটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল
য়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. (অনার্স) পাশ করেন। এই সময় তিনি সলিমুলাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ৷
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সময়, সিলেট কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে এ নিয়ে যে গণভোটের আয়োজন করা হয়, তাতে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালাতে সৈয়দ নজরুল একদল ছাত্র নিয়ে সিলেট যান। এখানেই তাঁর সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন। এই বৎসর থেকে তিনি সক্রীয়ভাবে রাজনীতিতে আসেন। এই বৎসরে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন ৷
১৯৪৮
খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে আনন্দমোহন কলেজে যোগদান করেন৷
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হবার পর সরকারি চাকুরী পান।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে কটিয়াদীর বেগম নাফিসা ইসলামের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারি চাকুরিতে ছেড়ে দিয়ে আবার ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সময়, তিনি সর্বদলীয় একশন কমিটির -এর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এল.এল.বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ৷
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন৷
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন৷
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ ইডেন চত্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন ৷
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আইয়ুব সরকার আওয়ামীলীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেন।  ৯ই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা নামের একটি তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই মামলায় শেখ মুজিবুরের অন্যতম আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণঅভ্যূত্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। তিনি এ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সম্মিলিত নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে আসেন। তিনি ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির আট দফা এবং ছাত্র সমাজ ঘোষিত ১১ দফা কর্মসূচির মাঝে খুবই দক্ষতার সাথে সমন্বয় সাধন করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এই অস্থিরতা দূর করার লক্ষ্যে ২৬শে ফেব্রুয়ারি এবং পরে ১০-১৩ মার্চ দু'দফা, রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে বৈঠক হয়৷ এই বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা হিসেবে এ সময় বৈঠকে যোগদান করেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ৷ এই  জয়লাভের পর তিনি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ,  দুপুরবেলা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চিফ মারফত গোপন খবরে অবগত হন যে, রাতে সেনাবাহিনী অভিযান চালাতে পারে। এরপর বঙ্গবন্ধু সকল নেতাদের গোপন আশ্রয়ে যাবার নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি নিজে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে থেকে যান। ২৫শে মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন।

 সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই রাতে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎ‍সক ডা. আলীম চৌধুরীর বাসায় ছিলেন। ঢাকায় কারফিউ শিথিল হলে, তিনি  ডা. চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর সহায়তায় বিধবা মহিলার পোশাক ও পরচুলা পরে, রিকশাযোগে নরসিংদী চলে যান। পথে দু'বার পাক আর্মি রিকশা থামায়। চালক জানায়, আমার অসুস্থ বিধবা মাকে রিকশায় করে নিয়ে যাচ্ছি। এরপর তিনি কটিয়াদী চলে যান। তাঁর অবস্থানের খবর জানাজানি হয়ে গেলে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে আসাদুজ্জামান সাহেবের বাসায় আশ্রয় নেন। এরই মাঝে রাতে তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ আশরাফ ও হামিদুল হক। তাঁরা জিপে করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়ে যান হালুয়াঘাট সীমান্তে। মধ্যরাতে তাঁরা হালুয়াঘাট পৌঁছেন। ভোর হবার আগেই সীমান্ত পাড়ি দেন। এবং তিনি কলকাতায় চলে আসেন।

ইতিমধ্যে আগে ভারতে চলে যাওয়া তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার বিষয়ে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাবার সাথে সাথে একটি স্বাধীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়াও এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তাজউদ্দিনের সাথে তাঁর দেখা হলে, উভয় মিলে একটি সরকার গঠনের নকশা প্রণয়ন করেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এই প্রজ্ঞাপনটি ছিল

"আইনের ধারাবাহিকতা বলবত্করণ আদেশ ১৯৭১

মুজিবনগর, বাংলাদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার ১২ চৈত্র ১৩৭৭

আমি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এ আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। এই রাষ্ট্র গঠন বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে, সকল সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে কাজে বহাল ছিলেন, সেই একই শর্তে তারা চাকুরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সকল জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধি যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সকল সরকারি কর্মচারীকে স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।"

১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী সরকারের তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের পর তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ৷ অক্টোবর মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ দিল্লী সফরে আসেন। তখন ইন্দিরা গান্ধী, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন এবং ব্রেজনেভের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। সে বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি করেন। ইন্দিরা গান্ধী যথাসময়ে হবে বলে, তাঁকে আশ্বস্থ করেন।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ৷এই বৎসরের নবগঠিত সরকারের মন্ত্রীসভায় ও তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ৷ জাতীয় সংসদে তিনি উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৷পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুকে  সপরিবারে হত্যা করার পর তাঁকে প্রথমে গৃহবন্দী করা হয়। এবং ২৩শে আগস্ট, তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়।  কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায়, ৩রা নভেম্বর তাঁকে হত্যা করা হয়। এই সময় উল্লেখযোগ্য অপর তিন নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়েছিল।


তথ্যসূত্র :
১. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি - আমীর-উল-ইসলাম।
২. বাংলাপিডিয়া।
৩. সাপ্তাহিক ২০০০ - প্রকাশিত স্মৃতিকথা: সংগ্রাম ও আদর্শের সৈনিক।
৪. দৈনিক প্রথম আলো - প্রকাশিত কলাম।
পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।