নির্মল সেন
১৯৩০-২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ
বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও লেখক।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা আগষ্ট তারিখে গোপালগঞ্জ জেলার কাটালীপাড়া উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামে  জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতা নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ছিলেন কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউটের গণিতের শিক্ষক। মা নাম লাবণ্য প্রভা ছিলেন গৃহবধূ। ছয় ভাই-বোনের ভিতরে তিনি ছিলেন চতুর্থ।

নির্মল সেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউটে লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন টুঙ্গিপাড়ার এক স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১২ বৎসর বয়সে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর 'ভারত ছাড়' আন্দোলনে ১২ দিন স্কুল গেটে অবস্থান ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি বি.এম একাডেমীতে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তাঁর পিসির বাড়িতে থাকতেন। এখান থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর তিনি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এসএসসি পাশ করেন।

 ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রজমোহন কলেজে অধ্যয়নকালে ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত হন এবং এই সূত্রে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের শেষে মুক্তি লাভ করেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের বরিশাল কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বৎসরে সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে মুসলীম লীগ একটি হত্যা মামলা দায়ের করলে- পরবর্তী তিন বৎসর তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। এই সময়ে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে শহীদ সোহরাওয়ার্দির সাম্রাজ্যবাদ ঘঁষা পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন চলাকালীন সময়ে ডাকসু নির্বাচনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি প্রার্থীর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য তাঁর উপর চাপ দেয় এবং নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টা পূর্বে শহীদুল্লাহ হল (তৎকালীন ঢাকা হল) থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এই বৎসরে আয়ুব খানের সামরিক শাসনে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সূত্রে রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে কলাভবন এলাকায় তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এই সময় তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসাবে সাংবাদিকতার জগতে আসেন। এই বছরের ২৭ অক্টোবর তারিখে আয়ুব খানের সামরিক আইনে তাঁকে গ্রফতার করা হয়।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জেলখানা থেকে প্রথমে বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। পরে তিনি জলেখানা থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন।

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের তিনি মুক্তি পান এবং দৈনিক জেহাদে সাংবাদিক হিসাবে যোগদান করেন।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় পাশ করেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এই বৎসর তিনি 'দৈনিক পাকিস্তান' পত্রিকায় যোগদান করেছিলেন। ১৯৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন উপেক্ষা করে চটকল শ্রমিকরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছিল- তিনি তার নেতৃত্বদান করেছিলেন। এই সময় তিনি ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা এবং গণযোগাযোগ বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল গঠন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে  ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩-৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসাবে ছিলেন। ১৯৭৯-৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮২-৯১ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পাঁচদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং কারাবরণ করেছিলেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে তিনি বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের- ব্যানারে ছাতা মার্কায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছিল- ঢাকা-১০ (তেজগাঁ-রমনা)।

২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রেইনস্ট্রোকে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা পরবর্তী সময় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার দীঘিরগ্রামে নিজ বাড়িতেই বসবাস করতে থাকেন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৪ ডিসেম্বর তাকে ঢাকায় এনে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য রচিত গ্রন্থাবলী

মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র
বার্লিন থেকে মস্কো
পূর্ব বঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ
মা জন্মভূমি
লেনিন থেকে গর্বাচেভ
আমার জবানবন্দী
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই
আমার জীবনে '৭১-এর যুদ্ধ