পাবলো পিকাসো
প্রখ্যাত স্পেনিশ চিত্রকর ও ভাস্কর। চিত্রকর্মে কিউবিজম অধ্যায়ের প্রবর্তক। ২ হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন একজন শান্তিবাদী এবং সাম্যবাদী। তিনি আমৃত্যু ফরাসি কমিউনিষ্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

তাঁর সংক্ষিপ্ত নাম পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso)। তাঁর মূল নামটি ২৩টি শব্দ নিয়ে তৈরি। এই নামের ভিতরে রয়েছে তাঁর আত্মীয় পরিজন এবং সাধু-সন্তদের নাম। এই নামটি হলো

Pablo Diego José Francisco de Paula Juan Nepomuceno María de los Remedios Cipriano de la Santísima Trinidad Martyr Patricio Clito Ruiz y Picass (পাবলো দিয়েগো জোসে ফ্রান্সিসকো দে পাউলা জুয়ান নেপমুসেনো মারিয়া দে লস রেমেদিওস সিপ্রিয়ানো দে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ মার্টির পাট্রিসিও ক্লিতো রুইজ ই পিকাসো।)

The picador ১৯৮০

১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর স্পেনের শহর মালাগায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম ছিল মারিয়া পিকাসো ই লোপেজ এবং পিতার নাম খোসে রুইজ ব্লাস্কো। কথিত আছে পিকাসো ভুমিষ্ট হওয়ার পর ধাত্রী ভেবেছিলেন মৃতশিশুর জন্ম হয়েছে। এই কারণে ধাত্রী শিশুটিকে একটি টেবিলের উপর রেখে তার মায়ের সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় পিকাসোর চাচা এগিয়ে এসে মুখে থাকা সিগারেটের ধোঁয়া শিশুটির মুখে নিক্ষেপ করেন। এরপর পিকাসো নড়েচড়ে উঠেন।

পিকাসোর ছবি আঁকায় হাতে খড়ি হয় তাঁর পিতার কাছে। উল্লেখ্য তাঁর পিতা ছিলেন স্থানীয় চিত্রকলা বিদ্যায়তনের প্রশিক্ষক। শিক্ষানবীশকালে তাঁর আঁকা প্রথম ছবিটি হলো
The picador। এই ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে পিকাসো তাঁর পিতামাতার সাথে স্পেনের
A Coruña শহরে চলে আসেন। এখানে তাঁর পিতা স্কুল অফ ফাইন আর্টস-এর অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। এখানেও তিনি অজস্র ছবি আঁকেন। এর ভিতরে পাওয়া যায় ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আঁকা দ্বিতীয় চিত্রকর্ম House in the field। এটি মূলত ল্যাণ্ডস্কেপ। ক্যানভাসে আঁকা এই তৈলচিত্রটির মাপ ১৫.৮x২৩ সেন্টিমিটার। ছবিটি স্পেনের বার্সেলোনা'র Museu Picasso-এর সংরক্ষিত আছে। এই বৎসরে একটি ভাস্কর্য তৈরি করে করেন। Plaster-male-torso নামক এই বাস্তবধর্মী ভাস্কর্যটিকে তাঁর তৈরি প্রথম ভাস্কর্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ডিপথেরিয়া রোগে তাঁর বোন Conchita মারা যায়। এরপর শোকাহত এই পরিবার বার্সেলোনায় চলে আসে। এখানে তাঁর পিতা স্কুল অফ ফাইন আর্টস-এ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি নিজ যোগ্যতা বলে এ্যাডভান্স লেবেলে ভর্তি হ‌ওয়ার সুযোগ লাভ করেন। এর কিছুদিন পর পিকাসোর বাবা এবং চাচা তাঁকে মাদ্রিদের The Real Academia de Bellas Artes de San Fernando (Royal Academy of Fine Arts of San Fernando) বিদ্যায়তনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই প্রথম তিনি পরিবার ছেড়ে দূরে চলে যান।

১৮৯৫-৯৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পিকাসো বাস্তবধর্মী ছবি এঁকেছেন। এর কিছু এঁকেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের সূত্রে। আর কিছু এঁকেছিলেন নিজের ভাবনা থেকে। এই সময়ের ছবিগুলো ক্যানভাসে আঁকা তৈলচিত্র। একমাত্র
Artist's mother ছবিটি ছিল জলরঙে আাঁকা। এই সময়ের অধিকাংশ চিত্রকর্মই মানুষের। এর ভিতরে রয়েছে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আঁকা তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি (Self-Portrait)। প্রাকৃতিক দৃশ্য (ল্যান্ডস্কেপ) রয়েছে একটি। ছবিটির নাম Quarries। এই সময়ের অনেক চিত্রকর্ম হারিয়ে গেছে বলে অনেকে অনুমান করেন। বর্তমানে এই সময়ের যে চিত্রকর্মগুলো পাওয়া যায়, তার একটি সাম্ভাব্য তালিকা নিচে দেওয়া হলো

Science and Charity ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পিকাসো ক্রমে ক্রমে বাস্তবধর্মী ছবি থেকে প্রতীকধর্মী ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকে পাড়েন। এই সময়ে আঁকা বিজ্ঞাপনচিত্রে (Advertisement for tavern "Four cats") এর আভাষ পাওয়া যায়, তাঁর এই পরিবর্তনের ধারায়। তবে এই সময়ে তাঁর কিছু বাস্তবধর্মী ছবি পাওয়া যায়। এই ছবিগুলো অঙ্কন কৌশলের দিক থেকে বাস্তবধর্মী, কিন্তু ভাবের দিক থেকে দ্বান্দিকতার প্রতীক। এই বিষয়টি পাওয়া যায়, তাঁর  Science and Charity চিত্রকর্মে।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দকে বলা যায়, পিকাসোর বাস্তবধর্মী চিত্রকর্ম থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টার বৎসর। ফলে এই বৎসরে তাঁর কাছ থেকে পাই নানা ধরনের পরীক্ষামূলক ছবি। এই বৎসরে তাঁর ভিতরে নিজেকে ভাঙার অস্থিরতা চরম অবস্থায় পৌঁছায়। তিনি এই পর্যায়
Head of a Man in El Greco style এবং Portrait of Casagemas নামের দুটি ছবি আঁকেন। এই ছবি দুটি, যেন ছবিটিকে বাস্তবধর্মী হয়েও যেন তা নয়। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তাঁর ছবি অভিব্যক্তিবাদী (Expressionism) এবং অন্তর্মুদ্রাবাদ (
Impressionism) আদর্শের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময়ের তাঁর আঁকা La chata চিত্রকর্মটি তাঁর প্রথম অভিব্যক্তিবাদী চিত্রকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে Lola হলো তাঁর প্রথম অন্তর্মুদ্রাবাদী ছবি। এই ধারার দ্বিতীয় চিত্রকর্মটি হলো Portrait of Josep Cardona

 এই সময়ের আঁকা ছবির সাম্ভাব্য তালিকা নিচে দেওয়া হলো।

পিকাসো ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইউরোপের শিল্প-সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যারিসে এলেন। তিনি তাঁর প্যারিসের একজন বন্ধু ম্যাক্স জেকব-এর সাথে দেখা করলেন। জ্যাকব ছিলেন সাংবাদিক এবং কবি। এই বন্ধুর কাছে তিনি ফরাসি ভাষা এবং সাহিত্যের সাথে পরিচিত হলেন। একসময় তাঁরা একত্রে একটি বাসা নিলেন। অর্থের সাশ্রয়ের জন্য একটি বাসা ভাগাভাগি করে তাঁরা বাস করতেন। জেকব রাতে ঘুমাতেন আর দিনে কাজ করতেন। অন্যদিকে পিকাসো রাতে কাজ করতেন, আর দিনে ঘুমাতেন। এই সময় উভয়ের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, পিকাসোর অনেক কাজ আগুনে পোড়াতেন ঘর গরম রাখার জন্য। এর ভিতরে যে চিত্রকর্মগুলো টিকে গিয়েছিল, তার সংখ্যাও কম নয়। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভিতরে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখান থেকে পুরো বেরিয়ে আসতে পারেন নি এই বৎসরে। এই সময় পিকাসো কিছু অভিব্যক্তিবাদী ছবি এঁকেছেন। তবে অন্তর্মুদ্রাবাদী ছবির ক্ষেত্র থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছিলেন। এই জাতীয় ছবিকে চিত্র-সমালোচকরা নাম দিয়েছেন অন্তর্মুদ্রাবাদী-উত্তর (Post-Impressionism) চিত্র। এই জাতীয় ছবির সাথে তিনি প্রতীকধর্মী (Symbolism) মাত্রা যুক্ত করার কাজ করেছেন এই বৎসরেই। এর বৎসরে একমাত্র বাস্তবধর্মী পাওয়া যায়, তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি (Self-Portrait)। এই বৎসরেই তিনি প্রথম  Art Nouveau (Modern) -ধর্মী ছবি আঁকেন। কয়লায় আঁকা এই ছবিটির নাম The cries of virgins

 a-blue-room-a-tub ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের শুরু প্রথম ছয় মাস মাদ্রিদে কাটান। এই সময় তার বন্ধুর সাথে  Arte Joven (Young Art)- নামে মাদ্রিদ থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছি ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ। এই সময় থেকে পিকাসো তাঁর ছবিতে Picasso স্বাক্ষর করা শুরু করেন। এর আগের ছবিগুলোতে তাঁর স্বাক্ষর ছিল Pablo Ruiz y Picasso। ছয়মাস পরে পিকাসো আবার প্যারিসে ফিরে আসেন।

১৯০১ থেকে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পিকাসোর ছবিকে নীল-অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই সময়ের ছবিতে তিনি নীল বা নীলাভ-সবুজ রঙের আভা ব্যবহার করেছন। অবশ্য নীল-অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে অঙ্কিত A spanish couple in front of inn, Embrace, Gypsy in front of Musca, Pierrot and Colombina ছবিগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু এর পূর্ণতা পায় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে। নীল-অধ্যায়ে তিনি অন্যান্য রঙের ছবিও এঁকেছেন।

চলছে.....

১৯১৮ সালে তিনি রুশ নর্তকী ওলগা খোকলোভাকে বিয়ে করেন। কিন্তু পিকাসোর ভবঘুরে জীবনযাপনে পরবর্তীকালে তাদের সংসার ভেঙে যায়। পরে মেরি থেরেসে ওয়াল্টারের গর্ভে এক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। মেরির সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের প্রণয় ছিল। মেরির আশা ছিল পিকাসো একদিন তাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় পিকাসোর মৃত্যুর ৪ বছর পর মেরি আত্মহত্যা করেন। নারী সংসর্গের বহু বৈচিত্র্য তার চিত্রকর্মে ফুটে ওঠে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পিকাসো ফ্রান্সের কমুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন ।


১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে ফ্রান্সের মুগী শহরে তিনি মৃতুবরণ করেন।

চলছে...........


সূত্র :
http://www.biography.com/people/pablo-picasso-9440021#early-life-and-education
http://www.wikiart.org/en/pablo-picasso/