পিট সিগার
ইংরেজি:
Pete Seeger

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী, সংরক্ষক এবং  প্রচারক। এছাড়া সংগীতকে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করে আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে তিনি লড়াই করে গেছেন আজীবন।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা মে নিউ ইয়র্কের প্যাটারসন নামক এক মফস্বল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।। তাঁর মা কনসট্যান্ট এডসন সিগার ছিলেন একজন নিপুণ বেহালা বাদক এবং বাবা চার্লস সিগার ছিলেন নিউইয়র্কের সঙ্গীতবিদ্যালয় 'জুলিয়ার্ড'-এর একজন সংগীতশিক্ষক। শৈশবে সংগীতের প্রতি তাঁর কোন ঝোঁক ছিল না। তাঁর মা তাঁকে বেহালা শেখানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাঁর বাবা সঙ্গীত শিক্ষার বিষয়ে ততটা চাপ দেন নি। তিনি শৈশবে কোনো স্বরলিপি অনুসরণ করে গানের তালিম নেন নি। শুধু কানে শুনে, অনুশীলনের মাধ্যমে শেখেন পিয়ানো, এ্যাকর্ডিয়ান বাজানো শেখেন। তাঁর আট বৎসর বয়সের সময়, পিতা-মাতার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ফলে তিনি স্কুল বোর্ডিং-এ বড় হয়ে উঠেন।

স্কুলে তিনি নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি সঙ্গীত, সাংবাদিকতা এবং মার্কসবাদ শেখেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করার সুবাদে তিনি বৃ্ত্তিসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। এখানে এসে তিনি মার্ক্সবাদী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে তাঁর বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতে না পেরে, লেখাপড়া ছেড়ে দেন।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে গ্রীষ্মকালে এ্যাশভিলেনের একটি লোকজ মেলায় গিয়ে তিনি ব্যানজো (Banjo) বাদ্যযন্ত্রের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেন। কারণ, এই যন্ত্রটি মার্কিন লোকসঙ্গীতের সাথে ঐতিহ্যগতভাবে যুক্ত ছিল। এছাড়া লোকসঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণটাও ছিল তীব্র। লোক সঙ্গীতের সরল সুরে তিনি বিশেষভাবে আনন্দ  পেতেন।

তারপরেও  তিনি পেইন্টিংয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনি জলরঙ-এর উপর জ্ঞান লাভের জন্য নিউ ইংল্যান্ডে আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি একটি পাপেট দল গঠন করেন ও সেটি নিয়ে নিউইয়র্ক ভ্রমণ করেন। সেসময় নিউ ইয়র্কে ডেইরী ফার্মার্স ইউনিয়নের ধর্মঘট চলছিলো। তারা তাদের দাবির সমর্থনের লক্ষ্যে একটি কনসার্ট ও র‌্যালির আয়োজন করে। পিট সিগার সেই কনসার্ট ও র‌্যালিতে শামিল হন। এধরনের কনসার্টে এটাই ছিলো তার প্রথম অংশগ্রহণ। যা তাঁকে আকস্মিক ভাবে সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে আগ্রহী করে তোলে এবং এখান থেকেই তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু। লোকসঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে উৎসাহিত করে লোকসঙ্গীতের উৎস খুঁজতে। তিনি এ উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং নানা ধরনের লোকসংগীত সংগ্রহ করা শুরু করেন। এ কাজে তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন সংগীতজ্ঞ এ্যালান লোমেক্স
(Alan Lomex) কে। এই ভ্রমণকালে তিনি প্রচুর গান, লুলাবাই, লোক গান এবং ব্যালাড সংগ্রহ করেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা মার্চ, অভিবাসী শ্রমিকদের এক বেনিফিট কনসার্ট-এ এ্যালান লোমেক্স, পিট সিগারের সাথে আরেক বিখ্যাত লোকসঙ্গীত গায়ক  উডি গাথরি (Woddy Guthrie)-র  পরিচয় করিয়ে দেন।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে পিট সিগার আর উডির উদ্যেগে গঠিত হয়
Almane Singers নামে একটি গানের দল। এঁদের উদ্দেশ্য ছিলো সঙ্গীতের মাধ্যমে সামাজিক অবিচার রোধ করা এবং এক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি করা। সমকালীন সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে তাঁরা লোকসুরের আদলে বক্তব্যসমৃদ্ধ গান সৃষ্টি করেন। প্রথমদিকে তাদের "The Talking Union Blues" নামক শ্রম-সংগীত মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এছাড়ায় "ফ্যাসিজম" এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেওয়ার উদ্দেশ্যে "The Balled of October 16" শিরোনামে একটি শান্তিবাদী গান রচনা করেন। এরই মধ্যে পিট, লোমেক্স ও রিঙহাম (Wringham) প্রাচীন ও প্রচলিত লোক সংগীত সংরক্ষণের উদ্যেগ গ্রহণ করেন। তাঁরা People's Music Library নামে একটি আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী পিটকে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। সেখানে তিনি নতুন উদ্যমে
Soldier Song সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং সংগৃহীত গানগুলি People's Music Library-তে নিয়মিত পাঠাতে থাকেন। সমাজের নানা অসংগতির সমালোচনা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির সহায়তার জন্য, Almane Singers পক্ষ থেকে Sign Out নামে তিনি একটি লোক-সাহিত্যভিত্তিক একট পত্রিকা প্রকাশ করা করেন। তবে এই সংগঠনটি ভেঙে গেলে, পিট সিগার ১৯৪৮ সালে লি হায়জ (Lee Hays) কে সঙ্গে নিয়ে "The Weavers" নামক একটি ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের মাধ্যমে তাঁরা তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি সাংস্কৃতিক আঘাত হানা শুরু করেন। এই সময়ের গানের মধ্যে বিখ্যাত গান ছিল "Kisses sweater then wine", "Good night Irene" এবং "On top of old smooky"। ফলে অচিরেই এই ব্যান্ড শাসক গোষ্ঠির শত্রুতে পরিণত হয়। পিটের বামপন্থী মনোভাব এবং সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করার জন্য তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মূখীন হতে হয়। সরকার তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করে এবং তাদের ব্যান্ডের ভেতর ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে। এই সময় তাদের পূর্ব নির্ধারিত অনেক কনসার্টই সরকারের অনুমোদন না পেয়ে বাতিল হয়ে যায়।

এছাড়া ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকা বিরোধী কার্যকলাপ পর্যবেক্ষক সমিতির সামনে তাদেরকে উপস্থিত হতে হয়। তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে তাকে ১৭ বছর কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিগার রচনা করেন বিখ্যাত "Where have all the flowers gone" গানটি। এই গানটির জন্য সিগার, আর্থার মিলার-সহ ৬ জনের বিরুদ্ধে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
The Weavers ত্যাগ করে একক ভাবে গান গাওয়া শুরু করেন। তিনি সেই সময় থেকে বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাসে বা কফি হাউজে গান করতেন। এরা দ্বারা তিনি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হন।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তাকে আদালত অবমাননার দায়ে ১০ বছরের কারাভোগের শাস্তি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে যথোপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে মামলা বাতিল হলে তিনি কারা মুক্ত হন। এসময় ABC TV সিগারের এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে মুনাফা লাভের জন্য এগিয়ে এলেও কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য তারা সিগারকে ত্যাগ করে।

ষাটের দশকে তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় হতো সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। এই সময় তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় যান করেন। তিনি একটি প্রাচীন আধ্যাত্মিক গানকে নতুন ভাবে উপস্থাপন করেন। গানটি ছিলো
"We shall overcome"। অনেকে মনে করেন, গানটি পিট সিগারের রচনা। মূলত পিট সিগার এই গানটিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গাওয়া রেকর্ডের মাধ্যমে। এক তিনি সাক্ষাৎকারে জানান

Nobody knows exactly who wrote the original. The original was faster. [Sings] “I’ll be alright, I’ll be alright, I’ll be alright, someday….deep in my heart I do not weep, I’ll be alright someday.” Or “deep in my heart I do believe.” And other verses are “I’ll wear the crown, I’ll wear the crown,” and “I’ll be like Him, I’ll be like Him” or “I’ll overcome, I’ll overcome.”

[সূত্র: http://wendyschuman.com/articles/223-2/ ]

আদি এই গানের Him শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল যিশুখ্রিষ্ট-এর সর্বনাম হিসেবে। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে আফ্রিকান-আমেরিকান সঙ্গীত রচয়িতা Charles Albert Tindley আদি গানের আদলে তৈরি করেন We will overcome"। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লস্টন শহরের এক শ্রমিক ধর্মঘটে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রমহিলা গানটি তালছাড়া গেয়েছিলেন। এই গানটি বিভিন্ন সময়ে পরিস্থিতি অনুসারে দ্রুত বা ঢিমা লয়ে গাওয়া হয়ে থাকে। মূলত হারমোনি করার সময় এই গানটির লয় কমিয়ে গাওয়া হয়।

এর আরও একটি নমুনা পাওয়া যায় পাওয়া যায় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত একটি গান হিসেবে। এর শিরোনাম ছিল "If My Jesus Wills"। এই গানটি প্রকাশিত হয় People's Songs Bulletin -এর আগষ্ট, ১৯৪৮ সংখ্যায় । ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এ গানটির স্বত্বাধিকার লাভ করেছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট কয়ার ডিরেক্টর Louise Shropshire। পরে ইসাইয়াস গাম্বোয়া রচিত "We Shall Overcome: Sacred Song on the Devil's Tongue গ্রন্থেও গানটি যে Louise Shropshire-এর রচিত, তার সাক্ষ্য দেয়। Shropshire -এর বাণী অংশ ছিল

I'll Overcome, I'll Overcome, I'll Overcome Someday
If My Jesus Wills, I Do Believe, I'll Overcome Someday

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে এই গানটি সিভিল রাইটস মুভমেন্ট-এর প্রচারণার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৫৫-৬৮ খ্রিষ্টাব্দের আফ্রিকান-আমিরকান সিভিল ওয়ারের সময়, যোদ্ধাদের কাছে এই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কের কার্নেগি হলে এই গানটি পিট সিগার পরিবেশে করেন। এই সময় তাঁর এই গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল। এটিই ছিল এই গানের প্রথম রেকর্ড।

We shall overcome, we shall overcome,
We shall overcome someday;
Oh, deep in my heart, I do believe,
We shall overcome someday.

The Lord will see us through, The Lord will see us through,
The Lord will see us through someday;
Oh, deep in my heart, I do believe,
We shall overcome someday.

We're on to victory, We're on to victory,
We're on to victory someday;
Oh, deep in my heart, I do believe,
We're on to victory someday.

We'll walk hand in hand, we'll walk hand in hand,
We'll walk hand in hand someday;
Oh, deep in my heart, I do believe,
We'll walk hand in hand someday.

We are not afraid, we are not afraid,
We are not afraid today;
Oh, deep in my heart, I do believe,
We are not afraid today.

The truth shall make us free, the truth shall make us free,
The truth shall make us free someday;
Oh, deep in my heart, I do believe,
The truth shall make us free someday.

We shall live in peace, we shall live in peace,
We shall live in peace someday;
Oh, deep in my heart, I do believe,
We shall live in peace someday.

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে Turn Turn গানটি তরুণদের উদ্দেশ্যে রচনা করেন। পুরো ষাটের দশক জুড়ে তিনি অক্লান্তভাবে বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে সমাবেশ করেছেন। তিনি ফোকের সাথে রকের সংমিশ্রণ বা ফিউশন তৈরি করার বিরোধী ছিলেন।

ষাটের দশকে ম্যাক কার্থির পররাষ্ট্রনীতি এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে প্রকশ্যে কঠোর সমালোচনা করেন। "The smothers brothers comedy hour" নামক একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জনসনের সমরনীতির তীব্র নিন্দা ও কঠোর সমালোচনা করেন। এই সময় তিনি রচনা করেন Waist deep in the big muddy গানটি। প্রথম দফায় টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ গানটি সেন্সর করলেও পরবর্তীতে একই অনুষ্ঠানে কোন রকম বাধা ছাড়াই সম্পূর্ণ গানটি পরিবেশন করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে সে সময় তাঁর সাথে Joan Baez এর মতো তরুণ ফোক শিল্পীরাও যোগ দেয়।

রাজনৈতিক বাদ-প্রতিবাদ ছাড়াও পরিবেশবাদী হিসেবেও তিনি বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন। উল্লেখ্য ৭০ দশকে তিনি হাডসন নদী রক্ষা কর্মসূচীতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য সে সময় হাডসন নদীতে শিল্প কল-কারখানার বর্জ্য ফেলাতে নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছিলো।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পরিবেশ রক্ষায়, বিশেষ করে নদী সংরক্ষণ-এর জন্য
Clear water organization নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পিট সিগার "প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ আর্টস" এবং কেনেডি সেন্টার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্লক ডেপেলাপমেন্টে ভূমিকা রাখার জন্য তিনি রক এন্ড রোল এর "হল অফ ফেম" নির্বাচিত হন। একই বছরের এপ্রিল মাসে তিনি হার্ভার্ড আর্টস মেডেল অর্জন করেন। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে
"Best traditional folk music album" বিভাগে Grammy Award অর্জন করেন।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।