 ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ
ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ
রাগসঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা সদরের 
বহরমপুরের গোরাবাজার এলাকার এক সঙ্গীত-পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা শেখ কালু 
মিয়া ওই সময়ের গীত ও গজলের শিল্পী ছিলেন। পিতা গোলাম রসুল লঘু সঙ্গীতের প্রসিদ্ধ 
গায়ক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম মায়মুনা খাতুন। তাঁর একমাত্র বোনের নাম ছিল মরিয়ম বেগম।
মাত্র সাড়ে তিন বৎসর (আনুমানিক ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে) বয়সে তাঁর সঙ্গীতের হাতে খড়ি হয় 
পিতার কাছে। তাঁর পিতা লঘু গান করতেন। তিনি পুত্রের কণ্ঠকে রাগসঙ্গীতের উপযোগী 
বিবেচনা করে, তাঁকে রাগসঙ্গীত শেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরপর কাসেমবাজার ‘মহারাজ 
বাড়ি’ স্টেটের পাখোয়াজ শিল্পী মেঘবাবুর কাছে রাগসঙ্গীত শেখানোর জন্য তাঁকে পাঠান। 
উল্লেখ্য মেঘবাবু ছিলেন তাঁর বাবার বন্ধু। এই গুরুর কাছে তিনি দুই বৎসর তালিম নেন। 
এরপর মেঘবাবু তাঁকে ওস্তাদ কাদের বক্স-এর কাছে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাঠান। এই 
ওস্তাদের কাছে তিনি পাঁচ বৎসর শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর ওস্তাদ কাদের বক্স অসুস্থ হয়ে 
পড়লে, তিনি কাসেমবাজারে ফিরে আসেন। এখানে এসে রাজদরবারের সেতারি পণ্ডিত রামগোবিন্দ 
পাঠকের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। 
আনুমানিক ১৯৩৬-৩৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি তাঁর বড় চাচা শেখ দোস্ত মহম্মদের সাথে 
কলকাতায় আসেন। এই সময় তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একটি বিশেষ অডিশন দেন এবং উত্তীর্ণ 
হন। এই অডিশন শেষে, রাগসঙ্গীতের বিশেষ তালিম দেওয়ার জন্য, তিনি ফুল মোহাম্মদকে 
মেগাফোন কোম্পানীর সঙ্গীত ট্রেনার ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে যান। তাঁর গান 
শুনে ভীষ্মদেব মুগ্ধ হন এবং এন্ট্রান্স পরীক্ষার পর তাঁকে কলকাতায় এসে তাঁর কাছে 
গান শেখার পরামর্শ দেন।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর 
তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এই বৎসর এবং পরের বছর তিনি অল বেঙ্গল 
মিউজিক কম্পিটিশনে ৬টি বিষয়ে অংশগ্রহণ করে ৪টিতে প্রথম এবং দুটিতে দ্বিতীয় স্থান 
অধিকার করেছিলেন।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে তিনি রাগসঙ্গীতে 
প্রথম এবং গজলে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এই বছরের শেষের দিকে কাছড়াপাড়া রেলওয়ে 
ওয়ার্কস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশান আয়োজিত মিউজিক কম্পিটিশনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এই 
প্রতিযোগিতায় বিচারকদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় রাগসঙ্গীত 
এবং আধুনিক গানে প্রথমস্থান অধিকার করেন। এই সূত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচয় 
হয়। পরে নজরুল ইসলাম তাঁর গান গাওয়ার অনুরোধ করেন। এই সূত্রে ফুল মোহাম্মদ তাঁর 
সাথে পরে যোগাযোগ করলে, তিনি তাঁর জন্য প্রথমে নীলাম্বরী শাড়ি পরি' নীল যমুনায় কে 
যায়’ গানটি ঠিক করেন। পরে মত পাল্টে তিনি তাঁকে দিয়ে দুটি ইসলামী গান রেকর্ড করান। 
গান দুটি হলো ‘ইয়া মোহাম্মদ বেহেশ্ত্ হতে, ‘আঁধার মনের মিনারে মোর’। ১৯৪০ 
খ্রিষ্টাব্দে গান দুটি প্রকাশ করেছিল মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানী। এর রেকর্ড নম্বর ছিল
J.N.G 5487।
উল্লেখ্য নজরুল 
ইসলামের অসুস্থার জন্য পরবর্তী সময়ে তিনি আর নজরুলের নতুন কোনো গান রেকর্ড করেন নি।
সে সময়ের রামপুর ঘরানার স্বনামধন্য ওস্তাদ মেহেদী হোসেন খাঁর কাছে ফুল মোহাম্মদের 
রাগসঙ্গীতে তালিম নেওয়ার বাসনা ছিল দীর্ঘদিনের। কিন্তু তিনি এই ওস্তাদের সাথে 
যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ করে উঠতে পারেন নি। অবশেষে তিনি জানতে পারলেন যে, কে.সি 
নাহার নামক জনৈক সঙ্গীতানুরাগীর বাড়িতে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সঙ্গীতগুণীরা আসেন এবং 
সঙ্গীত পরিবেশনও করেন। সে সময়ে সঙ্গীতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। ওস্তাদ 
মেহেদী হোসেন খাঁর সাথে যোগাযোগ হতে পারে, এই আশায় তিনি একদিন কে.সি নাহার-এর 
বাড়িতে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর মনের বাসনা ব্যক্ত করেন। ওস্তাদ মেহেদী হোসেন 
খাঁর সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য, কে.সি নাহার একটি নির্দিষ্ট দিনে ফুল মোহাম্মদকে 
তাঁর বাসায় আসতে বলেন। ওই নির্দিষ্ট দিনে ফুল মোহাম্মদ কেসি নাহারের বাসায় এলে, 
তিনি ফুল মোহাম্মদকে নিজের ছেলে হিসেবে পরিচয় দেন এবং তাঁকে সঙ্গীতে তালিম দেওয়ার 
জন্য ওস্তাদজীকে অনুরোধ করেন। সেই সূত্রে ফুলমোহাম্মদ ওস্তাদজীর বাসায় যাওয়া আসা 
শুরু করেন। প্রায় এক বৎসর তিনি ফুল মোহাম্মদকে কোনো পাঠ না দিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা 
নেন এবং অবশেষে তিনি তাঁর সঙ্গীতের তালিম দেওয়া শুরু করেন। এই সময়ে তিনি কলেজের 
লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন এবং রেডিওতেও তিনি নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। এর ভিতর তিনি বিএ 
পাশ করেন।
প্রায় চার বৎসর তিনি এই ওস্তাদের কাছে তালিম নেন। এরপর ওস্তাদের ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় 
মৃত্যুবরণ করলে, ওস্তাদজী শোকে নিরব হয়ে যান এবং তিনি নিজের দেশের বাড়ি ফিরে যান। 
ফলে, তাঁর কাছে ফুল মোহাম্মদের তালিম নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৪০-৪১ খ্রিষ্টাব্দে নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত 
প্রতিযোগিতায় খেয়াল, ঠুমরী, গজল ও ভজনে পর পর দুই বছর প্রথম স্থান অধিকার করেন। 
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর ভিতরে আন্তঃকলেজ 
সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় তিনি খেয়াল ও গজলে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এই সময় ফুল মোহাম্মদের বাড়ির কাছে থাকতেন পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। ১৯৪৭ 
খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত তিনি তাঁর কাছে রাগ সঙ্গীতের 
তালিম নেন। দেশ বিভাজনের কিছু আগে তিনি সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে চাকুরি নেন এবং 
জরিনা বেগমকে বিবাহ করেন। এই সময় তাঁর সকল আত্মীয় স্বজন বহরমপুরেই থেকে যান। ১৯৪৮ 
খ্রিষ্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় চলে আসেন। 
ঢাকায় এসে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। এই সময় শিল্পী হিসেবে ঢাকা বেতার 
কেন্দ্রের সাথে যুক্ত হন। তিনি বেশ কিছুদিন রেডিও এবং টেলিভিশনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত 
এবং নজরুল সঙ্গীতের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। 
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ছায়ানট বিদ্যায়তনের রাগ সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই 
প্রতিষ্ঠানে তিনি আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। 
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ 
হিসেবে যোগদান করেন। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমীর উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রশিক্ষক 
হিসেবে বহু বছর যুক্ত ছিলেন। 
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে অগ্নিবীণা সঙ্গীত নিকেতনে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। 
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফাইন্যানসিয়াল এ্যাডভাইজার হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর 
নেন। 
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। পরে 
বার্ধক্যজনীত কারণে এই পদ থেকে অবসর নেন।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল একাডেমীর অধ্যক্ষ শেখ লুৎফর রহমান মৃত্যুবরণ করলে, ফুল 
মোহম্মদ এই একাডেমীর অধ্যক্ষ হন।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন।
সম্মাননা
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক পান। 
পারবারিক অবস্থা
স্ত্রীর নাম : জরিনা বেগম
সন্তানাদি : ছয়টি মেয়ে (রিনা, নীরা, রোজি, ইরা, মেরি, লিপি)
তিনটি ছেলে (লাকি, পাপ্পু, রুমা)