রাধারাণী দেবী
(১৯০৩-১৯৮৯)
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কবি ।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আশুতোষ ঘোষ ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর মায়ের নাম ছিল নারায়নী দেবী। তিনি ছিলেন পিতামাতার দেবীর দশম সন্তান।

পিতার কর্মক্ষেত্র কোচবিহার জেলার দিনহাটায় তাঁর শৈশবকলা কেটৈছে। তিনি সেখানকার ছবিরউন্নিসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে ছাত্রবৃত্তি ও মাইনর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর স্বশিক্ষায় সংস্কৃত, ইংরাজী ও ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।

বাড়িতে প্রত্যেক সদস্যদের জন্য নিয়মিত রাখা হতো 'প্রবাসী','শিশু', 'মৌচাক', 'সন্দেশ', 'সোপান', 'ভারতবর্ষ' প্রভৃতি নানান ধরনের পত্রিকা। এই সূত্রে তিনি সাহিত্য মনষ্ক হয়ে উঠে৩ছিলেন। তার সেজদার হাতে-লেখা ভাইবোনদের পত্রিকা 'সুপথ'-এ দশ বছর বয়সে লেখা দেন তিনি। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় 'মানসী ও মর্মবাণী' পত্রিকায়।

মাত্র তের বৎসর বয়সেই তার বিবাহ হয়ে যায় ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে। কয়েক মাসের মধ্যেই আচমকা 'এশিয়াটিক ফ্লু' তে স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি স্বেচ্ছায় কঠিন বৈধব্য পালন করেন।

এরপর তিনি রাধারাণী দত্ত নামে 'ভারতবর্ষ', 'উত্তরা', 'কল্লোল', 'ভারতী' প্রভৃতি পত্রিকায়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম গল্প ‘বিমাতা’ প্রকাশিত হয় ‘মাসিক বসুমতী’তে। প্রথম প্রবন্ধ ‘পুরুষ’ প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’-এ। এর পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ - ‘লীলাকমল’। এরপর 'সিঁথিমোর' ও 'বনবিহগী' কাব্যগ্রন্থ।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তার ও নরেন্দ্র দেবের যুগ্ম সম্পাদনায় বাংলা কাব্য সংকলন 'কাব্যদীপালি' প্রকাশিত হয়।

কথিত আছে একবার এক সান্ধ্য আড্ডায় রাধারাণীর রচনার পরিপেক্ষিতে প্রমথ চৌধুরী মন্তব্য করেন - ‘...আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ের লেখায় তার স্বকীয়তার ছাপ ফুটে উঠলো না।’ এই অভিযোগের প্রতিবাদে তিনি 'অপরাজিতা দেবী' ছদ্মনামে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছায়াপাতে শুরু করেন রচনা। তার কবিতার মধ্যে অন্তঃপুরের অন্তরঙ্গ জগৎ আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বস্ততার সাথে। যেমন মাধুর্য ও কৌতুক, তেমনই প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে সাহিত্যজগৎকে আলোড়িত করেছিল সে সময়

১৯৩০-৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার প্রকাশিত ভালোবাসার কাব্যগ্রন্থ গুলি হল - 'বুকের বীণা' (১৯৩০) 'আঙিনার ফুল' (১৯৩৪) 'পুরবাসিনী' (১৯৩৫) 'বিচিত্ররূপিনী'।

অপরাজিতা নামে রবীন্দ্রনাথের সাথে চিঠিপত্রের আলাপচারিতা হয়ে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে পদ্যে চিঠি দিতেন, উত্তরও পেতেন পদ্যে। 'প্রহসিনী' গ্রন্থে সেসব কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্রনাথের অন্তঃপুর' হল তার এক উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ।  

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে মে নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তৎকালীন নাগরিক-বুদ্ধিজীবী সমাজে দেবদম্পতির বিশেষ সমাদর ছিল। তাঁদের কন্যা হলেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন।  কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের সঙ্গে রাধারাণীর খুবই ঘনিষ্ঠ 'বড়দা' সম্পর্ক ছিল। তিনি প্রায়ই রাধারাণীর বাসায় (বাসার নাম ছিল ভাল-বাসা) আসতেন। শরৎচন্দ্রের অসমাপ্ত উপন্যাস 'শেষের পরিচয়' তিনিই সমাপ্ত করেন।

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে শরৎচ্ন্দ্রের জন্মশতবর্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে 'শরৎচন্দ্র বক্তৃতামালা' দিয়েছিলেন তারই গ্রন্থরূপ তার একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ 'শরৎচন্দ্র: মানুষ ও শিল্প'। এই গ্রন্থটিতে শরৎপ্রতিভা বিশ্লেষণে তার গভীর অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় মেলে।

রাধারাণী ছোটদের জন্য লিখেছেন 'নীতি ও গল্প' এবং 'গল্পের আলপনা'। স্বামীর সম্পাদনায় ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা 'পাঠশালা' প্রকাশে সহায়তা ছাড়াও যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বাংলা গ্রন্থের সংকলন 'কথাশিল্প'। বিবাহের মন্ত্রগুপ্তির স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করা তার বইটি হল 'মিলনের মন্ত্রমালা'। এছাড়া বারোয়ারি উপন্যাসও লিখেছেন।  

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক ও লীলা পুরস্কার প্রদান করে।
১৯৮৬  খ্রিষ্টাব্দে অপরাজিতা রচনাবলী'র জন্য তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করে।  
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে নভেম্বর কলকাতায় নিজ বাসভবন 'ভালো-বাসা'য় প্রয়াত হন।  
সূত্র: