রামকৃষ্ণ পরমহংস
১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ
প্রখ্যাত বাঙালি যোগসাধক।

১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার কামারপুকুর গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা নাম চিন্তামণি দেবীর। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ ও শেষ সন্তান।

রামকৃষ্ণের ছেলেবেলার নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। গদাধরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর পর্যন্ত না হলেও বিভিন্ন উপায়ে তিনি বেদান্ত ও পুরাণ-শাস্ত্রী বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেনএর পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত ও যাত্রাভিনয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দাদা রামকুমারকে পৌরহিত্য কার্যে সহায়তার জন্য কলকাতায় আসেন। এরপর তিনি রাণী রাসমণির অনুগ্রহ লাভ করেন। উল্লেখ্য ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার মথুরামোহন বিশ্বাসের পত্নী রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়িতে রামকুমার পুরোহিতের দায়িত্ব পান। এই সময় রামকৃষ্ণ ও তাঁর ভাগনেয় হৃদয়রাম তাঁর সহকারী ছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর ঐ মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হন। গদাধর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। তিনি তন্ত্র-মন্ত্র আর নিয়ম-অনুশাসনের ঊর্ধে গিয়ে মাতৃভাবে কালীর পূজা করতে থাকেন। তিনি প্রচলিত প্রথা ভেঙে কালীর নৈবেদ্য নিজে খেতেন এবং মাকেও খাইয়ে দিতেন। কথিত আছে একদিন মন্দিরে বসে তিনি সংকল্প করলেন যে, কালীর দর্শন না পেলে আত্মহত্যা করবেন। অনেক ডাকার পরেও কালী তাঁকে দর্শন না দিলে মন্দিরে রাখা এক খড়গ দিয়ে নিজেই নিজের গলায় কোপ বসাতে যান। এই সময় কালী তাঁকে দর্শন দেন।

সংসারে উদাসিনতার কারণে তাঁর মা চিন্তামণিদেবী গদাধরকে বিবাহ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিবাহের কথা শুনে গদাধর নিজেই পাত্রীর সন্ধান দিয়েছিলেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কথামত কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তরে অবস্থিত জয়রামবাটী গ্রামের পঞ্চমবর্ষীয়া সারদা মুখোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। সাধারণ গৃহস্থের মত গদাধরের সংসার-ধর্ম হয় নি। কথিত আছে বিবাহের পরেও তাঁর ব্রহ্মচর্য অক্ষুন্ন ছিল। সারদাদেবীও ভক্তদের কাছে জগজ্জননী রূপে পূজিতা হয়ে থাকেন।

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে গদাধর ভৈরবী নামক এক তন্ত্রসিদ্ধা ও শাস্ত্রজ্ঞা যোগিনীর নিকট তান্ত্রিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ভৈরবী প্রদর্শিত পথে ৬৪ প্রকার তন্ত্র-সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। তিনি তন্ত্রোক্ত বামাচারী হয়ে তিনি পঞ্চ ম-কারের সাধনা করেন। তবে তিনি পঞ্চ ম-কারের মদ্য ও মৈথুন বর্জন করেছিলেন। তিনি ভৈরব মতেও সাধনা করেছিলেন। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তোতাপুরি নামক এক বৈদিক নাগা-সন্ন্যাসীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় রামকৃষ্ণ। সাধনার দ্বারা তিনি পরমহংস (নির্লোভ ও নির্বিকার যোগী) হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

হিন্দুধর্ম ছাড়াও তিনি অন্যান্য ধর্ম মতানুসারে সাধনা করেছিলেন। কথিত আছে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টীয় মতে সাধনা করেন। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইসলামী সুফি মতে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেন। 

তিনি বেদ-বেদান্তের দুর্বোধ্য মতবাদগুলো সহজ করে গল্প-উপমার মাধ্যমে ভক্তদের বোঝাতেন। তিনি বলতেন- যেই কালী সেই কৃষ্ণ অর্থাৎ তিনি কালী ও কৃষ্ণতে ভেদ করতেন না। সকল ধরমের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তিনি প্রচার করেছিলেন 'যত মত তত পথ'।

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ক্লার্জিম্যান'স থ্রোট রোগে আক্রান্ত হন, যা পরবর্তীতে গলার ক্যান্সারে পরিণত হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কল্পতরু রূপে ভক্তের মনোষ্কামনা পূর্ণ করেন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট তিনি দেহত্যাগ করেন। রামকৃষ্ণদেবের ত্যাগী শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রজ্ঞানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাখালচন্দ্র ঘোষ), স্বামী সারদানন্দ (শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী), স্বামী অভেদানন্দ (কালীপ্রসাদ চন্দ্র), স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ (শশীভূষণ চক্রবর্তী), স্বামী শিবানন্দ (তারকানাথ ঘোষাল) প্রমুখ।