সত্যজিৎ রায়
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার। ডাক নাম -মাণিক।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে (১৮ বৈশাখ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতামহ ছিলেন
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (লেখক, চিত্রকর, ভারতীয় মুদ্রণশিল্পের পথিকৃত)। পিতার নাম সুকুমার রায় (প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক), মায়ের নাম সুপ্রভা দেবী। এঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে।

তাঁর তিন বৎসর বয়সে পিতা সুকুমার রায় কালাজ্বরে মৃত্যু বরণ করেন। এই কারণে, সুপ্রভা দেবীকে প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের ভিতর দিয়ে সন্তান লালন পালন করতে হয়। প্রথমেই তাঁদের ছাপাখানা হাতছাড়া হয়ে যায়। আর্থিক অনটনের জন্য সুপ্রভাদেবী চলে আসেন তাঁর ভাইয়ের বাড়ি। এখানে পরিচয় ঘটে তাঁর মামাতো বোন বিজয়া'র সাথে। পরে বিজয়াকে তিনি বিবাহ করেছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে। ৮ বৎসর বয়সে (১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ) বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই কলেজে প্রথম দুই বৎসর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেন। শেষ বৎসরে বিষয় পাল্টে তিনি অর্থনীতিতে পড়েন। ফলে তাঁর লেখাপড়ার সময় দীর্ঘতর হয়ে উঠে। এই সময়ে ইনি পাশ্চাত্য চিরায়ত চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেন যে, তাঁর মূল পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিএ (সম্মান) পাশ করতে সক্ষম হন।

রবীন্দ্রনাথের সাথে রায় পরিবারের বিশেষ হৃদ্যতা ছিল। ফলে সত্যজিতের মা চেয়েছিলেন যে তাঁর ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করুক। যদিও সত্যজিৎ কলকাতার মায়া ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে যেতে প্রথম দিকে অনাগ্রহ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মায়ের উৎসাহে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যান এবং সেখানকার কলাভবনে ভর্তি হন। এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পান। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। মূলত ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় জাপানিরা বোমাবর্ষণ করে। এই সময় তিনি শান্তিনকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর আর শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতন যান নি।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ডি জে কেমের (D.J. Keymer) নামক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় 'জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার' পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি বেতন পেতেন  ৮০ টাকা। ইনি প্রথম বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ধাঁচের ক্যালিওগ্রাফিক উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেন। একই সাথে তিনি অক্ষরশৈলীতে বিশেষ আগ্রাহী হয়ে উঠেন। তাঁর নকশা করা দুটি ফন্ট 'Ray Roman' এবং 'Ray Bizarre' ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছিল।

এই প্রতিষ্ঠানে চিত্রসজ্জা'র কাজ তিনি আনন্দের সাথেই করতেন। এই সময় বিজ্ঞাপন সংস্থার ইংরেজ ও ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে বেতনাদি নিয়ে চাপা উত্তেজনা চলছিল। কারণ দেশী কর্মচারীদের তুলনায় ইংরেজ কর্মচারীদেরকে অনেক বেশি বেতন দেয়া হতো। এই সময় তাঁর অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মী ডি.কে, দাসগুপ্ত 'সিগনেট প্রেস' নামক একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠিত করেন। গোড়া থেকেই তিনি এই প্রতিষ্ঠানের চিত্রশিল্পী হিসাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ডি.কে. দাসগুপ্ত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী' উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন এবং এই গ্রন্থের চিত্রসজ্জার দায়িত্ব পড়ে সত্যাজিতের উপর। উল্লেখ্য, সত্যজিৎ তখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ততটা পড়েন নি। তাঁর প্রায় সকল পড়াশুনা ছিল ইংরেজিতে লিখা উপন্যাস ও অন্যান্য গ্রন্থাদি। এমন কি তখনো রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোও তিনি বিশেষভাবে পড়েন নি। এই অবস্থায় তিনি পথের পাঁচালী পড়লেন এবং মুগ্ধ হলেন। ডি. কে গুপ্ত এই প্রকাশনার কাজে আসার আগে একটি চলচ্চিত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ইনিই প্রথম সত্যজিৎকে বলেন যে, 'পথের পাঁচালী' থেকে খুব ভালো একটি চলচ্চিত্র হতে পারে। এই প্রকাশনায় কাজ করার সুবাদে তিনি ব্যাপকভাবে বাংলা গদ্য সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। যা তা পরবর্তী সময়ে বাংলা উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশেষ সহায়তা করেছিল।

এই সময় থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে যোগাযোগ করে- নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে খবর নিতেন। বিশেষ করে নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়েল এয়ার ফোর্সের এক কর্মচারী এ বিষয়ে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হলিউডে নির্মিত প্রচুর ছবি দেখানো হতো। এই সূত্রে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো কলকাতার চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ এবং বংশীচন্দ্র দাসগুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটিতে চলচ্চিত্র দেখানো হতো এবং এই বিষয়ে পরে ঘরোয়াভাবে আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। উল্লেখ্য এই সমিতি প্রথম প্রদর্শন করেছিল
Battleship Potemkin (১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত নির্বাক চলচ্চিত্র। পরিচালক ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার Sergei Eisenstein)।

এই সময় সত্যজিৎ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলাতে চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ১৯৪৮-১৯৭১ এর মধ্যে রচিত এই প্রবন্ধগুলোর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে -
Our Films, Their Films নামে। ইতিমধ্যে ইনি চিত্রনাট্য রচনায় বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নিজের আনন্দের জন্য চিত্রনাট্য লিখতেন এবং তার জন্য একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। যে সকল ছবি তৈরি হবে, তার ঘোষণা পত্রিকায় আসার পরপরই, তিনি সেই ঘোষিত ছবির মূল উপন্যাস বা গল্প পড়ে নিজের মতো করে চিত্রনাট্য তৈরি করতেন। পরে ওই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলে, তিনি নিজের চিত্রনাট্যের সাথে তুলনা করে, তাঁর ক্ষমতা যাচাই করে নিতেন। এই সময় তাঁর বন্ধু হরিসাধন দাসগুপ্ত রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে ছবি তৈরি করার জন্য বিশ্বভারতী থেকে অনুমোদন পান। সেই সূত্রে সত্যজিৎ ঘরে বাইরে উপন্যাসের চিত্রনাট্য রচনা করেন। কথা ছিল এই ছবির পরিচালনা করবেন হরিসাধন দাসগুপ্ত নিজে। কিন্তু ছবির প্রযোজকের এক বন্ধু এই চিত্রনাট্যের পরিবর্তনের জন্য বিশেষ পীড়াপীড়ি শুরু করলে, সত্যজিৎ এই চিত্রনাট্য আর হরিসাধনকে দেন নি। প্রায় ৩৫ বৎসর পর সত্যজিৎ যখন ঘরে বাইরে ছবি তৈরিতে হাত দেন, তখন উপলব্ধি করেন যে, তাঁর পূর্বের চিত্রনাট্য অনুসরণে ছবিটি যে তৈরি হয় নি, সেটা নিঃসন্দেহে ভালো হয়েছিল। ৩৫ বৎসর পর তাঁর মনে হয়েছিল ওই চিত্রনাট্যটি ছিল 'হলিউডের ধাঁচে একজন অপেশাদারীর উদ্যোগ'।

উল্লেখিত কারণে, সত্যজিৎ সাধারণ মানুষের কাছে ততটা পরিচিত হয়ে না উঠলেও, কলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর নামটি বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। এই কারণেই ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোর (Jean Renoir) তাঁর The River ছবি নির্মাণের জন্য কলকাতায় আসেন, তখন সত্যজিৎকে তাঁর ছবির চিত্রগ্রহণের উপযোগী স্থান খোঁজার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসাবে খুঁজে নিয়েছিলেন। এটাই ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয়। এই সময়ই তিনি রেনোর'র কাছে পথের পাঁচালী-র চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে আলাপ করেন। রেনোর এই বিষয়ে বিশেষভাবে তাঁকে উৎসাহিত করেন। এবং অনেকে মনে করেন, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের মৌলিক উপাদনগুলো সম্পর্কে রেনরো-র কাছ থেকে তিনি বিশেষ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সত্যজিৎ তাঁর দূরসম্পর্কের বোন ও বহুদিনের বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। রেনোর তাঁর ছবিতে সত্যজিতের বন্ধু বংশী চন্দ্র গুপ্তকে শিল্প নির্দেশক এবং সহযোগী হিসাবে নেন হরিসাধন দাসগুপ্তকে। এই ছবিতে সুব্রত মিত্রও ছিলেন। পরে ইনি সত্যজিৎ -এর ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন। এই ছবিতে কাজ করার জন্য সত্যজিতের ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি তখনও বিজ্ঞাপন সংস্থায় শিল্প নির্দেশক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এই সংস্থা সত্যজিৎকে তাদের লণ্ডনস্থ প্রধান অফিসে কাজ করার জন্য পাঠান। সত্যজিৎ এই কাজের জন্য জাহাজযোগে সস্ত্রীক লণ্ডনে যান ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে। জাহজে যেতে তাঁদের ১৬ দিন সময় লেগেছিল। এই সময়ে তিনি পথের পাঁচালী ছবি কিভাবে তৈরি করবেন, তার খসড়া তাঁর নোট বইতে লিখা শুরু করেন। পথের পাঁচালী  তৈরিতে তিনি কোন দিকনির্দেশনা অনুসরণ করবেন, সে সম্পর্কে এই নোট বই থেকে জানা যায়। তিনি এক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এগুলো হলো- তাঁর ছবির চিত্রায়ণ হবে বাস্তব কোন অঞ্চলে, নতুন মুখ নেবেন এবং কোনো মুখসজ্জা (
make-up) থাকবে না।

লণ্ডনে অবস্থানকালে তিনি প্রায় শ'খানেক চলচ্চিত্র দেখেন। এর ভিতরে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয়
Ladri di biciclette ইংরেজি Bicycle Thieves (সাইকেল চোর) দেখেন। এই ছবিটি তাঁকে পথের পাঁচালী তৈরিতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিল। কারণ, তাঁর বাস্তববাদী চলচ্চিত্র দর্শকরা গ্রহণ করবে কিনা এ নিয়ে তাঁর যথেষ্ঠ সংশয় ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর পরিচিত অনেকেই এই জাতীয় ছবি তৈরিতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। এমন কি এই ছবি তৈরি করার প্রারম্ভিক মুহূর্ত থেকে শুরু করে মুক্তি পাওয়ার পূর্বকাল পর্যন্ত অনেকেই এই ছবির সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং তা সত্যজিতের কাছে দৃঢ়ভাবে প্রকাশও করেছিলেন। Bicycle Thieves  ছবি দেখার পর তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর ছবি সফলতা পাবেই।

সত্যজিৎ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি নব্য-বাস্তবাবাদী ধারার ছবি তৈরি করবেন। তিনি তাঁর Our Films, Their Films গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন- "All through my stay in London, the lessons of Bicycle Thieves and neo-realist cinema stayed with me"। এই ছবি দেখেই তিনি তাঁর জাহাজে লিখিত নোট বইয়ের সিদ্ধান্তকে (বাস্তব স্থান এবং মুখসজ্জা ছাড়া নতুনমুখ) দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এবং জাহজে ফেরার পথে, পথের পাঁচালী তৈরির আনুসঙ্গিক প্রস্তুতি কাগজকলমে সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তিনি কলকাতা ফিরে এসে একজন প্রোডিউসারের সন্ধান করতে থাকেন। ইতিমধ্যে তিনি নতুন মুখও খুঁজতে শুরু করলেন। এ ছবি বানানোর জন্য তিনি কিছু পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন কুশলীকে একত্রিত করতে সক্ষম হন। এর ভিতরে পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে এমন কিছু লোককে রাজি করালেন। এঁদের ভিতরে ক্যামেরাম্যান হিসাবে সুব্রত মিত্র ও শিল্প নির্দেশনায় বংশী চন্দ্রগুপ্তকে নিলেন। এঁরা দুজনই ইতিমধ্যে রেনোর দ্যা রিভার  ছবিতে কাজ করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এঁদের সাথে অনিল চৌধুরী যুক্ত হয়েছিলেন প্রোডাক্শন কন্ট্রোলার হিসাবে।

পথের পাঁচালী'র কাশবন

এই ছবি তৈরিই জন্য পথের পাঁচালীর লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী'র কাছ থেকে অনুমতি নেন। তিনি সত্যজিৎকে বিনাশর্তেই অনুমতি দেওয়া সত্ত্বেও সত্যজিৎ তাঁকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এই ছবির জন্য তিনি চিত্রনাট্যের পাশাপাশি বহু ছবি এঁকেছিলেন। অনেকেই তাঁর এই কর্মোদ্যমকে প্রশংসা করেছিলেন বটে, কিন্তু ছবি করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করতে রাজি হন নি। সিনেমা স্টুডিওকে পরিহার করে বাস্তব স্থানে চিত্রায়ণ, মুখসজ্জা ছাড়া নতুন মুখ- এই ধারণাকে অনেকে সমালোচনাও করেছিলেন এবং তাঁর আর্থিক অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তগুলো বিশেষভাবে প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করেছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর জমানো টাকা, বীমা কোম্পানি থেকে গৃহীত ঋণ এবং কতিপয় বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় ১৯৫২ সালের শেষ দিকে দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। তিনি তখনও ডি,জে. কেমার বাণিজ্যিক সংস্থায় কাজ করতেন। ফলে রবিবার ছুটির দিনে চিত্রগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ অক্টোবরে তিনি প্রথম চিত্রগ্রহণ শুরু করেন। এটি ছিল 'অপু এবং তাঁর বোন 'দুর্গা' কাশবনের ভিতর দিয়ে রেলগাড়ি দেখতে ছুটছে' -অংশের দৃশ্য। পরের সপ্তাহে চিত্রগ্রহণ করতে এসে দেখলেন, গ্রামের গবাদি পশু মাঠের কাশবন খেয়ে মাড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে গেছে। ফলে এই দৃশ্যের ধারাবাহিকতা রাখার জন্য তাঁকে চিত্রগ্রহণ করতে হয়েছিল প্রায় এক বছর পর।

এই সময় বিমল রায় এই ধরনের একটি বাস্তবাদী ছবি তৈরি করেছিলেন। ছবিটির নাম ছিল দো বিঘা জমিন। এই ছবিতে কয়েকটি গান ছিল এবং প্রধান চলচ্চিত্রধারার পেশাদার অভিনেতারা কাজ করেছিলেন। এই ধারার দুটি ছবি (Do Bigha Jamin Kurosawa's Rashoman) ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে কান চলচ্চিত্র উৎসবে Prix International পুরস্কার লাভ করে। এই প্রাপ্তি থেকে তিনি তাঁর কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আনা দত্ত নামক একজন প্রোডিউসার তাঁকে কিছু টাকা দিয়ে জানালেন যে, তাঁর শেষ ছবি যদি ভালো চলে, তবে তিনি এই ছবিতে বাকি টাকা দেবেন। এরপর সত্যজিৎ একমাস টানা কাজ করেছিলেন অফিস থেকে বেতন ছাড়া ছুটি নিয়ে। কিন্তু  আনা দত্তের শেষ ছবি ভালো ব্যবসা না করায়, তিনি আর টাকা দিলেন না। তারপরেও কিছু সংগৃহীত টাকা এবং স্ত্রী বিজয়া রায়ের অলঙ্কার বন্ধক রেখে কিছুদিন শুটিং করেছিলেন। এই সব আর্থিক অসুবিধার কারণে, থেমে থেমে এই ছবি তৈরি করতে তাঁর প্রায় দীর্ঘ তিন বছর লেগে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় ও সে বছরের ২৬ আগষ্ট তারিখে ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে। ছবিটি বহুদিন ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয়।

অপরাজিতা

'অপু-ত্রয়ী'-এর শেষ অপুর সংসার

এই ছবির সাফল্যের পর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি করেন অপরাজিত । এই ছবি তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে তাঁকে উচ্চাসনে পৌঁছে দেয়। এই ছবির জন্য তিনি ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার লাভ করেন। 'অপু-ত্রয়ী' শেষ করার আগে সত্যজিৎ আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ সমাপ্ত করেন। প্রথমটি ছিল ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত পরশ পাথর (১৯৫৮), আর পরেরটি ছিল জলসাঘর (১৯৫৮)। এরপর 'অপু-ত্রয়ী'-এর শেষ অপুর সংসার তৈরি করেন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে।

জলসাঘর

আন্তর্জাতিকভাবে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবেই সর্বাধিক পরিচিত। কারণ, তাঁর সৃষ্ট ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল, এদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া "শ্রেষ্ঠ মানব দলিল" (Best Human Document) পুরস্কারটি। পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার – এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে 'অপু-ত্রয়ী' বলা হয়, এর জন্য তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বা ম্যাগনাম ওপাস হিসেবে বহুল স্বীকৃত।

বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে চলচ্চিত্রকার ছাড়াও আরও একটি উল্লেখযোগ্য পরিচয় হলো লেখক সত্যজিৎ। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর, পিতা সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যে যে বিশিষ্ট ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, সত্যজিৎ রায় সে ধারাকেই প্রবাহিত করেছেন একটু ভিন্ন খাতে। পিতামহ ও পিতা ছিলেন শিশুর জগতে, সত্যজিৎ সে জগতকে টেনে তুলেছিলেন কিশোর জগতে। তাঁর বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, গোয়েন্দা গল্পের ফেলুদা সিরিজ এবং  সে সাথে নানাবিধ মজাদার গল্পগুলো কিশোরদের জন্য লিখিত হলেও সব বয়সের মানুষকে দারণভাবে টানে।

ঘরে বাইরে ছবিতে
পাশ্চাত্য রীতির চুম্বন দৃশ্য

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ঘরে বাইরে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিতের হার্ট অ্যাটাক ঘটে এবং এ ঘটনার পর অবশিষ্ট নয় বছরে তাঁর কাজের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত সীমিত। স্বাস্থ্যগত কারণে ঘরে বাইরে নির্মাণের সময় তাঁর ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের সহায়তায় নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৮৪ সালে ছবিটি সমাপ্ত করেছিলেন। এই ছবিতে তিনি পাশ্চাত্য রীতির চুম্বন দৃশ্য যুক্ত করেছিলেন।

আগন্তুক

এরপর থেকে তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় তাঁর হয়ে ক্যামেরার কাজ করতেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে সত্যজিৎ তাঁর শেষ তিনটি ছবি বিশেষ যত্ন নিয়ে করতে পারেন নি। এই ছবি তিনটি হলো- গণশত্রু (১৮৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), আগন্তুক (১৯৯০)।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিল হৃদরোগ প্রকট আকার ধারণ করলে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যুর কিছু সপ্তাহ আগে অত্যন্ত অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি তাঁর জীবনের শেষ পুরস্কার সম্মানসূচক অস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ মৃত্যুবরণ করেন।

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্রের কালানুক্রমিক তালিকা

পথের পাঁচালী (১৯৫৫)
অপরাজিত (১৯৫৬)
পরশপাথর (১৯৫৮)
জলসাঘর (১৯৫৮)
অপুর সংসার (১৯৫৯)
দেবী (১৯৬০)
তিনকন্যা [পোষ্টমাস্টার, মনিহার, সমাপ্তি] (১৯৬১)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৬১)
কাঞ্জনজঙ্ঘা (১৯৬২)
অভিযান (১৯৬২)
মহানগর (১৯৬৩)
চারুলতা (১৯৬৪)
টু (১৯৬৪)
কাপুরুষ ও মহাপুরুষ (১৯৬৫)
নায়ক (১৯৬৬)
চিড়িয়াখানা (১৯৬৭)
গুপী গাইন বাঘ বাইন (১৯৬৮)
অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৬৯)
প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০)
সীমাবদ্ধ (১৯৭১)
সিকিম (১৯৭১)
The Inner Eye (১৯৭২)
অশনী সংকেত (১৯৭৩)
সোনার কেল্লা (১৯৭৪)
জান অরণ্য (১৯৭৫)
বালা (১৯৭৬)
সতরঞ্জী কে খিলাড়ি (১৯৭৭)
জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮)
হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)
পিকু (১৯৮০)
সদগতি (১৯৮১)
ঘরে বাইরে (১৯৮৪)
সুকুমার রায় (১৯৮৭)
গণশত্রু (১৯৮৯)
শাখা-প্রশাখা (১৯৯০)
আগন্তুক (১৯৯১)


সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যে সৃষ্ট চলচ্চিত্র

বাক্স বদল । পরিচালক নিত্যান্দ দত্ত
ফটিক চাঁদ। পরিচালক সন্দীপ রায়

Satyajit Ray Presents (13 shorts for TV, Stories by Satyajit Ray), Director - Sandip Ray
Satyajit Ray Presents 2 (a TV series based on 2 long stories and a Feluda novel by Satyajit Ray),
              Director - Sandip Ray.
Shakespeare Wallah (feature), Director – James Ivory
উত্তরণ । পরিচালক সন্দীপ রায়
টার্গেট । পরিচালক সন্দীপ রায়

সত্যজিৎ রায়ের উপর নথি ও টেলিভিশন চিত্র
1
963 Creative Artists of India: Satyajit Ray (BD Garga for Films Division, India)
1968 Creative persons: Satyajit Ray (Janes Beveridge for W-NET Educational TV)
1969 Late night line-up: An interview with Satyajit Ray (BBC Television, UK)
1978 South Bank Show: Satyajit Ray (Melvyn Bragg for London Weekend Television, UK)
1983 The Music of Satyajit Ray (Utpalendu Chakravarti for NFDC, India)
1984 Satyajit Ray: Portrait of a Director (Zia Mohyeddin for Central Television, UK)
1984 Satyajit Ray (Shyam Benegal for Films Division, India, full length)
1988 Omnibus: The Cinema of Satyajit Ray (Adam Low for BBC, UK, 1 hr)
1990 Satyajit Ray-Introspections (Museum of Modern Art. A video about Satyajit Ray and his filmmaking)


সত্যজিৎ রায়ের রচিত গ্রন্থের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। যথা সময়ে তা এই পাতার সাথে যুক্ত করা হবে।

তথ্য সূত্র:
http://www.satyajitray.org/