শ্রীনিবাস রামানুজ
বিশিষ্ট ভারতীয় গণিতবিদ।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের তাঞ্জোর জেলার ইরেভদ শহরের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কে শ্রীনিবাস ইয়েঙ্গার ছিলেন শহরের একটি কাপড়ের দোকানের হিসাব রক্ষক। তাঁর মা ইরোদ ছিলেন জজ কোটের একজন কর্মচারীর কন্যা। কথিত আছে যে, রামানুজনের মায়ের বিয়ের পর বেশ কয়েকবছর কোনো সন্তান না হওয়ায়, রামানুজনের মাতামহ নামাক্কল শহরের বিখ্যাত নামগিরি দেবীর নিকট নিজ কন্যা সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেন। এরপরই জ্যেষ্ঠ সন্তান রামানুজন জন্মগ্রহণ করেন।

১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্থা্নীয় পাঠশালায় ভর্তি হন।
১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কুম্ভকোনাম শহরের টাউন হাই স্কুলে ভর্তি হন। স্কুল কর্তৃপক্ষ গণিতে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাঁকে বৃত্তি দেয়। এই সময় তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বিভিন্ন গাণিতিক উপপাদ্য, গণিতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর এক বন্ধুর সূত্রে, জি. এস. কার
(G S Carr)-এর লেখা সিনপসিস অফ এলিম্যনটারি রেজাল্ট ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথেম্যাটিক্‌স (Synopsis of elementary results in Pure and Applied Mathematics) বইটি তাঁর পড়ার সুযোগ ঘটে। তিনি এই বইয়ে প্রদত্ত বিভিন্ন গাণিতিক সূত্রগুলির সত্যতা পরীক্ষা শুরু করেন। মূলত এর মধ্য দিয়ে তাঁর গণিতের গবেষণা শুরু হয়।

তিনি ম্যাজিক স্কোয়ার গঠনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এরপর তিনি জ্যামিতির বিভিন্ন বিষয়ের উপর কাজ শুরু করেন। বৃত্তের বর্গসম্পর্কীয় তাঁর গবেষণা পৃথিবীর বিষুবরৈখিক পরিধির দৈর্ঘ্য নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে নির্ণীত বিষুবরৈখিক পরিধির দৈর্ঘ্য এবং প্রকৃত মানের পার্থক্য মাত্র কয়েক ফুট ছিল। জ্যামিতির সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে তিনি বীজগণিতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন।

১৬ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন ও জুনিয়র শুভ্রামানায়াম বৃত্তি লাভ করে কুম্ভকোনাম সরকারী কলেজে ভর্তি হন। গণিতের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার ফলে তিনি পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে অকৃতকার্য হন। ফলে তাঁর বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি কুম্ভকোনাম ত্যাগ করে প্রথমে বিশাখাপট্টম এবং পরে মাদ্রাজ যান। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি ফার্স্ট এক্সামিনেশন ইন আর্টস (
F.A. বা I.A) পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। পরে তিনি আর এই পরীক্ষা দেন নি। এর পরিবর্তে পরবর্তী কয়েক বছর তিনি নিজের মত করে গণিত বিষয়ক গবেষণা চালিয়ে যান।

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ বিবাহ করেন। এসময় তাঁর কোন স্থায়ী কর্মসংস্থান ছিল না। কর্মসংস্থানের জন্য, তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ জনের সুপারিশে মাদ্রাজ শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে নিলোর শহরের কালেক্টর দেওয়ান বাহাদুর রামচন্দ্র রাও-এর কাছে তিনি যান। উল্লেখ্য রামচন্দ্র রাও গণিতের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। রামানুজনের দুটি নোটবুক তাঁর সকল গাণিতিক সূত্রের প্রতিপাদন ও এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় লিপিবদ্ধ ছিল। রামচন্দ্র রাও এসব দেখে তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে, তাঁর সকল ব্যয়ভার বহন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জন্য কোন বৃত্তির ব্যবস্থা না হওয়ায় এবং রামানুজন দীর্ঘকাল অপরের গলগ্রহ হয়ে থাকতে সম্মত হলেন না। পরে তিনি মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের অধীনে একটি সামান্য পদের চাকুরীতে যোগদান করেন। পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করার সময় কিছু লোকের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁদের কাছে তিনি তাঁর গণিত বিষয়ক গবেষণার কথা জানান। পরে এঁদের মাধ্যমে স্থানীয় কিছু বিশেষজ্ঞের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। এই সব গবেষকদের উৎসাহে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ
Journal of the Mathematical Society তৈরি করেন। পরে এই প্রবন্ধটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর, তিনি সাহস করে সংখ্যাতত্ত্বের উপর তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধ রচনা করেন। Some Properties of Bernoulli's Numbers নামক এই প্রবন্ধটি একই বছর প্রকাশিত হয়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে একই পত্রিকায় তাঁর আরো দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

এই প্রবন্ধগুলোর বিষয়ে রামচন্দ্র রাও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তিনি মাদ্রাজ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের মি. গ্রিফিথ-কে রামানুজনের ব্যাপারে বিস্তারিত বলেন। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং-এর সঙ্গে মি. গ্রিফিথ এর আলাপ হওয়ার পর, উভয়েরই সুনজরে আসেন তিনি। এই সময়ে মাদ্রাজ শহরের বিশিষ্ট পণ্ডিত শেশা আইয়ার এবং অন্যান্যদের পরামর্শে কেমব্রিজের ত্রিনিত্রি কলেজের ফেলো জি.এইচ. হার্ডির সঙ্গে রামানুজন যোগাযোগ শুরু করেন। এই সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি পত্র লেখেন। এই পত্রের সঙ্গে ১২০টি উপপাদ্য সংযোজিত ছিল, তার ভিতর থেকে নমুনাস্বরূপ হার্ডি ১৫টি নির্বাচন করেন।

হার্ডি রামানুজনকে কেমব্রিজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের কেরানির চাকরি ছেড়ে দেন। এই সময় তাঁর জন্য একটি বৃত্তিরও ব্যবস্থা করে দেন হিতৈষীরা। ইতিমধ্যে তিনি কেমব্রীজ থেকে তিনি একটি আমন্ত্রণ পান। চাকুরীগত সমস্যার সমাধান হলেও জাতিপ্রথা ও মায়ের অনুমতির অভাবে প্রথমে রামানুজন দেশের বাইরে যেতে অসম্মতি জানান। নানা বাধা অতিক্রম করে অবশেষে তিনি কেম্ব্রিজে যান। এর কিছুদিন পর রামানুজন ত্রিনিত্রি কলেজের ফেলোশিপ পেয়ে যান। এই সময় মাদ্রাজ থেকে প্রাপ্ত বৃত্তির পরিমাণ ছিল বার্ষিক ২৫০ পাউন্ড। এর ভিতর ৫০ পাউন্ড দেশে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য দিতে হত। ত্রিনিত্রি কলেজ থেকে ভাতা বাবদ ৫০ পাউন্ড পেতেন। এরপর তিনি তাঁর গবেষণা পূর্ণদ্যোমে চালিয়ে যান।
 
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে কেমব্রিজের একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হয়। এরপর তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন নি। তাঁকে ওয়েলস, ম্যালটক এবং লন্ডন শহরের স্বাস্থ্য নিবাসে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর তাঁর শারীরিক কোন উন্নতি দেখা যায় নি। এই সময় রামানুজন রয়েল সোসাইটি-র সদস্য নির্বাচিত হন। গবেষণা কাজে অধিক মনোযোগ দেওয়ার ফলে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান উপপাদ্যগুলো এই সময় আবিষ্কৃত হয়। তিনি নির্বাচিত ত্রিনিত্রি ফেলো ছিলেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। কিছুকাল যক্ষারোগে ভোগার পর ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

গণিত ক্ষেত্রে, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রামানুজন এমন অনেক গাণিতিক সূত্রের উদ্ভাবন করেন যেগুলো বহুকাল পরে প্রমাণ হয়। প্রমাণ করতে গিয়ে গবেষণার অনেক নতুন দিকের সূচনা হয়। রামানুজন \pi এর অনন্ত ধারা উদ্ভাবন করেন। রামানুজনের \pi এর ধারা \pi সম্পর্কীয় সকল ধারাকে এত দ্রুত একত্রিত করেছে যে, আধুনিক এল্গারিদমেরর সকল ক্ষেত্রে তাঁর ধারা-ই ব্যবহৃত হয়।

রামানুজনের নিজের মৌলিক উদ্ভাবনসমূহ এবং হার্ডির সাথে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল
    ১. উচ্চতর যৌগিক সংখ্যাসমূহের বৈশিষ্ট্য।
    ২. বিভাজন ফাংশন এবং এর অসীমতট সম্পর্কীয় তত্ত্বসমূহ।

গণিতে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান
    গামা ফাংশন
    মডুলার রূপ
(Modular forms)
    রামানুজনের অবিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশসমূহ
(Ramanujan's continued frations)
    অপসারী ধারা
(Divergent series)
    অধিজ্যামিতীয় ধারা
(Hypergeometric series)
    মৌলিক সংখ্যা তত্ত্ব। রামানুজনের মৌলিক সংখ্যা সমূহ ১৯১৯ সালে রামানুজন কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
    মক থেটা ফাংশন
(Mock theta functions)

প্রথম থেকেই রামানুজন তাঁর সকল গবেষণা লব্ধ ফলাফল তার নোটখাতায় লিখে রাখতেন। কিন্তু তিনি কোন প্রতিপাদন লিখতেন না। ফলে এমন একটি ধারণার জন্ম হলো যে, রামানুজন তাঁর তত্ত্বসমূহ প্রমাণ করতে সমর্থ ছিলেন না। গণিতবিদ ব্রুস বেন্ডিট রামানুজন এবং তাঁর নোটখাতা সম্পর্কিত আলোচনায় একথা বলেছেন যে, রামানুজন তাঁর তত্ত্বসমূহ প্রমাণ করতে পারতেন কিন্তু কোন কারণে তিনি সেটা আনুষ্ঠানিকতায় রূপ দিতেন না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। রামানুজন আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না, আর তখন কাগজের মূল্য ছিল চড়া। তাই রামানুজন শ্লেটে লিখে কোন তত্ত্ব প্রমাণ করতেন এবং নোটখাতায় শুধুমাত্র ফলাফল লিখে রাখতেন।

রামানুজনের প্রথম নোটখাতার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৩৫১। এটি ১৬ টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ছিল এবং কিছু অগোছালো পৃষ্ঠাও পাওয়া যায়। তাঁর দ্বিতীয় নোটখাতার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ২৫৬। অধ্যায় ছিল ২১ টি এবং এতে ১০০ টি অগোছালো পৃষ্ঠা ছিল। তৃতীয় নোটখাতাতেও এরকম ৩৩ টি অবিন্যস্ত পৃষ্ঠা ছিল। তাঁর এসব নোটখাতা পরবর্তীতে গণিতবিদদের গবেষণায় বিরাট অবদান রাখে। হার্ডি নিজেও এসব নোটখাতা থেকে অনেক তত্ত্ব উদ্ধার করেছিলেন। পরবর্তীতে বি এম উইলসন, জি এন ওয়াটসন এবং ব্রুস বেন্ডিট রামানুজনের এসব নোটখাতার উপরে কাজ করেন। রামানুজনের অন্য একটি নোটখাতা, যেটি 'হারানো নোটখাতা' নামে পরিচিত, ১৯৭৬ সালে আবিষ্কৃত হয়।

স্বীকৃতি
রামানুজন এবং তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে তামিলনাডু প্রদেশে রামানুজনের জন্মদিন ২২শে ডিসেম্বর ' প্রাদেশীয় আই.টি. দিবস' হিসেবে পালিত হয়। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে রামানুজনের ৭৫তম জন্মদিনে ভারত সরকার একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে।
International Centre for Theoritical Physics (ICTP) এবং IMU যৌথভাবে, উন্নতশীল দেশসমূহের তরুণ গণিতবিদের জন্য একটি বার্ষিক পুরস্কারের ব্যবস্থা নিয়েছে যেটি রামানুজনের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে স্প্রিঙ্গার-নারোসা কর্তৃক সম্পাদিত ' রামানুজনের হারানো নোটখাতা' প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তিনি এর প্রথম কপি রামানুজনের বিধবা স্ত্রী এস জানাকী আম্মাল রামানুজন এবং দ্বিতীয় কপি জর্জ অ্যান্ড্রুজকে সংখ্যাতত্ত্বে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রদান করেন।

রামানুজনের প্রকাশিত রচনাবলী

  • 'কালেক্টেড পেপারস অফ শ্রীনিবাস রামানুজন'- শ্রীনিবাস রামানুজন, জি.এইচ.হার্ডি, পি.ভি.সেশু আইয়ার, বি.এম.উইলসন, ব্রুস বার্ণ্ডিট। এই বইটি রামানুজনের মৃত্যুর পর ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত রামানুজনের ৩৭ টি প্রবন্ধের একটি সংকলন।

  • 'নোটবুকস্‌'(২ খণ্ড), শ্রীনিবাস রামানুজন, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, বোম্বাই, ১৯৫৭। এই বইটিতে রামানুজনের নোতখাতা গুলোর ফটোকপি সম্পাদিত হয়েছে।

  • 'দি লস্ট নোটবুক এন্ড আদার আনপাবলিশ্‌ড পেপারস্‌- এস. রামানুজন, নারোসা, নিউ দিল্লী, ১৯৮৮। এই বইটিতে রামানুজনের 'লস্ট নোটবুক' এর ফটোকপি সংকলিত হয়েছে।


তথ্যসূত্র :
Srinivasa Aiyangar Ramanujan
http://scienceworld.wolfram.com/biography/Ramanujan.html
Srinivasa Ramanujan
http://thatsmaths.com/2012/12/06/ramanujans-lost-notebook/