শ্রীচৈতন্যদেব
১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।

প্রখ্যাত হিন্দু সন্ন্যাসী এবং হিন্দু বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের প্রবক্তা । গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। তিনি রাধা-কৃষ্ণকে ভগবানরূপে প্রচার করেন এবং হরে-কৃষ্ণ-কে মহামন্ত্র জপে পরিণত করেন। তিনি শিষ্টাষ্টক মন্ত্রটি রচনা করেন।

অন্যান্য নাম: চৈতন্যদেব, চৈতন্য মহাপ্রভু, গৌরাঙ্গ, নিমাই। উল্লেখ্য গায়ের রঙ অত্যধিক ফর্সা হওয়ায়, তিনি গৌরাঙ্গ নাম পান। অন্যদিকে তিনি নিম গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে, তাঁকে নিমাই ডাকা হতো। তবে তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র।

লোচনদাস ঠাকুরের চৈতন্য চরিতামৃত মতে, ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাতে, চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার মায়াপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের অধিবাসী। মায়ের নাম শচী দেবী।  তাঁর পিতামহ উপেন্দ্র মিশ্রের আদি নিবাস ছিল সিলেটে। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র উড়িশ্যা থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।

শৈশবে তাঁর বড় ভাই বিশ্বরূপ সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন।বিশ্বরূপের মতো চৈতন্য যাতে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ না করেন, এই কারণে পিতামাতা তাঁকে আগলে রাখতেন। শাস্ত্রীয় প্রাধমিক পাঠ নিয়েছিলেন পিতার কাছে। উপনয়নের পরে তিনি গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র অধ্যায়ন করেন। অসাধারণ মেধায় যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি পণ্ডিত হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কথিত আছে সে সময়ে তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের তাঁর তুল্য আর কেউ ছিলেন না। এই সময় থেকে জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তন করতেন নিয়মিত।

১৬ বৎসর বয়সে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিবাহ করেন। এরপর তিনি তাঁর পিতৃভূমি সিলেটে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আবার নদীয়ায় ফিরে আসেন। নদীয়ায় ফিরে এসে তিনি দেখেন যে, তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই সময় তিনি কিছুটা উদাসী জীবনযাপন করা শুরু করেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে, তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া নামক একটি সুন্দরী কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ দেন। এরপর তাঁর পিতার মৃত্যু হলে, তিনি গয়ায় পিণ্ডদান করতে যান। এই সময় তিনি পণ্ডিত ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বরপুরীর জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর কাছে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এরপর তিনি ধ্যানের দ্বারা কৃষ্ণকে পাওয়ার সাধনা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এক নতুন মানুষ হয়ে নদীয়ায় ফিরে আসেন। তাঁর দর্শন, জ্ঞান এবং আচরণের দ্বারা অচিরেই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।

এর বেশ কিছু আগে থেকেই অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিত প্রমুখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি বৈষ্ণব গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। চৈতন্যদেব দেশে ফিরে এই বৈষ্ণব গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে ওঠেন এবং ধীরে ধীরে তিনি এই গোষ্ঠীর একজন অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক গোস্বামী'র কাছে দীক্ষা নেন।

এরপর তিনি ২৪ বৎসর বয়সে কেশব ভারতী নামক অপর এক সাধকের কাছে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর নাম হয়  নিমাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মস্থান ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করে পুরীতে আসেন। এখানে তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করে কাটাতেন। এখানে তিনি দুই বৎসর বাস করার পর নদীয়া ফিরে আসেন। এরপর তিনি মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে, তিনি বারাণসী, প্রয়াগ, মথুরা ও বৃন্দাবন দর্শন করেন। অবশেষ তিনি পুনরায় পুরীতে চলে যান এবং সেখানেই অবশিষ্ট জীবন কাটিয়ে দেন।

১৫৩৩-৩৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি মৃত্যবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে নানা রকম গল্প আছে। চৈতন্যমঙ্গলের রচয়িতা জয়ানন্দের মতে, রথের সামনে নর্তনকালে পায়ে পাথরের কুচি ঢুকে মারাত্মকভাবে আহত হন। এবং এই আঘাত থেকেই তাঁর মৃত্যু হয়। অনেকের মতে, তিনি ভাবাবেগে পুরীর সমুদ্রজলে নেমে গিয়েছিলেন। পরে স্রোতের টানে তিনি সমুদ্রে হারিয়ে যান।

উড়িশার সূর্যবংশীয় হিন্দু সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্য মহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। ভক্তদের মতে, জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।