প্রথম খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ
“ও
পি–ও পিপি–ও প্রফুল্ল–ও পোড়ারমুখী ।”
“যাই মা ।”
মা ডাকিল–মেয়ে কাছে আসিল। বলিল, “কেন মা?”
মা বলিল, “যা না–ঘোষেদের বাড়ী থেকে একটা বেগুন চেয়ে নিয়ে আয় না
।”
প্রফুল্লমুখী বলিল, “আমি পারিব না। আমার চাইতে লজ্জা করে ।”
মা। তবে খাবি কি? আজ ঘরে যে কিছু নেই।
প্র। তা শুধু ভাত খাব। রোজ রোজ চেয়ে খাব কেন গা?
মা। যেমন অদৃষ্ট করে এসেছিলি। কাঙ্গাল গরিবের চাইতে লজ্জা কি?
প্রফুল্ল কথা কহিল না। মা বলিল, “তুই তবে ভাত চড়াইয়া দে, আমি কিছু তরকারির
চেষ্টায় যাই ।”
প্রফুল্ল বলিল, “আমার মাথা খাও, আর চাইতে যাইও না। ঘরে চাল আছে,
নুন আছে, গাছে কাঁচা লঙ্কা আছে–মেয়ে মানুষের তাই ঢের ।”
অগত্যা প্রফুল্লের মাতা সম্মত হইল। ভাতের জল চড়াইয়াছিল, মা চাল
ধুইতে গেল। চাল ধুইবার জন্য ধুচুনি হাতে করিয়া মাতা গালে হাত দিল। বলিল, “চাল
কই?” প্রফুল্লকে দেখাইল, আধ মুটা চাউল আছে মাত্র–তাহা একজনের আধপেটা হইবে না।
মা ধুচুনি হাতে করিয়া বাহির হইল। প্রফুল্ল বলিল, “কোথা যাও?”
মা। চাল ধার করিয়া আনি–নইলে শুধু ভাতই কপালে জোটে কই?
প্র। আমরা লোকের কত চাল ধারি–শোধ দিতে পারি না–তুমি আর চাল ধার
করিও না।
প্র। আবাগীর মেয়ে, খাবি কি? ঘরে যে একটি পয়সা নাই।
প্র। উপস করিব।
মা। উপস করিয়া কয় দিন বাঁচিবি?
প্র। না হয় মরিব।
মা। আমি মরিলে যা হয় করিস; তুই উপস করিয়া মরিবি, আমি চক্ষে
দেখিতে পারিব না। যেমন করিয়া পারি, ভিক্ষা করিয়া তোকে খাওয়াইব।
প্র। ভিক্ষাই বা কেন করিতে হইবে? এক দিনের উপবাসে মানুষ মরে না।
এসো না, মায়ে ঝিয়ে আজ পৈতে তুলি। কাল বেচিয়া কড়ি করিব।
মা। সূতা কই?
প্র। কেন, চরকা আছে।
মা। পাঁজ কই?
তখন প্রফুল্লমুখী অধোবদনে রোদন করিতে লাগিল। মা ধুচুনি হাতে
আবার চাউল ধার করিয়া আনিতে চলিল, তখন প্রফুল্ল মার হাত হইতে ধুচুনি কাড়িয়া লইয়া
তফাতে রাখিল। বলিল, “মা, আমি কেন চেয়ে ধার করে খাব–আমার ত সব আছে?”
মা চক্ষের জল মুছাইয়া বলিল, “সবই ত আছে মা –কপালে ঘটিল কৈ?”
প্র। কেন ঘটে না মা–আমি কি অপরাধ করিয়াছি যে, শ্বশুরের অন্ন
থাকিতে আমি খাইতে পাইব না?
মা। এই অভাগীর পেটে হয়েছিলি, এই অপরাধ–আর তোমার কপাল। নহিলে
তোমার অন্ন খায় কে?
প্র। শোন মা, আমি আজ মন ঠিক করিয়াছি–শ্বশুরের অন্ন কপালে জোটে,
তবে খাইব–নইলে আর খাইব না। তুমি চেয়ে চিন্তে যে প্রকারে পার, আনিয়া খাও। খাইয়া
আমাকে সঙ্গে করিয়া শ্বশুরবাড়ী রাখিয়া আইস।
মা। সে কি মা! তাও কি হয়?
প্র। কেন হয় না মা?
মা। না নিতে এলে কি শ্বশুরবাড়ী যেতে আছে?
প্র। পরের বাড়ী চেয়ে খেতে আছে, আর না নিতে এলে আপনার শ্বশুরবাড়ী
যেতে নেই?
মা। তারা যে কখনও তোমার নাম করে না।
প্র। না করুক–তাতে আমার অপমান নাই। যাহাদের উপর আমার ভরণপোষণের
ভার, তাহাদের কাছে অন্নের ভিক্ষা করিতে আমার অপমান নাই। আপনার ধন আপনি চাহিয়া
খাইব–তাহাতে আমার লজ্জা কি?
মা চুপ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। প্রফুল্ল বলিল, “তোমাকে একা রাখিয়া
আমি যাইতে চাহিতাম না–আমার দুঃখ ঘুচিলে তোমারও দুঃখ কমিবে, এই ভরসায় যাইতে
চাহিতেছি ।”
মাতে মেয়েতে অনেক কথাবার্তা হইল। মা বুঝিল যে, মেয়ের পরামর্শই
ঠিক। তখন মা, যে কয়টি চাউল ছিল, তাহা রাঁধিল। কিন্তু প্রফুল্ল কিছুতেই খাইল না।
কাজেই তাহার মাতাও খাইল না। তখন বলিল, “তবে আর বেলা কাটাইয়া কি হইবে? অনেক পথ
।”
তাহার মাতা বলিল, “আয় তোর চুলটা বাঁধিয়া দিই ।”
প্রফুল্ল বলিল, “না থাক ।”
মা ভাবিল, “থাক। আমার মেয়েকে সাজাইতে হয় না ।”
মেয়ে ভাবিল, “থাক। সেজে গুজে কি ভুলাইতে যাইব? ছি!”
তখন দুই জনে মলিন বেশে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
বরেন্দ্রভূমে ভূতনাথ নামে গ্রাম; সেইখানে প্রফুল্লমুখীর শ্বশুরালয়। প্রফুল্লের
দশা যেমন হউক, তাহার শ্বশুর হরবল্লভবাবু খুব বড়মানুষ লোক। তাঁহার অনেক জমিদারী
আছে, দোতালা বৈঠকখানা, ঠাকুরবাড়ী, নাটমন্দির, দপ্তরখানা, খিড়কিতে বাগান, পুকুর
প্রাচীরে বেড়া। সে স্থান প্রফুল্লমুখীর পিত্রালয় হইতে ছয় ক্রোশ। ছয় ক্রোশ পথ
হাঁটিয়া মাতা ও কন্যা অনশনে বেলা তৃতীয় প্রহরের সময়ে সে ধনীর গৃহে প্রবেশ
করিলেন।
প্রবেশকালে প্রফুল্লের মার পা উঠে না। প্রফুল্ল কাঙ্গালের মেয়ে
বলিয়া যে হরবল্লভবাবু তাঁহাকে ঘৃণা করিতেন, তাহা নহে। বিবাহের পরে একটা গোল
হইয়াছিল। হরবল্লভ কাঙ্গাল দেখিয়াও ছেলের বিবাহ দিয়াছিলেন। মেয়েটি পরমসুন্দরী,
তেমন মেয়ে আর কোথাও পাইলেন না, তাই সেখানে বিবাহ দিয়াছিলেন। এদিকে প্রফুল্লের
মা, কন্যা বড়মানুষের ঘরে পড়িল, এই উৎসাহে সর্বস্ব ব্যয় করিয়া বিবাহ দিয়াছিলেন।
সেই বিবাহতেই–তাঁর যাহা কিছু ছিল, ভস্ম হইয়া গেল। সেই অবধি এই অন্নের কাঙ্গাল।
কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সে সাধের বিবাহে বিপরীত ফল ফলিল। সর্বস্ব ব্যয়
করিয়াও–সর্বস্বই তার কত টাকা?–সর্বস্ব ব্যয় করিয়াও সে বিধবা স্ত্রীলোক সকল দিক
কুলান করিতে পারিল না। বরযাত্রদিগের লুচি মণ্ডায়, দেশ কাল পাত্র বিবেচনায়,
উত্তম ফলাহার করাইল। কিন্তু কন্যাযাত্রগণের কেবল চিড়া দই। ইহাতে প্রতিবাসী
কন্যাযাত্রেরা অপমান বোধ করিলেন। তাঁহারা খাইলেন না–উঠিয়া গেলেন। ইহাতে
প্রফুল্লের মার সঙ্গে তাঁহাদের কোন্দল বাঁধিল; প্রফুল্লের মা বড় গালি দিল।
প্রতিবাসীরা একটা বড় রকম শোধ লইল।
পাকস্পর্শের দিন হরবল্লভ বেহাইনের প্রতিবাসী সকলকে নিমন্ত্রণ
করিলেন। তাহারা কেহ গেল না–একজন লোক দিয়া বলিয়া পাঠাইল যে, যে কুলটা,
জাতিভ্রষ্ট, তাহার সঙ্গে হরবল্লভবাবুর কুটুম্বতা করিতে হয় করুন–বড়মানুষের সব
শোভা পায়, কিন্তু আমরা কাঙ্গাল গরিব, জাতই আমাদের সম্বল–আমরা জাতিভ্রষ্টার
কন্যার পাকস্পর্শে জলগ্রহণ করিব না। সমবেত সভামধ্যে এই কথা প্রচার হইল।
প্রফুল্লের মা একা বিধবা, মেয়েটি লইয়া ঘরে থাকে–তখন বয়সও যায় নাই–কথা অসম্ভব
বোধ হইল না, বিশেষ, হরবল্লভের মনে হইল যে, বিবাহের রাত্রে প্রতিবাসীরা
বিবাহ-বাড়ীতে খায় নাই। প্রতিবাসীরা মিথ্যা বলিবে কেন? হরবল্লভ বিশ্বাস করিলেন।
সভার সকলেই বিশ্বাস করিল। নিমন্ত্রিত সকলেই ভোজন করিল বটে–কিন্তু কেহই নববধূর
স্পৃষ্ট ভোজ্য খাইল না। পরদিন হরবল্লভ বধূকে মাত্রালয়ে পাঠাইয়া দিলেন। সেই অবধি
প্রফুল্ল ও তাহার মাতা তাঁহার পরিত্যাজ্য হইল। সেই অবধি আর কখন তাহাদের সংবাদ
লইলেন না; পুত্রকে লইতেও দিলেন না। পুত্রের অন্য বিবাহ দিলেন। প্রফুল্লের মা
দুই এক বার কিছু সামগ্রী পাঠাইয়া দিয়াছিল, হরবল্লভ তাহা ফিরাইয়া দিয়াছিলেন। তাই
আজ সে বাড়ীতে প্রবেশ করিতে প্রফুল্লের মার পা কাঁপিতেছিল।
কিন্তু যখন আসা হইয়াছে, তখন আর ফেরা যায় না। কন্যা ও মাতা সাহসে
ভর করিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। তখন কর্তা অন্তঃপুরমধ্যে অপরাহ্নিক নিদ্রার
সুখে অভিভূত। গৃহিণী–অর্থাৎ প্রফুল্লের শাশুড়ী, পা ছড়াইয়া পাকা চুল
তুলাইতেছিলেন। এমন সময়ে, সেখানে প্রফুল্ল ও তার মা উপস্থিত হইল। প্রফুল্ল মুখে
আধ হাত ঘোমটা টানিয়া দিয়াছিল। তাহার বয়স এখন আঠার বৎসর।
গিন্নী ইহাদিগকে দেখিয়া বলিলেন, “তোমরা কে গা?”
প্রফুল্লের মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “কি বলিয়াই বা
পরিচয় দিব?”
গিন্নী। কেন–পরিচয় আবার কি বলিয়া দেয়?
প্রফুল্লের মা। আমরা কুটুম্ব।
গিন্নী। কুটুম্ব? কে কুটুম্ব গা?
সেখানে তারার মা বলিয়া একজন চাকরাণী কাজ করিতেছিল। সে দুই এক
বার প্রফুল্লদিগের বাড়ী গিয়াছিল–প্রথম বিবাহের পরেই। সে বলিল, “ওগো চিনেছি গো!
ওগো চিনেছি! কে! বেহান?”
(সে কালে পরিচারিকারা গৃহিণীর সম্বন্ধ ধরিত।)
গিন্নী। বেহান? কোন্ বেহান?
তারার মা। দুর্গাপুরের বেহান গো–তোমার বড় ছেলের বড় শাশুড়ী।
গিন্নী বুঝিলেন। মুখটা অপ্রসন্ন হইল। বলিলেন, “বসো ।”
বেহান বসিল–প্রফুল্ল দাঁড়াইয়া রহিল। গিন্নী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ
মেয়েটি কে গা?”
প্রফুল্লের মা, “তোমার বড় বউ ।”
গিন্নী বিমর্ষ হইয়া কিছু কাল চুপ করিয়া রহিলেন। পরে বলিলেন,
“তোমরা কোথায় এসেছিলে?”
প্রফুল্লের মা। তোমার বাড়ীতেই এসেছি।
গিন্নী। কেন গা?
প্র, মা। কেন, আমার মেয়েকে কি শ্বশুরবাড়ীতে আসিতে নাই?
গিন্নী। আসিতে থাকিবে না কেন? শ্বশুর শাশুড়ী যখন আনিবে, তখন
আসিবে। ভাল মানুষের মেয়েছেলে কি গায়ে পড়ে আসে?
প্র, মা। শ্বশুর শাশুড়ী যদি সাত জন্মে নাম না করে?
গিন্নী। নামই যদি না করে–তবে আসা কেন?
প্র, মা। খাওয়ায় কে? আমি বিধবা অনাথিনী, তোমার বেটার বউকে আমি
খাওয়াই কোথা থেকে?
গিন্নী। যদি খাওয়াতেই পারিবে না, তবে পেটে ধরেছিলে কেন?
প্র, মা। তুমি কি খাওয়া পরা হিসাব করিয়া বেটা পেটে ধরেছিলে? তা
হলে সেই সঙ্গে বেটার বউয়ের খোরাক পোষাকটা ধরিয়া নিতে পার নাই?
গিন্নী। আ মলো! মাগী বাড়ী বয়ে কোঁদল কর্তে এসেছে দেখি যে?
প্র, মা। না, কোঁদল করতে আসি নাই। তোমার বউ একা আসতে পারে না,
তাই রাখিতে সঙ্গে আসিয়াছি। এখন তোমার বউ পৌঁছিয়াছে, আমি চলিলাম।
এই বলিয়া প্রফুল্লের মা বাটীর বাহির হইয়া চলিয়া গেল। অভাগীর
তখনও আহার হয় নাই।
মা গেল, কিন্তু প্রফুল্ল গেল না। যেমন ঘোমটা দেওয়া ছিল, তেমনই
ঘোমটা দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শাশুড়ী বলিল, “তোমার মা গেল, তুমিও যাও।”
প্রফুল্ল নড়ে না।
গিন্নী। নড় না যে?
প্রফুল্ল নড়ে না।
গিন্নী। কি জ্বালা! আবার কি তোমার সঙ্গে একটা লোক দিতে হবে
না কি?
এবার প্রফুল্লের মুখের ঘোমটা খুলিল; চাঁদপানা মুখ, চক্ষের দর-দর
ধারা বহিতেছে। শাশুড়ী মনে মনে ভাবিলেন, আহা! এমন চাঁদপানা বৌ নিয়ে ঘর কর্তে
পেলেম না!” মন একটু নরম হলো।
প্রফুল্ল অতি অস্ফুটস্বরে বলিল, “আমি যাইব বলিয়া আসি নাই।”
গিন্নী। তা কি করিব মা–আমার কি অসাধ যে, তোমায় নিয়ে ঘর করি?
লোকে পাঁচ কথা বলে– একঘরে করবে বলে, কাজেই তোমায় ত্যাগ করতে হয়েছে।
প্রফুল্ল। মা, একঘরে হবার ভয়ে কে কবে সন্তান ত্যাগ করেছে? আমি
কি তোমার সন্তান নই?
শাশুড়ীর মন আরও নরম হলো। বলিলেন, “কি করব মা, জেতের ভয়।”
প্রফুল্ল পূর্ববৎ অস্ফুটস্বরে বলিল, “হলেম যেন আমি অজাতি–কত
শূদ্র তোমার ঘরে দাসীপনা করিতেছে–আমি তোমার ঘরে দাসীপনা করিতে দোষ কি?”
গিন্নী আর যুঝিতে পারিলেন না। বলিলেন, “তা মেয়েটি লক্ষ্মী,
রূপেও বটে, কথায়ও বটে। তা যাই কর্তার কাছে, তিনি কি বলেন। তুমি এখানে বসো মা,
বসো।”
প্রফুল্ল তখন চাপিয়া বসিল। সেই সময়ে, একটি কপাটের আড়াল হইতে
একটি চতুর্দশ বর্ষীয়া বালিকা–সেও সুন্দরী, মুখে আড়ঘোমটা–সে প্রফুল্লকে হাতছানি
দিয়া ডাকিল। প্রফুল্ল ভাবিল, এ আবার কি? উঠিয়া বালিকার কাছে গেল।