বঙ্কিম-রচনাবলী

দেবী চৌধুরাণী
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রথম খণ্ড
তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    যখন গৃহিণী ঠাকুরাণী হেলিতে দুলিতে হাতের বাউটির খিল খুঁটিতে খুঁটিতে কর্তা মহাশয়ের নিকেতনে সমুপস্থিতা, তখন কর্তা মহাশয়ের ঘুম ভাঙ্গিয়াছে; হাতে মুখে জল দেওয়া হইয়াছে–হাত মুখ মোছা হইতেছে। দেখিয়া, কর্তার মনটা কাদা করিয়া ছানিয়া লইবার জন্য গৃহিণী ঠাকুরাণী বলিলেন, “কে ঘুম ভাঙ্গাইল? আমি এত করে বারণ করি, তবু কেউ শোনে না!”
    কর্তা মহাশয় মনে মনে বলিলেন, “ঘুম ভাঙ্গাইবার আঁধি তুমি নিজে–আজ বুঝি কি দরকার আছে?” প্রকাশ্যে বলিলেন, “কেউ ঘুম ভাঙ্গায় নাই। বেশ ঘুমাইয়াছি–কথাটা কি?”
    গিন্নী মুখখানা হাসি-ভরাভরা করিয়া বলিলেন, “আজ একটা কাণ্ড হয়েছে। তাই বলতে এসেছি।”
    এইরূপ ভূমিকা করিয়া এবং একটু একটু নথ ও বাউটি নাড়া দিয়া–কেন না, বয়স এখনও পঁয়তাল্লিশ বৎসর মাত্র–গৃহিণী, প্রফুল্ল ও তার মাতার আগমন ও কথোপকথন বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বলিলেন। বধূর চাঁদপানা মুখ ও মিষ্ট কথাগুলি মনে করিয়া, প্রফুল্লের দিকে অনেক টানিয়া বলিলেন। কিন্তু মন্ত্র তন্ত্র কিছুই খাটিল না। কর্তার মুখ বৈশাখের মেঘের মত অন্ধকার হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, “এত বড় স্পর্দ্ধা! সেই বাগদী বেটী আমার বাড়ীতে ঢোকে? এখনই ঝাঁটা মেরে বিদায় কর।”
    গিন্নী বলিলেন, “ছি! ছি! অমন কথা কি বলতে আছে–হাজার হোক, বেটার বউ–আর বাগদীর মেয়ে বা কিরূপে হলো? লোকে বললেই কি হয়?”
    গিন্নী ঠাকুরুণ হার কাত নিয়ে খেলতে বসেছেন–কাজে কাজেই এই রকম বদ রঙ্গ চালাইতে লাগিলেন। কিছুতেই কিছু হইল না। “বাগদী বেটীকে ঝাঁটা মেরে বিদায় কর।” এই হুকুমই বাহাল রহিল।
    গিন্নী শেষে রাগ করিয়া বলিলেন, “ঝাঁটা মারিতে হয়, তুমি মার; আমি আর তোমার ঘরকন্নার কথায় থাকিব না।” এই বলিয়া গিন্নী রাগে গর্ গর্ করিয়া বাহিরে আসিলেন। যেখানে প্রফুল্লকে রাখিয়া গিয়াছিলেন, সেইখানে আসিয়া দেখিলেন, প্রফুল্ল সেখানে নাই।
    প্রফুল্ল কোথায় গিয়াছে, তাহা পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে। একখানা কপাটের আড়াল হইতে ঘোমটা দিয়ে একটি চৌদ্দ বছরের মেয়ে তাকে হাতছানি দিয়া ডাকিয়াছিল। প্রফুল্ল সেখানে গেল। প্রফুল্ল সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্র বালিকা দ্বার রুদ্ধ করিল।
    প্রফুল্ল বলিল, “দ্বার দিলে কেন?”
    মেয়েটি বলিল, “কেউ না আসে। তোমার সঙ্গে দুটো কথা কব, তাই।”
    প্রফুল্ল বলিল, “তোমার নাম কি ভাই?”
    সে বলিল, “আমার নাম সাগর, ভাই।”
    প্র। তুমি কে, ভাই?
    সা। আমি, ভাই, তোমার সতীন।
    প্র। তুমি আমায় চেন নাকি?
    সা। এই যে আমি কপাটের আড়াল থেকে সব শুনিলাম।
    প্র। তবে তুমিই ঘরণী গৃহিণী–
    সা। দূর, তা কেন? পোড়া কপাল আর কি–আমি কেন সে হতে গেলেম? আমার কি তেমনই দাঁত উঁচু, না আমি তত কালো?
    প্র। সে কি–কার দাঁত উঁচু?
    সা। কেন? যে ঘরণী গৃহিণী।
    প্র। সে আবার কে?
    সা। জান না? তুমি কেমন করেই বা জানবে? কখন ত এসো নি, আমাদের আর এক সতীন আছে জান না?
    প্র। আমি ত আমি ছাড়া আর এক বিয়ের কথাই জানি–আমি মনে করিয়াছিলাম, সেই তুমি।
    সা। না। সে সেই,–আমার ত তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে।
    প্র। সে বুঝি বড় কুৎসিত?
    সা। রূপ দেখে আমার কান্না পায়!
    প্র। তাই বুঝি আবার তোমায় বিবাহ করেছে?
    সা। না, তা নয়। তোমাকে বলি, কারও সাক্ষাতে বলো না। (সাগর বড় চুপি চুপি কথা কহিতে লাগিল) আমার বাপের ঢের টাকা আছে। আমি বাপের এক সন্তান। তাই সেই টাকার জন্য–
    প্র। বুঝেছি, আর বলিতে হবে না। তা তুমি সুন্দরী। যে কুৎসিত, সে ঘরণী গৃহিণী হলো কিসে?
    সা। আমি বাপের একটি সন্তান, আমাকে পাঠায় না; আর আমার বাপের সঙ্গে আমার শ্বশুরের সঙ্গে বড় বনে না। তাই আমি এখানে কখন থাকি না। কাজেকর্মে কখন আনে। এই দুই চারি দিন এসেছি, আবার শীঘ্র যাব।
    প্রফুল্ল দেখিল যে, সাগর দিব্য মেয়ে–সতীন বলিয়া ইহার উপর রাগ হয় না। প্রফুল্ল বলিল, “আমায় ডাকলে কেন?”
    সা। তুমি কিছু খাবে?
    প্রফুল্ল হাসিল, বলিল, “কেন, এখন খাব কেন?”
    সা। তোমার মুখ শুকনো, তুমি অনেক পথ এসেছ, তোমার তৃষ্ণা পেয়েছে। কেউ তোমায় কিছু খেতে বললেন না। তাই তোমাকে ডেকেছি।
    প্রফুল্ল তখনও পর্যন্ত কিছু খায় নাই। পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্ত উত্তর করিল, “শাশুড়ী গেছেন শ্বশুরের কাছে মন বুঝতে। আমার অদৃষ্টে কি হয়, তা না জেনে আমি এখানে কিছু খাব না। ঝাঁটা খেতে হয় ত তাই খাব, আর কিছু খাব না।”
    সা। না, না। এদের কিছু তোমার খেয়ে কাজ নাই। আমার বাপের বাড়ীর সন্দেশ আছে–বেশ সন্দেশ।
    এই বলিয়া সাগর কতকগুলা সন্দেশ আনিয়া প্রফুল্লের মুখে গুঁজিয়া দিতে লাগিল। অগত্যা প্রফুল্ল কিছু খাইল। সাগর শীতল জল দিল, পান করিয়া প্রফুল্ল শরীর স্নিগ্ধ করিল। তখন প্রফুল্ল বলিল, “আমি শীতল হইলাম, কিন্তু আমার মা না খাইয়া মরিয়া যাইবে।”
    সা। তোমার মা কোথায় গেলেন?
    প্র। কি জানি? বোধ হয়, পথে দাঁড়াইয়া আছেন।
    সা। এক কাজ করব?
    প্র। কি?
    সা। ব্রহ্ম ঠানদিদিকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেব?
    প্র। তিনি কে?
    সা। ঠাকুরের সম্পর্কে পিসী–এই সংসারে থাকেন।
    প্র। তিনি কি করবেন?
    সা। তোমার মাকে খাওয়াবেন দাওয়াবেন।
    প্র। মা এ বাড়ীতে কিছু খাবেন না।
    সা। দূর! তাই কি বলছি? কোন বামুন-বাড়ীতে।
    প্র। যা হয় কর, মার কষ্ট আর সহ্য হয় না।
    সাগর চকিতের মত ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে যাইয়া সব বুঝাইয়া বলিল। ব্রহ্মঠাকুরাণী বলিল, “মা তাই ত! গৃহস্থবাড়ী উপবাসী থাকিবেন! অকল্যাণ হবে যে।” ব্রহ্ম প্রফুল্লের মার সন্ধানে বাহির হইল। সাগর ফিরিয়া আসিয়া প্রফুল্লকে সংবাদ দিল। প্রফুল্ল বলিল, “এখন ভাই, যে গল্প করিতেছিলে, সেই গল্প কর।”
    সা। গল্প আর কি? আমি ত এখানে থাকি না–থাকতে পাবও না। আমার অদৃষ্ট মাটির আঁবের মত–তাকে তোলা থাকব, দেবতার ভোগে কখন লাগিব না। তা, তুমি এয়েচ, যেমন করে পার, থাক। আমরা কেউ সেই কালপেঁচাটাকে দেখিতে পারি না।
    প্র। থাকব বলেই ত এসেছি। থাকতে পেলে ত হয়।
    সা। তা দেখ, শ্বশুরের যদি মত না হয়, তবে এখনই চলে যেও না।
    প্র। না গিয়া কি করিব? আর কি জন্য থাকিব?–থাকি, যদি–
    সা। যদি কি?
    প্র। যদি তুমি আমার জন্ম সার্থক করাইতে পার।
    সা। সে কিসে হবে ভাই?
    প্রফুল্ল ঈষৎ হাসিল। তখনি হাসি নিবিয়া গেল, চক্ষে জল পড়িল। বলিল, “বুঝ নাই ভাই?”
    সাগর তখন বুঝিল। একটু ভাবিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তুমি সন্ধ্যার পর এই ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকিও। দিনের বেলা ত আর দেখা হবে না।”
    পাঠক স্মরণ রাখিবেন, আমরা এখনকার লজ্জাহীনা নব্যাদিগের কথা লিখিতেছি না। আমাদের গল্পের তারিখ এক শত বৎসর পূর্বে। চল্লিশ বৎসর পূর্বেও যুবতীরা কখন দিনমানে স্বামিদর্শন পাইতেন না।
    প্রফুল্ল বলিল, “কপালে কি হয় তাহা আগে জানিয়া আসি। তার পর তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিব। কপালে যাই থাকে, একবার স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া যাইব। তিনি কি বলেন, শুনিয়া যাইব।”
    এই বলিয়া প্রফুল্ল বাহিরে আসিল। দেখিল, তাহার শাশুড়ী তাহার তল্লাস করিতেছেন। প্রফুল্লকে দেখিয়া গিন্নী বলিলেন, “কোথায় ছিলে মা?”
    প্র। বাড়ী-ঘর দেখিতেছিলাম।
    গিন্নী। আহা! তোমারই বাড়ী-ঘর, বাছা–তা কি করব? তোমার শ্বশুর কিছুতেই মত করেন না।
    প্রফুল্লের মাথায় বজ্রাঘাত হইল। সে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। কাঁদিল না–চুপ করিয়া রহিল। শাশুড়ীর বড় দয়া হইল। গিন্নী মনে মনে কল্পনা করিলেন–আর একবার নথনাড়া দিয়া দেখিব। কিন্তু সে প্রকাশ করিলেন না–কেবল বলিলেন, “আজ আর কোথায় যাইবে? আজ এইখানে থাক। কাল সকালে যেও।”
    প্রফুল্ল মাথা তুলিয়া বলিল, “তা থাকিব–একটা কথা ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিও। আমার মা চরকা কাটিয়া খায়, তাহাতে একজন মানুষের এক বেলা আহার কুলায় না। জিজ্ঞাসা করিও–আমি কি করিয়া খাইব? আমি বাগদীই হই–মুচিই হই–তাঁহার পুত্রবধূ। তাঁহার পুত্রবধূ কি করিয়া দিনপাত করিবে?”
    শাশুড়ী বলিল, “অবশ্য বলিব।” তার পর প্রফুল্ল উঠিয়া গেল।


চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    সন্ধ্যার পর সেই ঘরে সাগর ও প্রফুল্ল, দুই জনে দ্বার বন্ধ করিয়া চুপি চুপি কথাবার্তা কহিতেছিল, এমন সময়ে কে আসিয়া কপাটে ঘা দিল। সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “কে গো?”
    “আমি গো।”
    সাগর প্রফুল্লের গা টিপিয়া চুপি চুপি বলিল, “কথা কসনে; সেই কালপেঁচাটা এসেছে ।”
    প্র। সতীন?
    সা। হ্যাঁ–চুপ!
    যে আসিয়াছিল, সে বলিল, “কে গা ঘরে, কথা কসনে কেন? যেন সাগর বোয়ের গলা শুনলাম না?”
    সা। তুমি কে গা–যেন নাপিত বোয়ের গলা শুনলাম না?
    “আঃ মরণ আর কি! আমি কি নাপিত বোয়ের মতন?”
    সা। কে তবে তুমি?
    “তোর সতীন! সতীন! সতীন! নাম নয়ান বৌ।”
    (বউটির নাম–নয়নতারা–লোকে তাহাকে “নয়ান বৌ” বলিত–সাগরকে “সাগর বৌ” বলিত।)
    সাগর তখন কৃত্রিম ব্যস্ততার সহিত বলিল, “কে! দিদি! বালাই, তুমি কেন নাপিত বৌয়ের মতন হতে যাবে? সে যে একটু ফরসা।”
    ন। মরণ আর কি–আমি কি তার চেয়েও কালো? তা সতীন এমনই বটে–তবু যদি চৌদ্দ বছরের না হতিস!
    সা। তা চৌদ্দ বছর হলো ত কি হলো–তুমি সতের–তোমার চেয়ে আমার রূপও আছে, যৌবনও আছে।
    ন। রূপ যৌবন নিয়ে বাপের বাড়ীতে বসে বসে ধুয়ে খাস। আমার যেমন মরণ নাই, তাই তোর কাছে কথা জিজ্ঞাসা করতে এলেম।
    সা। কি কথা, দিদি?
    ন। তুই দোরই খুললি নে, তার কথা কব কি? সন্ধ্যে রাত্রে দোর দিয়েছিস কেন লা?
    সা। আমি ভাই লুকিয়ে দুটো সন্দেশ খাচ্চি। তুমি কি খাও না?
    ন। তা খা খা। (নয়ন নিজে সন্দেশ বড় ভালবাসিত) বলি, জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম কি, আবার একজন এয়েছে না কি?
    সা। আবার একজন কি? স্বামী?
    ন। মরণ আর কি! তাও কি হয়?
    সা। হলে ভাল হতো–দুই জনে ভাগ করিয়া নিতাম। তোমার ভাগে নূতনটা দিতাম।
    ন। ছি! ছি! ও সব কথা কি মুখে আনে?
    সা। মনে?
    ন। তুই আমায় যা ইচ্ছা তাই বলিবি কেন?
    সা। তা ভাই, কি জিজ্ঞাসা করবে, না বুঝাইয়া বলিলে কেমন করিয়া উত্তর দিই?
    ন। বলি, গিন্নীর না কি আর একটি বউ এয়েছে?
    সা। কে বউ?
    ন। সেই মুচি বউ।
    সা। মুচি? কই, শুনি নে ত।
    ন। মুচি, না হয় বাগদী?
    সা। তাও শুনি নে।
    ন। শোন নি–আমাদের একজন বাগদী সতীন আছে।
    সা। কই? না।
    ন। তুই বড় দুষ্ট। সেই যে, প্রথম যে বিয়ে।
    সা। সে ত বামনের মেয়ে।
    ন। হ্যাঁ, বামনের মেয়ে! তা হলে আর নিয়ে ঘর করে না?
    সা। কাল যদি তোমায় বিদায় দিয়ে, আমায় নিয়ে ঘর করে, তুমি কি বাগদীর মেয়ে হবে?
    ন। তুই আমায় গাল দিবি কেন লা, পোড়ারমুখী?
    সা। তুই আর এক জনকে গাল দিচ্ছিস কেন লা, পোড়ারমুখী?
    ন। মরগে যা–আমি ঠাকুরুণকে গিয়া বলিয়া দিই, তুই বড় মানুষের মেয়ে বলে আমায় যা ইচ্ছে তাই বলিস।
    এই বলিয়া নয়নতারা ওরফে কালপেঁচা ঝমর ঝমর করিয়া ফিরিয়া যায়–তখন সাগর দেখিল প্রমাদ! ডাকিল, “না দিদি, ফের ফের। ঘাট হয়েছে, দিদি ফের! এই দোর খুলিতেছি।”
    নয়নতারা রাগিয়াছিল–ফিরিবার বড় মত ছিল না। কিন্তু ঘরের ভিতর দ্বার দিয়া সাগর কত সন্দেশ খাইতেছে, ইহা দেখিবার একটু ইচ্ছা ছিল, তাই ফিরিল। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিল–সন্দেশ নহে–আর একজন লোক আছে। জিজ্ঞাসা করিল, “এ আবার কে?”
    সা। প্রফুল্ল।
    ন। সে আবার কে?
    সা। মুচি বৌ।
    ন। এই সুন্দর?
    সা। তোমার চেয়ে নয়।
    ন। নে, আর জ্বালাস নে। তোর চেয়ে ত নয়।