বঙ্কিম-রচনাবলী

দেবী চৌধুরাণী
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রথম খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    এদিকে কর্তা মহাশয় এক প্রহর রাত্রে গৃহমধ্যে ভোজনার্থ আসিলেন। গৃহিণী ব্যজনহস্তে ভোজন-পাত্রের নিকট শোভমানা–ভাতে মাছি নাই–তবু নারীধর্মের পালনার্থ মাছি তাড়াইতে হইবে। হায়! কোন্ পাপিষ্ঠ নরাধমেরা এ পরম রমণীয় ধর্ম লোপ করিতেছে? গৃহিণীর পাঁচ জন দাসী আছে–কিন্তু স্বামিসেবা–আর কার সাধ্য করিতে আসে? গৃহিণীর ধর্মর লোপ করিতেছে, হে আকাশ! তাহাদের মাথার জন্য কি তোমার বজ্র নাই?
    কর্তা আহার করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাগদী বেটী গিয়াছে কি?”
    গৃহিণী মাছি তাড়াইয়া নথ নাড়িয়া বলিলেন, “রাত্রে আবার সে কোথা যাবে? রাত্রে একটা অতিথি এলে তুমি তাড়াও না–আর আমি বৌটাকে রাত্রে তাড়িয়ে দেব?”
    কর্তা। অতিথ হয়, অতিথশালায় যাক না? এখানে কেন?
    গিন্নী। আমি তাড়াতে পারব না, আমি ত বলেছি। তাড়াতে হয়, তুমি তাড়াও। বড় সুন্দরী বৌ কিন্তু–
    কর্তা। বাগদীর ঘরে অমন দুটো একটা সুন্দর হয়। তা আমি তাড়াচ্চি। বজ্রকে ডাক ত রে।
    ব্রজ, কর্তার ছেলের নাম। একজন চাকরাণী ব্রজেশ্বরকে ডাকিয়া আনিল। ব্রজেশ্বরের বয়স একুশ বাইশ; অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ,
পিতার কাছে বিনীত ভাবে আসিয়া দাঁড়াইল–কথা কহিতে সাহস নাই।
    দেখিয়া হরবল্লভ বলিলেন, “বাপু, তোমার তিন সংসার মনে আছে?”
    ব্রজ চুপ করিয়া রহিল।
    “প্রথম বিবাহ মনে হয়–সে একটা বাগদীর মেয়ে?”
    ব্রজ নীরব–বাপের সাক্ষাতে বাইশ বছরের ছেলে হীরার ধার হইলেও সে কালে কথা কহিত না–এখন যত বড় মূর্খ ছেলে, তত বড় লম্বা স্পীচ্ ঝাড়ে।
    কর্তা কহিতে লাগিলেন, “সে বাগদী বেটী আজ এখানে এসেছে–জোর করে থাকবে, তা তোমার গর্ভধারিণীকে বললেম যে, ঝাঁটা মেরে তাড়াও। মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের গায়ে হাত কি দিতে পারে? এ তোমার কাজ। তোমারই অধিকার–আর কেহ স্পর্শ করিতে পারে না। তুমি আজ রাত্রে তাকে ঝাঁটা মেরে তাড়াইয়া দিবে। নহিলে আমার ঘুম হইবে না।”
    গিন্নী বলিলেন, “ছি! বাবা, মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুল না। ওঁর কথা রাখিতেই হইবে, আমার কথা কিছু চলবে না? তা যা কর, ভাল কথায় বিদায় করিও।”
    ব্রজ বাপের কথায় উত্তর দিল, “যে আজ্ঞা।” মার কথায় উত্তর দিল, “ভাল।”
    এই বলিয়া ব্রজেশ্বর একটু দাঁড়াইল। সেই অবকাশে গৃহিণী কর্তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি যে বৌকে তাড়াবে–বৌ খাবে কি করিয়া?”
    কর্তা বলিলেন, “যা খুসি করুক–চুরি করুক, ডাকাতি করুক–ভিক্ষা করুক।”
    গৃহিণী ব্রজেশ্বরকে বলিয়া দিলেন, “তাড়াইবার সময়ে বৌমাকে এই কথা বলিও। সে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল।”
    ব্রজেশ্বর পিতার নিকট হইতে বিদায় হইয়া ব্রহ্মঠাকুরাণীর নিকুঞ্জে গিয়া দর্শন দিলেন। দেখিলেন, ব্রহ্মঠাকুরাণী তদ্গতচিত্তে মালা জপ করিতেছেন, আর মশা তাড়াইতেছেন। ব্রজেশ্বর বলিলেন, “ঠাকুরমা!”
    ব্রহ্ম। কেন, ভাই?
    ব্রজ। আজ না কি নূতন খবর?
    ব্রহ্ম। কি নূতন? সাগর আমার চরকটা ভেঙ্গে দিয়েছে তাই? তা ছেলেমানুষ, দিয়েছে দিয়েছে। চরকা কাটতে তার সাধ গিয়েছিল–
    ব্রজ। তা নয় তা নয়–বলি আজ না কি–
    ব্রহ্ম। বুড়ো মানুষ, কবে আছি কবে নেই, দুটো পৈতে তুলে বামুনকে দিই বই ত নয়। তা যাক গে–
    ব্রজ। বলি আমার কথাটা শুনবে?
    ব্রহ্ম। কি বলছ? চরকার কথা নয়?
    ব্রজ। তা নয়–আমার দুইটি ব্রাহ্মণী আছে জান ত?
    ব্রহ্ম। ব্রাহ্মণী? মা মা মা! যেমন ব্রাহ্মণী নয়ান বৌ, তেমনি ব্রাহ্মণী সাগর বৌ–আমার হাড়টা খেলে–কেবল রূপকথা বল– রূপকথা বল– রূপকথা বল! ভাই, এত রূপকথা পাব কোথা?
    ব্রজ। রূপকথা থাক–
    ব্রহ্ম। তুমি যেন বললে থাক, তারা ছাড়ে কই? শেষে সেই বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর কথা বলিলাম। বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর কথা জান? বলি শোন। এক বনে বড় একটা শিমুলগাছে এক বিহঙ্গমা বিহঙ্গমী থাকে–
    ব্রজ। সর্বনাশ! ঠাকুরমা, কর কি? এখন রূপকথা! আমার কথা শোন।
    ব্রহ্ম। তোমার আবার কথা কি? আমি বলি, রূপকথা শুনিতেই এয়েছ–তোমাদের ত আর কাজ নাই?
    ব্রজেশ্বর মনে মনে ভাবিল, “কবে বুড়ীদের ৺ প্রাপ্তি হবে।” প্রকাশ্যে বলিল, “আমার দুইটি ব্রাহ্মণী–আর একটি বাগদিনী। বাগদিনীটি না কি আজ এয়েছে?”
    ব্রহ্ম। বালাই বালাই–বাগ্দিনী কেন? সে বামনের মেয়ে।
    ব্রজ। এয়েছে?
    ব্রহ্ম। হাঁ।
    ব্রজ। কোথায়? একবার দেখা হয় না?
    ব্রহ্ম। হাঁ। আমি দেখা করিয়ে দিয়ে তোমার বাপ-মার দু চক্ষের বিষ হই! তার চেয়ে বিহঙ্গমা বিহঙ্গমীর কথা শোন।
    ব্রজ। ভয় নাই–বাপ-মা আমাকে ডাকাইয়া বলিয়াছেন–তাকে তাড়াইয়া দাও। তা দেখা না পেলে, তাড়াইয়া দিব কি প্রকারে? তুমি ঠাকুরমা, তোমার কাছে সন্ধানের জন্য আসিয়াছি।
    ব্রহ্ম। ভাই, আমি বুড়ো মানুষ–কৃষ্ণনাম জপ করি, আর আলো চাল খাই। রূপকথা শোন তা বলতে পারি। বাগদীর কথাতেও নাই, বামনীর কথাতেও নাই।
    ব্রজ। হায়! বুড়ো বয়সে কবে তুমি ডাকাতের হাতে পড়িবে!
    ব্রহ্ম। অমন কথা বলিস নে–বড় ডাকাতের ভয়! কি, দেখা করবি?
    ব্রজ। তা নহিলে কি তোমার মালাজপা দেখতে এসেছি?
    ব্রহ্ম। সাগর বৌয়ের কাছে যা।
    ব্রজ। সতীনে কি সতীনকে দেখায়?
    ব্রহ্ম। তুই যা না। সাগর তোকে ডেকেছে, ঘরে গিয়ে বসে আছে। অমন মেয়ে আর হয় না।
    ব্রজ। চরকা ভেঙ্গেছে বলে? নয়ানকে বলে দেব–সে যেন একটা চরকা ভেঙ্গে দেয়।
    ব্রহ্ম। হাঁ–সাগরে, আর নয়ানে! যা যা!
    ব্রজ। গেলে বাগদিনী দেখতে পাব?
    ব্রহ্ম। বুড়ীর কথাটাই শোন্ না; কি জ্বালাতেই পড়লেম গা? আমার মালা জপা হলো না। তোর ঠাকুরদাদার তেষট্টিটা বিয়ে ছিল–কিন্তু চৌদ্দ বছরই হোক–আর চুয়াত্তর বছরই হোক –কই কেউ ডাকলে ত কখন ‘না’ বলিত না।
    ব্রজ। ঠাকুরদাদার অক্ষয় স্বর্গ হৌক–আমি চৌদ্দ বছরের সন্ধানে চলিলাম। ফিরিয়া আসিয়া চুয়াত্তর বছরের সন্ধান লইব কি?
    ব্রহ্ম। যা যা যা! আমার মালা জপা ঘুরে গেল। আমি নয়নতারাকে বলে দিব, তুই বড় চেঙ্গড়া হয়েছিস।
    ব্রজ। বলে দিও। খুসী হয়ে দুটো ছোলা ভাজা পাঠিয়ে দেবে।
    এই বলিয়া ব্রজেশ্বর সাগরের সন্ধানে প্রস্থান করিলেন।