প্রথম খণ্ড
সপ্তম পরিচ্ছেদ
প্রফুল্ল ও প্রফুল্লের মা
বাড়ী আসিল। প্রফুল্লের মার যাতায়াতে বড় শারীরিক কষ্ট
গিয়াছে–মানসিক কষ্ট ততোধিক। সকল সময় সব সয় না। ফিরিয়া আসিয়া
প্রফুল্লের মা জ্বরে পড়িল। প্রথমে জ্বর অল্প, কিন্তু বাঙ্গালীর
ঘরের মেয়ে, বামনের ঘরের মেয়ে–তাতে বিধবা, প্রফুল্লের মা জ্বরকে
জ্বর বলিয়া মানিল না। তারই উপর দুবেলা স্নান, জুটিলে আহার,
পূর্বমত চলিল। প্রতিবাসীরা দয়া করিয়া কখনও কিছু দিত, তাহাতে
আহার চলিত। ক্রমে জ্বর অতিশয় বৃদ্ধি পাইল–শেষে প্রফুল্লের মা
শয্যাগত হইল। সে কালে সেই সকল গ্রাম্য প্রদেশে চিকিৎসাপত্র বড়
ছিল না–বিধবারা প্রায়ই ঔষধ খাইত না –বিশেষ প্রফুল্লের এমন লোক
নাই যে, কবিরাজ ডাকে। কবিরাজও দেশে না থাকারই মধ্যে। জ্বর
বাড়িল–বিকার প্রাপ্ত হইল, শেষে প্রফুল্লের মা সকল দুঃখ হইতে
মুক্ত হইলেন।
পাড়ার পাঁচ জন, যাহারা
তাহার অমূলক কলঙ্ক রটাইয়াছিল, তাহারাই আসিয়া প্রফুল্লের মার
সৎকার করিল। বাঙ্গালীরা এ সময় শত্রুতা রাখে না। বাঙ্গালী জাতির
সে গুণ আছে।
প্রফুল্ল একা। পাড়ার
পাঁচ জন আসিয়া বলিল, “তোমাকে চতুর্থের শ্রাদ্ধ করিতে হইবে।”
প্রফুল্ল বলিল, “ইচ্ছা, পিণ্ডদান করি–কিন্তু কোথায় কি পাইব?”
পাড়ার পাঁচ জন বলিল, “তোমায় কিছু করিতে হইবে না–আমরা সব করিয়া
লইতেছি।” কেহ কিছু নগদ দিল, কেহ কিছু সামগ্রী দিল, এইরূপ করিয়া
শ্রাদ্ধ ও ব্রাহ্মণ-ভোজনের উদ্যোগ হইল। প্রতিবাসীরা আপনারাই
সকল উদ্যোগ করিয়া লইল।
একজন প্রতিবাসী বলিল,
“একটা কথা মনে হইতেছে। তোমার মার শ্রাদ্ধে তোমার শ্বশুরকে
নিমন্ত্রণ করা উচিত কি না?
প্রফুল্ল বলিল, “কে
নিমন্ত্রণ করিতে যাইবে?”
দুই জন পাড়ার মাতব্বর
লোক অগ্রসর হইল। সকল কাজে তাহারাই আগু হয়–তাদের সেই রোগ।
প্রফুল্ল বলিল, “তোমারাই আমাদের কলঙ্ক রটাইয়া সে ঘর ঘুচাইয়াছ।”
তাহারা বলিল, “সে কথা
আর মনে করিও না। আমরা সে কথা সারিয়া লইব। তুমি এখন অনাথা
বালিকা–তোমার সঙ্গে আর আমাদের কোন বিবাদ নাই।”
প্রফুল্ল সম্মত হইল।
দুই জন হরবল্লভকে নিমন্ত্রণ করিতে গেল। হরবল্লভ বলিলেন, “কি
ঠাকুর! তোমরাই বিহাইনকে জাতিভ্রষ্টা বলিয়া তাকে একঘরে
করেছিলে–আবার তোমাদেরই মুখে এই কথা?”
ব্রাহ্মণেরা বলিল, “সে
কি জানেন– অমন পাড়াপড়শীতে গোলযোগ হয়–সেটা কোন কাজের কথা নয়।”
হরবল্লভ বিষয়ী
লোক–ভাবিলেন, “এ সব জুয়াচুরি। এ বেটারা বাগদী বেটীর কাছে টাকা
খাইয়াছে। ভাল, বাগদী বেটী টাকা পাইল কোথা?” অতএব হরবল্লভ
নিমন্ত্রণের কথায় কর্ণপাতও করিলেন না। তাঁহার মন প্রফুল্লের
প্রতি বরং আরও নিষ্ঠুর ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল।
ব্রজেশ্বর এ সকল শুনিল।
মনে করিল, “এক দিন রাত্রে লুকাইয়া গিয়া প্রফুল্লকে দেখিয়া
আসিব। সেই রাত্রেই ফিরিব।”
প্রতিবাসীরা নিষ্ফল
হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। প্রফুল্ল যথারীতি মাতৃশ্রাদ্ধ করিয়া
প্রতিবাসীদিগের সাহায্যে ব্রাহ্মণ-ভোজন সম্পন্ন করিল।
ব্রজেশ্বর যাইবার সময় খুঁজিতে লাগিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ফুলমণি
নাপিতানীর বাস প্রফুল্লের বাসের নিকট। মাতৃহীন হইয়া অবধি প্রফুল্ল একা গৃহে বাস
করে। প্রফুল্ল সুন্দরী, যুবতী, রাত্রে একা বাস করে, তাহাতে ভয়ও আছে, কলঙ্ক আছে।
কাছে শুইবার জন্য রাত্রে একজন স্ত্রীলোক চাই। ফুলমণিকে এ জন্য প্রফুল্ল অনুরোধ
করিয়াছিল। ফুলমণি বিধবা; তার এক বিধবা ভগিনী ভিন্ন কেহ নাই। আর তারা দুই বোনেই
প্রফুল্লের মার অনুগত ছিল। এই জন্য প্রফুল্ল ফুলমণিকে অনুরোধ করে, আর ফুলমণিও
সহজে স্বীকার করে। অতএব যে দিন প্রফুল্লের মা মরিয়াছিল, সেই দিন অবধি
প্রফুল্লের বাড়ীতে ফুলমণি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আসিয়া শোয়।
তবে ফুলমণি কি চরিত্রের লোক, তাহা ছেলেমানুষ প্রফুল্ল সবিশেষ
জানিত না। ফুলমণি প্রফুল্লের অপেক্ষা বয়স দশ বছরের বড়। দেখিতে শুনিতে মন্দ নয়,
বেশ-ভূষায় একটু পারিপাট্য রাখিত। একে ইতর জাতির মেয়ে, তাতে বালবিধবা; চরিত্রটা
বড় খাঁটি রাখিতে পারে নাই। গ্রামের জমিদার পরাণ চৌধুরী। তাঁহার একজন গোমস্তা
দুর্লভ চক্রবর্তী ঐ গ্রামে আসিয়া মধ্যে মধ্যে কাছারি করিত। লোকে বলিত, ফুলমণি
দুর্লভের বিশেষ অনুগৃহীতা–অথবা দুর্লভ তাহার অনুগৃহীত। এ সকল কথা প্রফুল্ল
একেবারে যে কখনও শুনে নাই–তা নয়, কিন্তু কি করে–আর কেহ আপনার ঘর দ্বার ফেলিয়া
প্রফুল্লের কাছে শুইতে চাহে না। বিশেষ প্রফুল্ল মনে করিল, “সে মন্দ হোক, আমি না
মন্দ হইলে আমায় কে মন্দ করিবে?”
অতএব ফুলমণি দুই চারি দিন আসিয়া প্রফুল্লের ঘরে শুইল। শ্রাদ্ধের
পরদিন ফুলমণি একটু দেরি করিয়া আসিতেছিল। পথে একটা আমগাছের তলায়, একটা বন আছে,
আসিবার সময় ফুলমণি সেই বনে প্রবেশ করিল। সে বনের ভিতর একজন পুরুষ দাঁড়াইয়াছিল।
বলা বাহুল্য যে, সে সেই দুর্লভচন্দ্র।
চক্রবর্তী মহাশয় কৃতাভিসারা, তাম্বুলরাগরক্তাধরা, রাঙ্গাপেড়ে,
সাড়ীপরা, হাসিতে মুখভরা ফুলমণিকে দেখিয়া বলিলেন, “কেমন, আজ?”
ফুলমণি বলিলেন, “হাঁ, আজই বেশ। তুমি রাত্রি দুপুরের সময় পাল্কী
নিয়ে এসো–দুয়ারে টোকা মেরো। আমি দুয়ার খুলিয়া দিব। কিন্তু দেখো, গোল না হয়।”
দু। তার ভয় নাই। কিন্তু সে ত গোল করবে না?
ফু। তার একটা ব্যবস্থা করবে হবে। আমি আস্তে আস্তে দোরটি খুলবে
তুমি আস্তে, আস্তে, সে ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে তার মুখটি কাপড় দিয়া চাপিয়া বাঁধিয়া
ফেলিবে। তার পর চেঁচায় কার বাপের সাধ্য!
দু। তা, এমন জোর করে নিয়ে গেলে কয় দিন থাকিবে?
ফু। একবার নিয়ে যেতে পারলেই হলো। যার তিন কুলে কেউ নাই, যে
অন্নের কাঙ্গাল, সে খেতে পাবে, কাপড় পাবে, গয়না পাবে, টাকা পাবে, সোহাগ পাবে–সে
আবার থাকবেত না? সে ভার আমার–আমি যেন গয়না টাকার ভাগ পাই।
এইরূপ কথাবার্তা সমাপ্ত হইলে, দুর্লভ স্বস্থানে গেল–ফুলমণি
প্রফুল্লের কাছে গেল। প্রফুল্ল এ সর্বনাশের কথা কিছুই জানিতে পারে নাই। সে মার
কথা ভাবিতে ভাবিতে শয়ন করিল। মার জন্য যেমন কাঁদে, তেমন কাঁদিল; কাঁদিয়া যেমন
রোজ ঘুমায়, তেমনি ঘুমাইল। দুই প্রহরে দুর্লভ আসিয়া দ্বারে টোকা মারিল। ফুলমণি
দ্বার খুলিল। দুর্লভ প্রফুল্লের মুখ বাঁধিয়া ধরাধরি করিয়া পাল্কীতে তুলিল।
বাহকেরা নিঃশব্দে তাহাকে পরাণবাবু জমিদারের বিহার-মন্দিরে লইয়া চলিল। বলা
বাহুল্য, ফুলমণি সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
ইহার অর্দ্ধ দণ্ড পরে ব্রজেশ্বর সেই শূন্য গৃহে প্রফুল্লের
সন্ধানে আসিয়া উপস্থিত হইল। ব্রজেশ্বর সকলকে লুকাইয়া রাত্রে পলাইয়া আসিয়াছে।
কোথাও কেহ নাই। প্রফুল্লকে লইয়া বাহকেরা নিঃশব্দে চলিল বলিয়াছি; কেহ মনে না
করেন–এটা ভ্রম-প্রমাদ! বাহকের প্রকৃতি শব্দ করা। কিন্তু এবার শব্দ করার পক্ষে
তাহাদের প্রতি নিষেধ ছিল। শব্দ করিলে গোলযোগ হইবে; তা ছাড়া আর একটা কথা ছিল।
ব্রহ্মঠাকুরাণীর মুখে শুনা গিয়াছে, বড় ডাকাতের ভয়। বাস্তবিক এরূপ ভয়ানক
দস্যুভীতি কখনও কোন দেশে হইয়াছিল কি না সন্দেহ। তখন দেশ অরাজক। মুসলমানের রাজ্য
গিয়াছে; ইংরেজের রাজ্য ভাল করিয়া পত্তন হয় নাই–হইতেছে মাত্র। তাতে আবার বছর কত
হইল, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেশ ছারখার করিয়া গিয়াছে। তার পর আবার দেবী সিংহের
ইজারা। পৃথিবীর ও পারে ওয়েষ্ট্ মিনষ্টর হলে দাঁড়াইয়া এদ্ম ন্দ্ বর্ক সেই দেবী
সিংহকে অমর করিয়া গিয়াছেন। পর্বতোদ্গীর্ণ অগ্নিশিখাবৎ জ্বালাময় বাক্যস্রোতে
বর্ক দেবী সিংহের দুর্বিষহ অত্যাচার অনন্তকালসমীপে পাঠাইয়াছেন। তাঁহার নিজমুখে
সে দৈববাণীতুল্য বাক্যপরম্পরা শুনিয়া শোকে অনেক স্ত্রীলোক মূর্ছিত হইয়া
পড়িয়াছিল–আজিও শত বৎসর পরে সেই বক্তৃতা পড়িতে গেলে শরীর লোমাঞ্চিত এবং হৃদয়
উন্মত্ত হয়। সেই ভয়ানক অত্যাচার বরেন্দ্র-ভূমি ডুবাইয়া দিয়াছিল। অনেকেই কেবল
খাইতে পায় না নয়, গৃহে পর্যন্ত বাস করিতে পায় না। যাহাদের খাইবার নাই, তাহারা
পরের কাড়িয়া খায়। কাজেই এখন গ্রামে গ্রামে দলে দলে চোর ডাকাত। কাহার সাধ্য শাসন
করে? গুড্ল্যা ড সাহেব রঙ্গপুরের প্রথম কালেক্টর। ফৌজদারী তাঁহারই জিম্মা। তিনি
দলে দলে সিপাহী ডাকাত ধরিতে পাঠাইতে লাগিলেন। সিপাহীরা কিছুই করিতে পারিল না।
অতএব দুর্লভের ভয়, তিনি ডাকাতি করিয়া প্রফুল্লকে লইয়া যাইতেছেন,
আবার তার উপর ডাকাতে না ডাকাতি করে। পাল্কী দেখিয়া ডাকাতের আসা সম্ভব। সেই ভয়ে
বেহারারা নিঃশব্দ। গোলমাল হইবে বলিয়া সঙ্গে অপর লোকজনও নাই, কেবল দুর্লভ নিজে
আর ফুলমণি। এইরূপে তাহারা ভয়ে ভয়ে চারি ক্রোশ ছাড়াইল।
তার পর ভারি জঙ্গল আরম্ভ হইল। বেহারারা সভয়ে দেখিল, দুই জন
মানুষ সম্মুখে আসিতেছে। রাত্রিকাল–কেবল নক্ষত্রালোকে পথ দেখা যাইতেছে। সুতরাং
তাহাদের অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। বেহারারা দেখিল, যেন কালান্তর যমের মত দুই
মূর্ত্তি আসিতেছে। একজন বেহারা অপরদিগকে বলিল, “মানুষ দুটোকে সন্দেহ হয়!” অপর
আর একজন বলিল, “রাত্রে যখন বেড়াচ্চে, তখন কি আর ভাল মানুষ?”
তৃতীয় বাহক বলিল, “মানুষ দুটো ভারি জোয়ান।”
৪র্থ। হাতে লাঠি দেখ্ছি না?
১ম। চক্রবর্ত্তী মহাশয় কি বলেন? আর তো এগোনো যায় না–ডাকাতের
হাতে প্রাণটা যাবে।
চক্রবর্তী মহাশয় বলিলেন, “তাই ত বড় বিপদ্ দেখি যে! যা
ভেবেছিলেম, তাই হলো!”
এমন সময়ে, যে দুই ব্যক্তি আসিতেছিল, তাহারা পথে লোক দেখিয়া
হাঁকিল, “কোন্ হ্যায় রে?”
বেহারারা অমনি পাল্কী মাটিতে ফলিয়া দিয়া “বাবা গো” শব্দ করিয়া
একেবারে জঙ্গলের ভিতর পলাইল। দেখিয়া দুর্লভ চক্রবর্তী মহাশয়ও সেই পথাবলম্বী
হইলেন। তখন ফুলমণি “আমায় ফেলে কোথা যাও?” বলিয়া তাঁর পাছু পাছু ছুটিল।
যে দুই জন আসিতেছিল–যাহারা এই দশ জন মনুষ্যের ভয়ের কারণ–তাহারা
পথিক মাত্র। দুই জন হিন্দুস্থানী দিনাজপুরের রাজসরকারে চাকরির চেষ্টায় যাইতেছে।
রাত্রিপ্রভাত নিকট দেখিয়া সকালে সকালে পথ চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। বেহারারা পলাইল
দেখিয়া তাহারা একবার খুব হাসিল। তাহার পর আপনাদের গন্তব্য পথে চলিয়া গেল।
কিন্তু বেহারারা, আর ফুলমণি ও চক্রবর্তী মহাশয় আর পাছু ফিরিয়া চাহিল না।
প্রফুল্ল পাল্কীতে উঠিয়াই মুখের বাঁধন স্বহস্তে খুলিয়া
ফেলিয়াছিল। রাত্রি দুই প্রহরে চীৎকার করিয়া কি হইবে বলিয়া চীৎকার করে নাই;
চীৎকার শুনিতে পাইলেই বা কে ডাকাতের সম্মুখে আসিবে! প্রথমে ভয়ে প্রফুল্ল কিছু
আত্মবিস্মৃত হইয়াছিল, কিন্তু এখন প্রফুল্ল স্পষ্ট বুঝিল যে, সাহস না করিলে
মুক্তির কোন উপায় নাই। যখন বেহারারা পাল্কী ফেলিয়া পলাইল, তখন প্রফুল্ল
বুঝিল–আর একটা কি নূতন বিপদ্। ধীরে ধীরে পাল্কীর কপাট খুলিল। অল্প মুখ বাড়াইয়া
দেখিল, দুই জন মনুষ্য আসিতেছে। তখন প্রফুল্ল ধীরে ধীরে কপাট বন্ধ করিল; যে অল্প
ফাঁক রহিল, তাহা দিয়া প্রফুল্ল দেখিল, মনুষ্য দুই জন চলিয়া গেল। তখন প্রফুল্ল
পাল্কী হইতে বাহির হইল–দেখিল, কেহ কোথাও নাই।
প্রফুল্ল ভাবিল, যাহারা আমাকে চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছিল, তাহারা
অবশ্য ফিরিবে। অতএব যদি পথ ধরিয়া যাই, তবে ধরা পড়িতে পারি। তার চেয়ে এখন
জঙ্গলের ভিতর লুকাইয়া থাকি। তার পর, দিন হইলে যা হয় করিব।
এই ভাবিয়া প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল। ভাগ্যক্রমে যে
দিকে বেহারারা পলাইয়াছিল, সে দিকে যায় নাই। সুতরাং কাহারও সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ
হইল না। প্রফুল্ল জঙ্গলের ভিতর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অল্পক্ষণ পরেই প্রভাত
হইল। প্রভাত হইলে প্রফুল্ল বনের ভিতর এদিক ওদিক বেড়াইতে লাগিল। পথে বাহির হইতে
এখনও সাহস হয় না। দেখিল, এক জায়গায় একটা পথের অস্পষ্ট রেখা বনের ভিতরের দিকে
গিয়াছে। যখন পথের রেখা এদিকে গিয়াছে, তখন অবশ্য এদিকে মানুষের বাস আছে।
প্রফুল্ল সেই পথে চলিল। বাড়ী ফিরিয়া যাইতে ভয়, পাছে বাড়ী হইতে আবার তাকে
ডাকাইতে ধরিয়া আনে। বাঘ-ভালুকে খায়, সেও ভাল, আর ডাকাইতের হাতে না পড়িতে হয়।
পথের রেখা ধরিয়া প্রফুল্ল অনেক দূর গেল–বেলা দশ দণ্ড হইল, তবু
গ্রাম পাইল না। শেষে পথের রেখা বিলুপ্ত হইল–আর পথ পায় না। কিন্তু দুই একখানা
পুরাতন ইট দেখিতে পাইল। ভরসা পাইল। মনে করিল, যদি ইট আছে, তবে অবশ্য নিকটে
মনুষ্যালয় আছে।
যাইতে যাইতে ইটের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল। জঙ্গল দুর্ভেদ্য হইয়া
উঠিল। শেষে প্রফুল্ল দেখিল নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে এক বৃহৎ অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ
রহিয়াছে। প্রফুল্ল ইষ্টকস্তূপের উপর আরোহণ করিয়া চারি দিক নিরীক্ষণ করিল।
দেখিল, এখনও দুই চারিটা ঘর অভগ্ন আছে। মনে করিল, এখানে মানুষ থাকিলেও থাকিতে
পারে। প্রফুল্ল সেই সকল ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে লাগিল। দেখিল, সকল ঘরের দ্বার
খোলা–মনুষ্য নাই। অথচ মনুষ্য-বাসের চিহ্নও কিছু কিছু আছে। ক্ষণপরে প্রফুল্ল কোন
বুড়া মানুষের কাতরানি শুনিতে পাইল। শব্দ লক্ষ্য করিয়া প্রফুল্ল এক কুঠরীমধ্যে
প্রবেশ করিল। দেখিল, সেখানে এক বুড়া শুইয়া কাতরাইতেছে। বুড়ার শীর্ণ দেহ, শুষ্ক
ওষ্ঠ, চক্ষু কোটরগত, ঘন শ্বাস। প্রফুল্ল বুঝিল, ইহার মৃত্যু নিকট। প্রফুল্ল
তাহার শয্যার কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
বুড়া প্রায় শুষ্ককণ্ঠে বলিল, “মা, তুমি কে? তুমি কি কোন দেবতা,
মৃত্যুকালে আমার উদ্ধারের জন্য আসিলে?”
প্রফুল্ল বলিল, “আমি অনাথা। পথ ভুলিয়া এখানে আসিয়াছি। তুমিও
দেখিতেছি অনাথ–তোমার কোন উপকার করিতে পারি?”
বুড়া বলিল, “অনেক উপকার এ সময়ে করিতে পার। জয় নন্দদুলাল! এ সময়ে
মনুষ্যের মুখ দেখিতে পাইলাম। পিপাসায় প্রাণ যায়–একটু জল দাও।”
প্রফুল্ল দেখিল, বুড়ার ঘরে জল-কলসী আছে, কলসীতে জল আছে, জলপাত্র
আছে; কেবল দিবার লোক নাই। প্রফুল্ল জল আনিয়া বুড়াকে খাওয়াইল।
বুড়া জল পান করিয়া কিছু সুস্থির হইল। প্রফুল্ল এই অরণ্যমধ্যে
মুমূর্ষু বৃদ্ধকে একাকী এই অবস্থায় দেখিয়া বড় কৌতূহলী হইল। কিন্তু বুড়া তখন
অধিক কথা কহিতে পারে না। প্রফুল্ল সুতরাং তাহার সবিশেষ পরিচয় পাইল না। বুড়া
কয়টি কথা বলিল, তাহার মর্ম্মার্থ এই;‒
বুড়া বৈষ্ণব। তাহার কেহ
নাই, কেবল এক বৈষ্ণবী ছিল। বৈষ্ণবী বুড়াকে মুমূর্ষু দেখিয়া তাহার দ্রব্যসামগ্রী
যাহা ছিল, তাহা লইয়া পলাইয়াছে। বুড়া বৈষ্ণব–তাহার দাহ হইবে না। বুড়ার কবর হয়–এই
ইচ্ছা। বুড়ার কথামত, বৈষ্ণবী বাড়ীর উঠানে তাহার একটি কবর কাটিয়া রাখিয়া গিয়াছে।
হয়ত শাবল কোদালি সেইখানে পড়িয়া আছে। বুড়া এখন প্রফুল্লের কাছে এই ভিক্ষা চাহিল
যে, “আমি মরিলে সেই কবরে আমাকে টানিয়া ফেলিয়া দিয়া মাটি চাপা দিও।”
প্রফুল্ল স্বীকৃত হইল। তার পর বুড়া বলিতে লাগিল, “আমার কিছু
টাকা পোঁতা আছে। বৈষ্ণবী সে সন্ধান জানিত না–তাহা হইলে, না লইয়া পলাইত না। সে
টাকাগুলি কাহাকে না দিয়া গেলে আমার প্রাণ বাহির হইবে না। যদি কাহাকে না দিয়া
মরি, তবে যক্ষ হইয়া টাকার কাছে ঘুরিয়া বেড়াইব–আমার গতি হইবে না। বৈষ্ণবীকে সেই
টাকা দিব মনে করিয়াছিলাম কিন্তু সে ত পলাইয়াছে। আর কোন্ মনুষ্যের সাক্ষাৎ পাইব?
তাই তোমাকেই সেই টাকাগুলি দিয়া যাইতেছি। আমার বিছানার নীচে একখানা চৌকা তক্তা
পাতা আছে। সেই তক্তাখানি তুলিবে। একটা সুরঙ্গ দেখিতে পাইবে। বরাবর সিঁড়ি আছে।
সেই সিঁড়ি দিয়া নামিবে–ভয় নাই–আলো লইয়া যাইবে। নীচে মাটির ভিতর এমনি একটা ঘর
দেখিবে। সে ঘরের বায়ুকোণে খুঁজিও–টাকা পাইবে।”
প্রফুল্ল বুড়ার শুশ্রূষায় নিযুক্তা হইল। বুড়া বলিল, “এই বাড়ীতে
গোহাল আছে–গোহালে গরু আছে। গোহাল হইতে যদি দুধ দুইয়া আনিতে পার, তবে একটু আনিয়া
আমাকে দাও, একটু আপনি খাও।”
প্রফুল্ল তাহাই করিল–দুধ আনিবার সময় দেখিয়া আসিল–কবর
কাটা–সেখানে কোদালি শাবল পড়িয়া আছে।
অপরাহ্নে বুড়ার প্রাণবিয়োগ হইল। প্রফুল্ল তাহাকে তুলিল–বুড়া
শীর্ণকায়; সুতরাং লঘু; প্রফুল্লের বল যথেষ্ট! প্রফুল্ল তাহাকে লইয়া গিয়া, কবরে
শুয়াইয়া মাটি চাপা দিল। পরে নিকটস্থ কূপে স্নান করিয়া ভিজা কাপড় আধখানা পরিয়া
রৌদ্রে শুকাইল। তার পরে কোদালি শাবল লইয়া বুড়ার টাকার সন্ধানে চলিল। বুড়া
তাহাকে টাকা দিয়া গিয়াছে–সুতরাং লইতে কোন বাধা আছে মনে করিল না। প্রফুল্ল
দীন-দুঃখিনী।