দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ
পাঁচে
পাঁচে দশ বৎসর অতীত হইয়া গেল। যে দিন প্রফুল্লকে বাগদীর মেয়ে বলিয়া হরবল্লভ
তাড়াইয়া দিয়াছিলেন, সে দিন হইতে দশ বৎসর হইয়া গিয়াছে। এই দশ বৎসর হরবল্লভ রায়ের
পক্ষে বড় ভাল গেল না। দেশের দুর্দ্দশার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ইজারাদার দেবী
সিংহের অত্যাচার, তার উপরে ডাকাইতের অত্যাচার। একবার হরবল্লভের তালুক হইতে টাকা
চালান আসিতেছিল, ডাকাইতে তাহা লুঠিয়া লইল। সে বার দেবী সিংহের খাজনা দেওয়া হইল
না। দেবী সিংহ একখানা তালুক বেচিয়া লইল। দেবী সিংহের বেচিয়া লওয়ার প্রথা মন্দ
ছিল না। হেষ্টিংস সাহেব ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের কৃপায় সকল সরকারী কর্মচারী দেবী
সিংহের আজ্ঞাবহ; বেচা কেনা সম্বন্ধে সে যাহা মনে করিত, তাহাই করিত। হরবল্লভের
দশ হাজার টাকার মূল্যের তালুকখানা আড়াই শত টাকায় দেবী সিংহ নিজে কিনিয়া লইলেন।
তাহাতে বাকী খাজানা কিছুই পরিশোধ হইল না, দেনার জের চলিল। দেবী সিংহের
পীড়াপীড়িতে, কয়েদের আশঙ্কায়, হরবল্লভ আর একটা সম্পত্তি বন্ধক দিয়া ঋণ পরিশোধ
করিলেন। এই সকল কারণে আয় বড় কমিয়া আসিল। কিন্তু ব্যয় কিছুই কমিল না–বুনিয়াদি
চাল খাটো করা যায় না। সকল লোকেরই প্রায় এমন না এমন এক দিন উপস্থিত হয়, যখন
লক্ষ্মী আসিয়া বলেন, “হয় সাবেক চাল ছাড়, নয় আমায় ছাড়।” অনেকেই উত্তর দেন, “মা!
তোমায় ছাড়িলাম, চাল ছাড়িতে পারি না।” হরবল্লভ তাহারই একজন। দোল-দুর্গোৎসব,
ক্রিয়া-কর্ম, দান-ধ্যান, লাঠালাঠি পূর্বমতই হইতে লাগিল–বরং ডাকাইতে চালান
লুঠিয়া লওয়া অবধি লাঠিয়ালের খরচটা কিছু বাড়িয়াছিল। খরচ আর কুলায় না। কিস্তি
কিস্তি সরকারী খাজানা বাকি পড়িতে লাগিল। বিষয় আশয় যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাহাও
বিক্রয় হইয়া যায়, আর থাকে না। দেনার উপর দেনা হইল, সুদে আসল ছাপাইয়া উঠিল–টাকা
আর ধার পাওয়া যায় না।
এদিকে দেবী সিংহের পাওনা প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা বাকি পড়িল।
হরবল্লভ কিছুতেই টাকা দিতে পারেন না–শেষ হরবল্লভ রায়কে গ্রেপ্তার করিবার জন্য
পরওয়ানা বাহির হইল। তখনকার গ্রেপ্তারি পরওয়ানার জন্য বড় আইন-কানুন খুঁজিতে হইত
না, তখন ইংরেজের আইন হয় নাই। সব তখন বে-আইন।
বড়
ধুম পড়িয়াছে। ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী আসিয়াছেন। কোন্ শ্বশুরবাড়ী,
তাহা বলা বাহুল্য। সাগরের বাপের বাড়ী। তখনকার দিনে একটা জামাই
আসা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। তাতে আবার ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী
সচরাচর আসে না। পুকুরে পুকুরে, মাছমহলে ভারি হুটাহুটি,
ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। জেলের দৌরাত্ম্যে প্রাণ আর রক্ষা হয় না।
জেলে-মাগীদের হাঁটাহাঁটিতে পুকুরের জল কালী হইয়া যাইতে লাগিল।
মাছ চুরির আশায় ছেলেরা পাঠশালা ছাড়িয়া দিল। দই, দুধ, ননী,
ছানা, সর, মাখনের ফরমাইসের জ্বালায় গোয়ালার মাথা বেঠিক হইয়া
উঠিল; সে কখনও এক সের জল মিশাইতে তিন সের মিশাইয়া ফেলে, তিন
সের মিশাইতে এক সের মিশাইয়া বসে। কাপড়ের ব্যাপারীর কাপড়ের মোট
লইয়া যাতায়াত করিতে করিতে পায় ব্যথা হইয়া গেল; কাহারও পছন্দ হয়
না, কোন্ ধুতি চাদর কে জামাইকে দিবে। পাড়ার মেয়েমহলে বড়
হাঙ্গামা পড়িল। যাহার যাহার গহনা আছে, তারা সে সকল সারাইতে,
মাজিতে, ঘষিতে, নূতন করিয়া গাঁথাইতে লাগিল। যাহাদের গহনা নাই,
তাহারা চুড়ি কিনিয়া, শাঁখা কিনিয়া, সোণা-রূপা চাহিয়া চিন্তিয়া
এক রকম বেশভূষার যোগাড় করিয়া রাখিল–নহিলে জামাই দেখিতে যাওয়া
হয় না। যাঁহাদের রসিকতার জন্য পসার আছে–তাঁহারা দুই চারিটা
প্রাচীন তামাশা মনে মনে ঝালাইয়া রাখিলেন; যাহাদের পসার নাই,
তাহারা চোরাই মাল পাচার করিবার চেষ্টায় রহিল। কথার তামাশা পরে
হবে–খাবার তামাশা আগে। তাহার জন্য ঘরে ঘরে কমিটি বসিয়া গেল।
বহুতর কৃত্রিম আহার্য, পানীয়, ফল-মূল প্রস্তুত হইতে লাগিল।
মধুর অধরগুলি মধুর হাসিতে ও সাধের মিশিতে ভরিয়া যাইতে লাগিল।
কিন্তু যার জন্য এত উদ্যোগ, তার মনে সুখ নাই। ব্রজেশ্বর
আমোদ-আহ্লাদের জন্য শ্বশুরালয়ে আসেন নাই। বাপের গ্রেপ্তারির
জন্য পরওয়ানা বাহির হইয়াছে–রক্ষার উপায় নাই। কেহ টাকা ধার দেয়
না। শ্বশুরের টাকা আছে–শ্বশুর ধার দিলে দিতে পারে, তাই
ব্রজেশ্বর শ্বশুরের কাছে আসিয়াছেন।
শ্বশুর বলিলেন, “বাপু হে, আমার যে টাকা, সে তোমারই জন্য
আছে–আমার আর কে আছে, বল? কিন্তু টাকাগুলি যত দিন আমার হাতে
আছে, তত দিন আছে,‒তোমার
বাপকে দিলে কি আর থাক্বে? মহাজনে খাইবে। অতএব কেন আপনার ধন
আপনি নষ্ট করিতে চাও?”
ব্রজেশ্বর বলিল, “হৌক–আমি ধনের প্রত্যাশী নই–আমার বাপকে বাঁচান
আমার প্রথম কাজ।”
শ্বশুর রুক্ষভাবে বলিলেন, “তোমার বাপ বাঁচিলে আমার মেয়ের কি?
আমার মেয়ের টাকা থাকিলে দুঃখ ঘুচিবে–শ্বশুর বাঁচিলে দুঃখ
ঘুচিবে না।”
কড়া কথায় ব্রজেশ্বরের বড় রাগ হইল। ব্রজেশ্বর বলিলেন, “তবে আপনার
মেয়ে টাকা লইয়া থাকুক। বুঝিয়াছি, জামাইয়ে আপনার কোন প্রয়োজন
নাই। আমি জন্মের মত বিদায় হইলাম।”
তখন সাগরের পিতা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া ব্রজেশ্বরকে বিস্তর
তিরস্কার করিলেন। ব্রজেশ্বর কড়া কড়া উত্তর দিল। কাজেই
ব্রজেশ্বর তল্পিতল্পা বাঁধিতে লাগিল। শুনিয়া, সাগরের মাথায়
বজ্রাঘাত হইল।
সাগরের মা জামাইকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। জামাইকে অনেক বুঝাইলেন।
জামাইয়ের রাগ পড়িল না। তার পর সাগরের পালা।
বধূ শ্বশুরবাড়ী আসিলে দিবসে স্বামীর সাক্ষাৎ পাওয়া সেকালে যতটা
দুরূহ ছিল, পিত্রালয়ে ততটা নয়। সাগরের সঙ্গে নিভৃতে
ব্রজেশ্বরের সাক্ষাৎ হইল। সাগর ব্রজেশ্বরের পায় পড়িল, বলিল,
“আর এক দিন থাক–আমি ত কোন অপরাধ করি নাই?”
ব্রজেশ্বরের তখন বড় রাগ ছিল–রাগে পা টানিয়া লইলেন। রাগের সময়
শারীরিক ক্রিয়া সকল বড় জোরে জোরে হয়, আর হাত-পায়ের গতিও ঠিক
অভিমতরূপ হয় না। একটা করিতে বিকৃতি জন্য আর একটা হইয়া পড়ে। সেই
কারণে, আর কতকটা সাগরের ব্যস্ততার কারণ, পা সরাইয়া লইতে প্রমাদ
ঘটিল। পা একটু জোরে সাগরের গায়ে লাগিল। সাগর মনে করিল, স্বামী
রাগ করিয়া আমাকে লাথি মারিলেন। সাগর স্বামীর পা ছাড়িয়া দিয়া
কুপিত ফণিনীর ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিল। বলিল, “কি? আমায় লাথি
মারিলে?”
বাস্তবিক ব্রজেশ্বরের লাথি মারিবার ইচ্ছা ছিল না, –তাই বলিলেই
মিটিয়া যাইত। কিন্তু একে রাগের সময়, আবার সাগর চোখ-মুখ ঘুরাইয়া
দাঁড়াইল, –ব্রজেশ্বরের রাগ বাড়িয়া গেল। বলিলেন, “যদি মারিয়াই
থাকি? তুমি না হয় বড়মানুষের মেয়ে, কিন্তু পা আমার–তোমার
বড়মানুষ বাপও এ পা একদিন পূজা করিয়াছিলেন।”
সাগর রাগে জ্ঞান হারাইল। বলিল, “ঝক্মারি করিয়াছিলেন। আমি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব।”
ব্র। পালটে লাথি মারবে না কি?
সা। আমি তত অধম নহি। কিন্তু আমি যদি ব্রাহ্মণের মেয়ে হই, তবে
তুমি আমার পা–সাগরের কথা ফুরাইতে না ফুরাইতে পিছনের জানালা
হইতে কে বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”
সাগরের মুখে সেই রকম কি কথা আসিতেছিল। সাগর না ভাবিয়া চিন্তিয়া,
পিছন ফিরিয়া না দেখিয়া রাগের মাথায় সেই কথাই বলিল, “আমার পা
কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”
ব্রজেশ্বরও রাগে সপ্তমে চড়িয়া কোন দিকে না চাহিয়া বলিল, “আমারও
সেই কথা। যত দিন আমি তোমার পা টিপিয়া দিই, তত দিন আমিও তোমার
মুখ দেখিব না। যদি আমার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, তবে আমি
অব্রাহ্মণ।”
তখন রাগে রাগে তিনটা হইয়া ফুলিয়া ব্রজেশ্বর চলিয়া গেল। সাগর পা
ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। এমন সময়ে সাগর যে ঘরে বসিয়া কাঁদিতেছিল,
সেই ঘরে একজন পরিচারিকা, ব্রজেশ্বর গেলে পর সাগরের কি অবস্থা
হইয়াছে, ইহা দেখিবার অভিপ্রায়ে ভিতরে প্রবেশ করিল, ছুতানাতা
করিয়া দুই একটা কাজ করিতে লাগিল। তখন সাগরের মনে পড়িল যে,
জানালা হইতে কে কথা কহিয়াছিল। সাগর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই
জানেলা হইতে কথা কহিয়াছিলি”
সে বলিল, “কই না?”
সাগর বলিল, “তবে কে জানেলায় দেখ্ ত।”
তখন সাক্ষাৎ ভগবতীর মত রূপবতী ও তেজস্বিনী একজন স্ত্রীলোক ঘরের
ভিতর প্রবেশ করিল। সে বলিল, “জানালায় আমি ছিলাম।”
সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে গা?”
তখন সে স্ত্রীলোক বলিল, “তোমরা কি কেউ আমায় চেন না?”
সাগর বলিল, “না–কে তুমি?” তখন সেই স্ত্রীলোক উত্তর করিল, “আমি
দেবী চৌধুরাণী।”
পরিচারিকার হাতে পানের বাটা ছিল, ঝন্ ঝন্ করিয়া পড়িয়া গেল। সেও
কাঁপিতে কাঁপিতে আঁ–আঁ–আঁ–আঁ শব্দ করিতে করিতে বসিয়া পড়িল।
কাঁকালের কাপড় খসিয়া পড়িল।
দেবী চৌধুরাণী তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, “চুপ রহো, হারামজাদি!
খাড়া রহো।”
পরিচারিকা কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিয়া স্তম্ভিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া
রহিল। সাগরেরও গায়ে ঘাম দিতেছিল। সাগরের মুখেও কথা ফুটিল না।
যে নাম তাহাদের কাণে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা ছেলে বুড়ো কে না
শুনিয়াছিল? সে নাম অতি ভয়ানক।
কিন্তু সাগর আবার ক্ষণেক পরে হাসিয়া উঠিল। তখন দেবী চৌধুরাণীও
হাসিল।