বঙ্কিম-রচনাবলী

দেবী চৌধুরাণী
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

দ্বিতীয় খণ্ড
একাদশ পরিচ্ছেদ



দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

    যথাকালে পিতৃসমীপে উপস্থিত হইয়া ব্রজেশ্বর তাঁর পদবন্দনা করিলেন।
    হরবল্লভ অন্যান্য কথার পর জিজ্ঞাসা করিলেন, “আসল সংবাদ কি? টাকার কি হইয়াছে?”
    ব্রজেশ্বর বলিলেন যে, “তাঁহার শ্বশুর টাকা দিতে পারেন নাই।” হরবল্লভের মাথায় বজ্রাঘাত হইল–হরবল্লভ চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে টাকা পাও নাই?”
    “আমার শ্বশুর টাকা দিতে পারেন নাই বটে, কিন্তু আর এক স্থানে টাকা পাইয়াছি_”
    হ। পেয়েছ? তা আমায় এতক্ষণ বল নাই? দুর্গা, বাঁচলাম।
    ব্র। টাকাটা যে স্থানে পেয়েছি, তাহাতে সে গ্রহণ করা উচিত কি না, বলা যায় না।
    হ। কে দিল?
    ব্রজেশ্বর অধোবদনে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, “তার নামটা মনে আসচে না–সেই যে মেয়ে ডাকাইত একজন আছে?”
    হ। কে, দেবী চৌধুরাণী?
    ব্র। সেই।
    হ। তার কাছে টাকা পাইলে কি প্রকারে?
    ব্রজেশ্বরের প্রাচীন নীতিশাস্ত্রে লেখে যে, এখানে বাপের কাছে ভাঁড়াভাঁড়িতে দোষ নাই। ব্রজ বলিল, “ও টাকাটা একটু সুযোগে পাওয়া গিয়াছে।”
    হ। বদ্ লোকের টাকা। লেখাপড়া কি রকম হইয়াছে?
    ব্র। একটু সুযোগে পাওয়া গিয়াছে বলিয়া লেখাপড়া করিতে হয় নাই।
    বাপ আর এ বিষয়ে বেশী খোঁচাখুচি করিয়া জিজ্ঞাসা না করে, এ অভিপ্রায়ে ব্রজেশ্বর তখনই কথাটা চাপা দিয়া বলিল, “পাপের ধন যে গ্রহণ করে, সেও পাপের ভাগী হয়। তাই ও টাকাটা লওয়া আমার তেমন মত নয়।”
    হরবল্লভ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “টাকা নেব না ত ফাটকে যাব না কি? টাকা ধার নেব, তার আবার পাপের টাকা পুণ্যের টাকা কি? আর জপতপের টাকাই বা কার কাছে পাব? সে আপত্তি করে কাজ নাই। কিন্তু আসল আপত্তি এই যে, ডাকাইতের টাকা, তাতে আবার লেখাপড়া করে নাই–ভয় হয়, পাছে দেরী হলে বাড়ী-ঘর লুঠপাট করিয়া লইয়া যায়।”
    ব্রজেশ্বর চুপ করিয়া রহিল।
    হ। তা টাকার মিয়াদ কত দিন?
    ব্র। আগামী বৈশাখ মাসের শুক্লা সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত।
    হ। তা সে হোলো ডাকাইত। দেখা দেয় না। কোথা তার দেখা পাওয়া যাবে যে, টাকা পাঠাইয়া দিব?
    ব্র। ঐ দিন সন্ধ্যার পর সে সন্ধানপুরে কালসাজির ঘাটে বজরায় থাকিবে। সেইখানে টাকা পৌঁছিলেই হইবে।
    হরবল্লভ বলিলেন, “তা সেই দিন সেইখানেই টাকা পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে।”
    ব্রজেশ্বর বিদায় লইলেন। হরবল্লভ তখন মনে মনে বুদ্ধি খাটাইয়া কথাটা ভাল করিয়া বিচার করিয়া দেখিলেন। শেষে স্থির করিলেন, “হাঁঃ, সেই বেটীর আবার টাকা শোধ দিতে যাবে! বেটীকে সিপাহী এনে ধরিয়ে দিলেই সব গোল মিটে যাবে। বৈশাখী সপ্তমীর দিন সন্ধ্যার পর কাপ্তেন সাহেব পল্টন তার বজরায় না উঠে–ত আমার নাম হরবল্লভই নয়। তাকে আর আমার কাছে টাকা নিতে হবে না।” 
    হরবল্লভ এই পুণ্যময় অভিসন্ধিটা আপনার মনে মনেই রাখিলেন–ব্রজেশ্বরকে বিশ্বাস করিয়া বলিলেন না।
    এদিকে সাগর আসিয়া ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে গিয়া গল্প করিল যে, ব্রজেশ্বর একটা রাজরাণীর বজরায় গিয়া, তাকে বিবাহ করিয়া আসিয়াছে, –সাগর অনেক মানা করিয়াছিল, তাহা শুনে নাই। মাগী জেতে কৈবর্ত–আর তার দুইটা বিবাহ আছে–সুতরাং ব্রজেশ্বরের জাতি গিয়াছে, সুতরাং সাগর আর ব্রজেশ্বরের পাত্রাবশিষ্ট ভোজন করিবে না, ইহা স্থির প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। ব্রহ্মঠাকুরাণী এ সকল কথা ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করায় অপরাধ স্বীকার করিয়া বলিল, “রাণীজি জাত্যংশে ভাল–আমার পিতৃঠাকুরের পিসী হয়। আর বিয়ে, –তা আমারও তিনটা, তারও তিনটা।”
    ব্রহ্মঠাকুরাণী বুঝিল, কথাটা মিথ্যা; কিন্তু সাগরের মতলব যে, ব্রহ্মঠাকুরাণী এ গল্পটা নয়নতারার কাছে করে। সে বিষয়ে তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইল না। নয়নতারা একে সাগরকে দেখিয়া জ্বলিয়াছিল, আবার শুনিল যে, স্বামী একটা বুড়া কন্যে বিবাহ করিয়াছে। নয়নতারা একেবারে আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল। সুতরাং কিছুদিন ব্রজেশ্বর নয়নতারার কাছে ঘেঁষিতে পারিলেন না–সাগরের ইজারা-মহল হইয়া রহিলেন।
    সাগরের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল। কিন্তু নয়নতারা বড় গোল বাধাইল–শেষে গিন্নীর কাছে গিয়া নালিশ করিল। গিন্নী বলিলেন, “তুমি বাছা, পাগল মেয়ে। বামনের ছেলে কি কৈবর্ত বিয়ে করে গা? তোমাকে সবাই ক্ষেপায়, তুমিও ক্ষেপ।”
    নয়ান বৌ তবু বুঝিল না। বলিল, “যদি সত্য সত্যই বিয়ে হয়ে থাকে?” গিন্নী বলিলেন, “যদি সত্যই হয়, তবে বৌ বরণ করে ঘরে তুলবা। বেটার বৌ ত আর ফেলতে পারবি না।”
    এই সময়ে ব্রজেশ্বর আসিল, নয়ান বৌ অবশ্য পলাইয়া গেল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “মা, কি বলছিলে গা?”
    গিন্নী বলিলেন, “এই বলছিলাম যে, তুই যদি আবার বিয়ে করিস, তবে আবার বৌ বরণ করে ঘরে তুলি।”
    ব্রজেশ্বর অন্যমনা হইল, কিছু উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
    প্রদোষকালে গিন্নী ঠাকুরাণী কর্তা মহাশয়কে বাতাস করিতে করিতে, ভর্তৃচরণে এই কথা নিবেদন করিলেন। কর্তা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার মনটা কি?”
    গিন্নী। আমি ভাবি কি যে, সাগর বৌ ঘর করে না। নয়ান বৌ ছেলের যোগ্য বৌ নয়। তা যদি একটি ভাল দেখে ব্রজ বিয়ে করে সংসার-ধর্ম করে, আমার সুখ হয়।
    কর্তা। তা ছেলের যদি সে রকম বোঝ, তা আমায় বলিও। আমি ঘটক ডেকে ভাল দেখে সম্বন্ধ করব।
    গিন্নী। আচ্ছা, আমি মন বুঝিয়া দেখিব।
    মন বুঝিবার ভার ব্রহ্মঠাকুরাণীর উপর পড়িল। ব্রহ্মঠাকুরাণী অনেক বিরহসন্তপ্ত এবং বিবাহ-প্রয়াসী রাজপুত্রের উপকথা ব্রজকে শুনাইলেন, কিন্তু ব্রজের মন তাহাতে কিছু বোঝা গেল না। তখন ব্রহ্মঠাকুরাণী স্পষ্ট জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন। কিছুই খবর পাইলেন না। ব্রজেশ্বর কেবল বলিল, “বাপ-মা যে আজ্ঞা করিবেন, আমি তাই পালন করিব।”
    কথাটার আর বড় উচ্চবাচ্য হইল না।