পূর্বে বলিয়াছি, বজরার কাছে তেঁতুলগাছের ছায়ায় আর একখানি নৌকা
অন্ধকারে লুকাইয়াছিল। সেখানি ছিপ–ষাট হাত লম্বা, তিন হাতের
বেশী চৌড়া নয়। তাহাতে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ গাদাগাদি হইয়া
শুইয়াছিল। রঙ্গরাজের সঙ্কেত শুনিবামাত্র সেই পঞ্চাশ জন একেবারে
উঠিয়া বসিল। বাঁশের চেলা তুলিয়া সকলেই এক একগাছা সড়কি ও এক
একখানা ছোট ঢাল বাহির করিল। হাতিয়ার কেহ হাতে রাখিল না–সবাই
আপনার নিকট চেলার উপরে সাজাইয়া রাখিল। রাখিয়া সকলেই এক একখানা
“বোটে” হাতে করিয়া বসিল।
নিঃশব্দে ছিপ খুলিয়া, তাহারা বজরায় আসিয়া লাগাইল। রঙ্গরাজ তখন
নিজে পঞ্চ হাতিয়ার বাঁধিয়া উহার উপর উঠিল। সেই সময়ে যুবতী
তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “রঙ্গরাজ, আগে যাহা বলিয়া দিয়াছি, মনে
থাকে যেন।”
“মনে আছে” বলিয়া রঙ্গরাজ ছিপে উঠিল। ছিপ নিঃশব্দে তীরে তীরে
উজাইয়া চলিল। এদিকে যে বজরা রঙ্গরাজ দূরবীনে দেখিয়াছিল, তাহা
নদী বাহিয়া খরস্রোতে তীব্রবেগে আসিতেছিল। ছিপকে বড় বেশী উজাইতে
হইল না। বজরা নিকট হইলে, ছিপ তীর ছাড়িয়া বজরার দিকে ধাবমান
হইল। পঞ্চাশখানা বোটে, কিন্তু শব্দ নাই।
এখন, সেই বজরার ছাদের উপরে আট জন হিন্দুস্থানী রক্ষক ছিল। এত
লোক সঙ্গে না করিয়া তখনকার দিনে কেহ রাত্রিকালে নৌকা খুলিতে
সাহস করিত না। আট জনের মধ্যে, দুই জন হাতিয়ারবন্ধ হইয়া, মাথায়
লাল পাগড়ি বাঁধিয়া ছাদের উপর বসিয়াছিল–আর ছয় জন মধুর দক্ষিণ
বাতাসে চাঁদের আলোতে কালো দাড়ি ছড়াইয়া, সুনিদ্রায় অভিভূত ছিল।
যাহারা পাহারায় ছিল, তাহাদের মধ্যে একজন দেখিল–ছিপ বজরার দিকে
আসিতেছে। সে দস্তুরমত হাঁকিল, “ছিপ তফাৎ!”
রঙ্গরাজ উত্তর করিল, “তোর দরকার হয়, তুই তফাৎ যা।”
প্রহরী দেখিল, বেগোছ। ভয় দেখাইবার জন্য বন্দুকে একটা ফাঁকা
আওয়াজ করিল। রঙ্গরাজ বুঝিল, ফাঁকা আওয়াজ। হাসিয়া বলিল, “কি
পাঁড়ে ঠাকুর! একটা ছর্করাও নাই? ধার দিব?”
এই বলিয়া রঙ্গরাজ সেই প্রহরীর মাথা লক্ষ্য করিয়া বন্দুক উঠাইল।
তার পর বন্দুক নামাইয়া বলিল, “তোমায় এবার মারিব না। এবার তোমার
লাল পাগড়ি উড়াইব।” এই কথা বলিতে বলিতে রঙ্গরাজ বন্দুক রাখিয়া,
তীর ধনু লইয়া সজোরে তীর ত্যাগ করিল। প্রহরীর মাথার লাল পাগড়ি
উড়িয়া গেল। প্রহরী “রাম রাম!” শব্দ করিতে লাগিল।
বলিতে বলিতে ছিপ আসিয়া বজরার পিছনে লাগিল। অমনি দশ বার জন লোক
ছিপ হইতে হাতিয়ার সমেত বজরার উপর উঠিয়া পড়িল। যে ছয় জন
হিন্দুস্থানী নিদ্রিত ছিল, তাহারা বন্দুকের আওয়াজে জাগরিত
হইয়াছিল বটে, কিন্তু ঘুমের ঘোরে হাতিয়ার হাতড়াইতে তাহাদের দিন
গেল। ক্ষিপ্রহস্তে আক্রমণকারীরা তাহাদিগকে নিমেষমধ্যে বাঁধিয়া
ফেলিল। যে দুই জন আগে হইতে জাগ্রত ছিল, তাহারা লড়াই করিল,
কিন্তু সে অল্পক্ষণ মাত্র। আক্রমণকারীরা সংখ্যায় অধিক, শীঘ্র
তাহাদিগকে পরাস্ত ও নিরস্ত্র করিয়া বাঁধিয়া ফেলিল। তখন ছিপের
লোক বজরার ভিতর প্রবেশ করিতে উদ্যত হইল। বজরার দ্বার বন্ধ।
ভিতরের ব্রজেশ্বর। তিনি শ্বশুরবাড়ী হইতে বাড়ী যাইতেছিলেন। পথে
এই বিপদ। এ কেবল তাঁহার সাহসের ফল। অন্য কেহ সাহস করিয়া রাত্রে
বজরা খুলিত না।
রঙ্গরাজ কপাটে করাঘাত করিয়া বলিল, “মহাশয়! দ্বার খুলুন।”
ভিতর হইতে সদ্যোনিদ্রোত্থিত ব্রজেশ্বর উত্তর করিল, “কে? এত গোল
কিসের?”
রঙ্গরাজ বলিল, “গোল কিছুই না–বজরায় ডাকাইত পড়িয়াছে।”
ব্রজেশ্বর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া, পরে ডাকিতে লাগিল, “পাঁড়ে!
তেওয়ারি! রামসিং!”
রামসিং ছাদের উপর হইতে বলিল, “ধর্মাবতার! শালা লোক সব্ কোইকো
বাঁধ্পকে রাক্খা।”
ব্রজেশ্বর ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “শুনিয়া বড় দুঃখিত হইলাম। তোমাদের
মত বীরপুরুষদের ডালরুটি খাইতে না দিয়া বাঁধিয়া ফেলিয়াছে!
ডাকাইতের এ বড় ভ্রম। ভাবনা করিও না–কাল ডালরুটির বরাদ্দ
বাড়াইয়া দিব।”
শুনিয়া রঙ্গরাজও ঈষৎ হাসিল। বলিল, “আমারও সেই মত; এখন দ্বার
খুলিবেন বোধ হয়।”
ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”
র। আমি একজন ডাকাইত মাত্র। দ্বার খোলেন এই ভিক্ষা।
“কেন দ্বার খুলিব?”
র। আপনার সর্বস্ব লুটপাট করিব।
ব্রজেশ্বর বলিল, “কেন? আমাকে কি হিন্দুস্থানী ভেড়ীওয়ালা পাইলে?
আমার হাতে দোনলা বন্দুক আছে–তৈয়ার, যে প্রথম কামরায় প্রবেশ
করিবে, নিশ্চয় তাহার প্রাণ লইব।”
র। একজন প্রবেশ করিব না–কয় জনকে মারিবেন? আপনিও ব্রাহ্মণ–আমিও
ব্রাহ্মণ। এক তরফ ব্রহ্মহত্যা হইবে। মিছামিছি ব্রহ্মহত্যায় কাজ
কি?
ব্রজেশ্বর বলিল, “সে পাপটা না হয় আমিই স্বীকার করিব।”
এই কথা ফুরাইতে ফুরাইতে মড়্ মড়্ শব্দ হইল। বজরার পাশের দিকের
একখানা কপাট ভাঙ্গিয়া, একজন ডাকাইত কামরার ভিতর প্রবেশ করিল
দেখিয়া, ব্রজেশ্বর হাতের বন্দুক ফিরাইয়া তাহার মাথায় মারিল।
দস্যু মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল। এই সময়ে রঙ্গরাজ বাহিরের কপাটে
জোরে দুই বার পদাঘাত করিল। কপাট ভাঙ্গিয়া গেল। রঙ্গরাজ কামরার
ভিতর প্রবেশ করিল। ব্রজেশ্বর আবার বন্দুক ফিরাইয়া ধরিয়া,
রঙ্গরাজকে লক্ষ্য করিতেছিলেন, এমন সময়ে রঙ্গরাজ তাঁহার বন্দুক
কাড়িয়া লইল। দুই জনেই তুল্য বলশালী, তবে রঙ্গরাজ অধিকতর
ক্ষিপ্রহস্ত। ব্রজেশ্বর ভাল করিয়া ধরিতে না ধরিতে, রঙ্গরাজ
বন্দুক কাড়িয়া লইল। ব্রজেশ্বর তখন দৃঢ়তর মুষ্টিবদ্ধ করিয়া
সমুদয় বলের সহিত রঙ্গরাজের মাথায় এক ঘুষি তুলিল । রঙ্গরাজ
ঘুষিটা হাতে ধরিয়া ফেলিল। বজরার একদিকে অনেক অস্ত্র ঝুলান ছিল।
এই সময়ে ব্রজেশ্বর ক্ষিপ্রহস্তে তাহার মধ্য হইতে একখানা
তীক্ষ্ণধার তরবারি লইয়া হাসিয়া বলিল, “দেখ ঠাকুর, ব্রহ্মহত্যায়
আমার ভয় নাই।” এই বলিয়া রঙ্গরাজকে কাটিতে ব্রজেশ্বর তরবারি
উঠাইল। সেই সময়ে আর চারি পাঁচ জন দস্যু মুক্তদ্বারে কামরার
ভিতর প্রবেশ করিয়া, তাহার উপর পড়িল। উত্থিত তরবারি হাত হইতে
কাড়িয়া লইল। দুই জনে দুই হাত চাপিয়া ধরিল–একজন দড়ি লইয়া
ব্রজেশ্বরকে বলিল, “বাঁধিতে হইবে কি?” তখন ব্রজেশ্বর বলিল,
“বাঁধিও না। আমি পরাজয় স্বীকার করিলাম। কি চাও বল–আমি দিতেছি।”
রঙ্গরাজ বলিল, “আপনার যাহা কিছু আছে, সব লইয়া যাইব। কিছু ছাড়িয়া
দিতে পারিতাম–কিন্তু যে কিল তুলিয়াছিলেন–আমার মাথায় লাগিলে
মাথা ভাঙ্গিয়া যাইত–এক পয়সাও ছাড়িব না।”
ব্রজেশ্বর বলিল, “যাহা বজরায় আছে–সব লইয়া যাও, এখন আর আপত্তি
করিব না।”
ব্রজেশ্বর এ কথা বলিবার পূর্বেই দস্যুরা জিনিসপত্র বজরা হইতে
ছিপে তুলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এখন প্রায় পঁচিশ জন লোক বজরায়
উঠিয়াছিল। জিনিসপত্র বজরায় বিশেষ কিছু ছিল না, কেবল পরিধেয়
বস্ত্রাদি, পূজার সামগ্রী, এইরূপ মাত্র। মুহূর্তমধ্যে তাহারা
সেই সকল দ্রব্য ছিপে তুলিয়া ফেলিল। তখন আরোহী রঙ্গরাজকে বলিল,
“সব জিনিস লইয়াছ–আর কেন দিক কর, এখন স্বস্থানে যাও।”
রঙ্গরাজ উত্তর করিল, “যাইতেছি। কিন্তু আপনাকেও আমাদের সঙ্গে
যাইতে হইবে।”
ব্র। সে কি? আমি কোথায় যাইব?
র। আমাদের রাণীর আছে।
ব্র। তোমাদের আবার রাণী কে?
র। আমাদের রাজরাণী।
ব্র। তিনি আবার কে? ডাকাইতের রাজরাণী ত কখন শুনি নাই।
র। দেবী রাণীর নাম কখনও শুনেন নাই?
ব্র। ও হো! তোমরা দেবী চৌধুরাণীর দল?
র। দলাদলি আবার কি? আমরা রাণীজির কার্পর্দাজ।
ব্র। যেমন রাণী, তেমন কার্পকর্দাজ! তা, আমাকে রাণী দর্শনে
যাইতে হইবে কেন? আমাকে কয়েদ রাখিয়া কিছু আদায় করিবে, এই
অভিপ্রায়?
র। কাজেই বজরায় ত কিছু পাইলাম না। আপনাকে আটক করিলে যদি কিছু
পাওয়া যায়।
ব্র। আমারও যাইবার ইচ্ছা হইতেছে–তোমাদের রাজরাণী একটা দেখবার
জিনিস শুনিয়াছি। তিনি না কি যুবতী?
র। তিনি আমাদের মা–সন্তানে মার বয়সের হিসাব রাখে না।
ব্র। শুনিয়াছি বড় রূপবতী।
র। আমাদের মা ভগবতীর তুল্য।
ব্র। চল, তবে ভগবতী-দর্শনে যাই।
এই বলিয়া, ব্রজেশ্বর রঙ্গরাজের সঙ্গে কামরার বাহিরে আসিলেন।
দেখিলেন যে, বজরার মাঝিমাল্লা সকলে ভয়ে জলে পড়িয়া কাছি ধরিয়া
ভাসিয়া আছে। ব্রজেশ্বর তাহাদিগকে বলিলেন, “এখন তোমরা বজরায়
উঠিতে পার–ভয় নাই। উঠিয়া আল্লার নাম নাও। তোমাদের জান ও মান ও
দৌলত ও ইজ্জৎ সব বজায় আছে! তোমরা বড় হুঁশিয়ার!”
মাঝিরা তখন একে একে বজরায় উঠিতে লাগিল। ব্রজেশ্বর রঙ্গরাজকে
জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আমার দ্বারবান্ দের বাঁধন খুলিয়া দিতে
পারি কি?”
রঙ্গরাজ বলিল, “আপত্তি নাই। উহারা যদি হাত খোলা পাইয়া আমাদের
উপর আক্রমণ করে, তখনই আমরা আপনার মাথা কাটিয়া ফেলিব। ইহা
উহাদের বুঝাইয়া দিন।”
ব্রজেশ্বর দ্বারবান্ দিগকে সেইরূপ বুঝাইয়া দিলেন। আর ভরসা
দিলেন যে, তাহারা যেরূপ বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছে, তাহাতে শীঘ্রই
তাহাদের ডালরুটির বরাদ্দ বাড়িবে। তখন ব্রজেশ্বর ভৃত্যবর্গকে
আদেশ করিলেন যে, “তোমরা নিঃশঙ্কচিত্তে এইখানে বজরা লইয়া থাক।
কোথাও যাইও না বা কিছু করিও না। আমি শীঘ্র ফিরিয়া আসিতেছি।” এই
বলিয়া তিনি রঙ্গরাজের সঙ্গে ছিপে উঠিলেন। ছিপের নাবিকেরা “দেবী
রাণী-কি জয়” হাঁকিল–ছিপ বাহিয়া চলিল।