দ্বিতীয় খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর যাইতে যাইতে রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমাকে কত দূর লইয়া
যাইবে–তোমার রাণীজি কোথায় থাকেন?”
র। ঐ বজরা দেখিতেছ না? ঐ বজরা তাঁর।
ব্র। ও বজরা? আমি মনে করিয়াছিলাম, ওখানা ইংরেজের জাহাজ–রঙ্গপুর
লুটিতে আসিয়াছে। তা এত বড় বজরা কেন?
র। রাণীকে রাণীর মত থাকিতে হয়। উহাতে সাতটা কামরা আছে।
ব্র। এত কামরায় কে থাকে?
র। একটায় দরবার। একটায় রাণীর শয়নঘর। একটায় চাকরাণীরা থাকে।
একটায় স্নান হয় একটায় পাক হয়। একটা ফাটক। বোধ হয়, আপনাকে আজ সেই কামরায় থাকিতে
হইবে।
এই কথোপকথন হইতে হইতে ছিপ আসিয়া বজরার পাশে ভিড়িল। দেবী রাণী
ওরফে দেবী চৌধুরাণী তখন আর ছাদের উপর নাই। যতক্ষণ তাহার লোকে ডাকাইতি করিতেছিল,
দেবী ততক্ষণ ছাদের উপর বসিয়া জ্যোৎস্নালোকে বীণা বাজাইতেছিল। তখন বাজনাটা বড়
ভাল হইতেছিল না–বেসুর, বেতাল, কি বাজিতে কি বাজে–দেবী অন্যমনা হইতেছিল। তার পরে
যে ছিপ ফিরিল, দেবী অমনি নামিয়া কামরার ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিল। এদিকে রঙ্গরাজ
ছিপ হইতে কামরার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া, “রাণীজি-কি জয়” বলিল। দ্বারে রেশমী
পর্দা ফেলা আছে–ভিতরে দেখা যায় না। ভিতর হইতে দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “কি সংবাদ?”
র। সব মঙ্গল।
দেবী। তোমাদের কেহ জখম হইয়াছে?
র। কেহ না।
দেবী। তাহাদের কেহ খুন হইয়াছে?
র। কেহ না–আপনার আজ্ঞামত কাজ হইয়াছে।
দেবী। তাহাদের কেহ জখম হইয়াছে?
র। দুইটা হিন্দুস্থানী দুই একটা আঁচড় খেয়েছে। কাঁটা ফোটার মত।
দেবী। মাল?
র। সব আনিয়াছি। মাল এমন কিছু ছিল না।
দেবী। বাবু?
র। বাবুকে ধরিয়া আনিয়াছি।
দেবী। হাজির কর।
রঙ্গরাজ তখন ব্রজেশ্বরকে ইঙ্গিত করিল। ব্রজেশ্বর ছিপ হইতে উঠিয়া
আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল।
দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে?” দেবীর যেন বিষম লাগিয়াছে–গলার
আওয়াজটা বড় সাফ নয়।
ব্রজেশ্বর যেরূপ লোক, পাঠক এতক্ষণে বুঝিয়াছেন বোধ হয়। ভয় কাহাকে
বলে, তাহা তিনি বালককাল হইতে জানেন না। যে দেবী চৌধুরাণীর নামে উত্তর-বাঙ্গালা
কাঁপিত, তাহার কাছে আসিয়া ব্রজেশ্বরের হাসি পাইল। মনে ভাবিলেন, “মেয়েমানুষকে
পুরুষে ভয় করে, এ ত কখনও শুনি নাই। মেয়েমানুষ ত পুরুষের বাঁদী।” হাসিয়া
ব্রজেশ্বর দেবীর কথায় উত্তর দিলেন, “পরিচয় লইয়া কি হইবে? আমার ধনের সঙ্গে
আপনাদিগের সম্বন্ধ, তাহা পাইয়াছেন–নামে ত টাকা হইবে না।”
দেবী। হইবে বৈ কি? আপনি কি দরের লোক, তাহা জানিলে টাকার ঠিকানা
হইবে। (তবু গলাটা ধরা ধরা।)
ব্র। সেইজন্যই কি আমাকে ধরিয়া আনিয়াছেন?
দেবী। নহিলে আপনাকে আনিতাম না।
দেবী পর্দার আড়ালে, কেহ দেখিল না যে, দেবী এই কথা বলিবার সময়
চোখ মুছিল।
ব্র। আমি যদি বলি, আমার নাম দুঃখিরাম চক্রবর্তী, আপনি বিশ্বাস
করিবেন কি?
দেবী। না।
ব্র। আপনি বলেন কি না, দেখিবার জন্য।
ব্র। আমার নাম কৃষ্ণগোবিন্দ ঘোষাল।
দেবী। না।
ব্র। দয়ারাম বক্সী।
দেবী। তাও না।
ব্র। ব্রজেশ্বর রায়।
দেবী। হইতে পারে।
এই সময়ে দেবীর কাছে আর একজন স্ত্রীলোক নিঃশব্দে আসিয়া বসিল।
বলিল, “গলাটা ধরে গেছে যে?”
দেবীর চক্ষের জল আর থাকিল না–বর্ষাকালে ফুটন্ত ফুলের ভিতর যেমন
বৃষ্টির জল পোরা থাকে, ডাল নাড়া দিলেই ছড়্ ছড়্ করিয়া পড়িয়া যায়, দেবীর চোখে
তেমনি জল পোরা ছিল, ডাল নাড়া দিতেই ঝর্ ঝর্ করিয়া পড়িয়া গেল। দেবী তখন ঐ
স্ত্রীলোককে কাণে কাণে বলিল, “আমি আর এ রঙ্গ করিতে পারি না। তুই কথা ক। সব
জানিস ত?”
এই বলিয়া দেবী সে কামরা হইতে উঠিয়া অন্য কামরায় গেল। ঐ
স্ত্রীলোকটি দেবীর আসন গ্রহণ করিয়া, ব্রজেশ্বরের সহিত কথা কহিতে লাগিল। এই
স্ত্রীলোকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে–ইনি সেই বামনশূন্য বামনী–নিশি ঠাকুরাণী।
নিশি বলিল, “এইবার ঠিক বলেছ–তোমার নাম ব্রজেশ্বর রায়।”
ব্রজেশ্বরের একটু গোল বাধিল। পর্দার আড়ালে কিছুই দেখিতে
পাইতেছিলেন না–কিন্তু কথার আওয়াজে সন্দেহ হইল যে, যে কথা কহিতেছিল, এ সে বুঝি
নয়। তার আওয়াজটা বড় মিঠে লাগিতেছিল–এ বুঝি তত মিঠে নয়। যাই হউক, কথার উত্তরে
ব্রজেশ্বর বলিলেন, “যদি আমার পরিচয় জানেন, তবে এই বেলা দরটা চুকাইয়া লউন–আমি
স্বস্থানে চলিয়া যাই। কি দরে আমাকে ছাড়িবেন?”
নি। এক কড়া কাণা কড়ি। সঙ্গে আছে কি? থাকে যদি, দিয়া চলিয়া যান।
ব্র। আপাততঃ সঙ্গে নাই।
নি। বজরা হইতে আনিয়া দেন।
ব্র। বজরাতে যাহা ছিল, তাহা আপনার অনুচরেরা লইয়া আসিয়াছে। আর এক
কড়া কাণা কড়িও নাই।
নি। মাঝিদের কাছে ধার করিয়া আনুন।
ব্র। মাঝিরাও কাণা কড়ি রাখে না।
নি। তবে যত দিন না আপনার উপযুক্ত মূল্য আনাইয়া দিতে পারেন,
ততদিন কয়েদ থাকুন।
ব্রজেশ্বর তার পর শুনিলেন, কামররার ভিতরে আর একজন কে–কণ্ঠে সেও
বোধহয় স্ত্রীলোক–দেবীকে বলিতেছে, “রাণীজি! যদি এক কড়া কাণা কড়িই এই মানুষটার দর
হয়, তবে আমি এক কড়া কাণা কড়ি দিতেছি। আমার কাছে উহাকে বিক্রি করুন।”
ব্রজেশ্বর শুনিলেন, রাণী উত্তর করিল, “ক্ষতি কি? কিন্তু মানুষটা
নিয়ে তুমি কি করিবে? ব্রাহ্মণ, জল তুলিতে, কাঠ কাটিতে পারিবে না।”
ব্রজেশ্বর প্রত্যুত্তরও শুনিলেন,–রমণী বলিল, “আমার রাঁধিবার
ব্রাহ্মণ নাই। আমাকে রাঁধিয়া দিবে।”
তখন নিশি ব্রজেশ্বরকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “শুনিলেন, –আপনি
বিক্রি হইলেন–আমি কাণা কড়ি পাইয়াছি। যে আপনাকে কিনিল, আপনি তাহার সঙ্গে যান,
রাঁধিতে হইবে।”
ব্রজেশ্বর বলিল, “কই তিনি?”
নি। স্ত্রীলোক–বাহিরে যাইবে না, আপনি ভিতরে আসুন।
ব্রজেশ্বর অনুমতি পাইয়া, পর্দা তুলিয়া কামরার ভিতরে প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়া
যাহা দেখিল, ব্রজেশ্বর তাহাতে বিস্মিত হইল। কামরার কাষ্ঠের দেওয়াল, বিচিত্র
চারুচিত্রিত। যেমন আশ্বিন মাসে ভক্ত জনে দশভুজা প্রতিমা পূজা করিবার মানসে
প্রতিমার চাল চিত্রিত করায় –এ তেমনি চিত্র। শুম্ভনিশুম্ভের যুদ্ধ; মহিষাসুরের
যুদ্ধ; দশ অবতার; অষ্ট নায়িকা; সপ্ত মাতৃকা; দশ মহাবিদ্যা; কৈলাস; বৃন্দাবন;
লঙ্কা; ইন্দ্রালয়; নবানারী-কুঞ্জর; বস্ত্রহরণ; সকলই চিত্রিত। সেই কামরায় চারি
আঙ্গুল পুরু গালিচা পাতা তাহাতেও কত চিত্র। তার উপর কত উচ্চ মসনদ–মখমলের কামদার
বিছানা, তিন দিকে সেইরূপ বালিশ; সোণার আতরদান, তারই গোলাব-পাশ, সোণার বাটা,
সোনার পুষ্পপাত্র–তাহাতে রাশীকৃত সুগন্ধি ফুল; সোণার আলবোলা; পোরজরেরট
সটকা–সোণার মুখনলে মতির থোপ দুলিতেছে–তাহাতে মৃগনাভি-সুগন্ধি তামাকু সাজা আছে।
দুই পাশে দুই রূপার ঝাড়, তাহাতে বহুসংখ্যক সুগন্ধি দীপ রূপার পরীর মাথার উপর
জ্বলিতেছে; উপরের ছাদ হইতে একটি ছোট দীপ সোণার শিকলে লটকােন আছে। চারি কোণে
চারিটি রূপার পুতুল, চারিটি বাতি হাতে করিয়া ধরিয়া আছে।–মসনদের উপর একজন
স্ত্রীলোক শুইয়া আছে–তাহার মুখের উপর একখানা বড় মিহি জরির বুটাদার ঢাকাইরুমাল
ফেলা আছে। মুখ ভাল দেখা যাইতেছে না–কিন্তু তপ্তকাঞ্চন-গৌরবর্ণ–আর কৃষ্ণ কুঞ্চিত
কেশ অনুভূত হইতেছে; কাণের গহনা কাপড়ের ভিতর হইতে জ্বলিতেছে–তার অপেক্ষা বিস্তৃত
চক্ষের তীব্র কটাক্ষ আরও ঝলসিতেছে। স্ত্রীলোকটি শুইয়া আছে–ঘুমায় নাই।
ব্রজেশ্বর দরবার-কামরায় প্রবেশ করিয়া শয়ানা সুন্দরীকে দেখিয়া
জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাণীজিকে কি বলিয়া আশীর্বাদ করিব?”
সুন্দরী উত্তর করিল, “আমি রাণীজি নই।”
ব্রজেশ্বর দেখিল, এতক্ষণ ব্রজেশ্বর যাহার সঙ্গে কথা কহিতেছিল, এ
তাহার গলার আওয়াজ নহে। অথচ তার আওয়াজ হইতে পারে; কেন না বেশ স্পষ্ট বুঝা
যাইতেছে যে, স্ত্রীলোক কণ্ঠ বিকৃত করিয়া কথা কহিতেছে। মনে করিল, বুঝি দেবী
চৌধুরাণী হরবোলা, মায়াবিনী–এত কুহক না জানিলে মেয়েমানুষ হইয়া ডাকাইতি করে?
প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করিল, “এই যে তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতেছিলাম–তিনি কোথায়?”
সুন্দরী বলিল, “তোমাকে আসিতে অনুমতি দিয়া, তিনি শুইতে গিয়াছেন।
রাণীতে তোমার কি প্রয়োজন?”
ব্র। তুমি কে?
সুন্দরী। তোমার মুনিব।
ব্র। আমার মুনিব?
সুন্দরী। জান না, এই মাত্র তোমাকে এক কড়া কাণা কড়ি দিয়া
কিনিয়াছি?
ব্র। সত্য বটে। তা তোমাকেই কি বলিয়া আশীর্বাদ করিব?
সুন্দরী। আশীর্বাদের রকম আছে না কি?
ব্র। স্ত্রীলোকের পক্ষে আছে। সধবাকে এক রকম আশীর্বাদ করিতে হয়,
–বিধবাকে অন্যরূপ। পুত্রবতীকে–
সুন্দরী। আমাকে “শিগ্গির মর” বলিয়া আশীর্বাদ কর।
ব্র। সে আশীর্বাদ আমি কাহাকেও করি না–তোমার একশ তিন বছর পরমায়ু
হৌক।
সুন্দরী। আমার বয়স পঁচিশ বৎসর। আটাত্তর বৎসর ধরিয়া তুমি আমার
ভাত রাঁধিবে?
ব্র। আগে একদিন ত রাঁধি। খেতে পার ত, না হয় আটাত্তর বৎসর
রাঁধিব।
সুন্দরী। তবে বসো–কেমন রাঁধিতে জান, পরিচয় দাও।
ব্রজেশ্বর তখন সেই কোমল গালিচার উপর বসিল। সুন্দরী জিজ্ঞাসা
করিল, “তোমার নাম কি?”
ব্র। তা ত তোমরা সকলেই জান, দেখিতেছি। আমার নাম ব্রজেশ্বর।
তোমার নাম কি? গলা অত মোটা করিয়া কথা কহিতেছ কেন? তুমি কি চেনা মানুষ
সুন্দরী। আমি তোমার মুনিব–আমাকে ‘আপুনি’ ‘মশাই’ আর ‘আজ্ঞে’
বলিবে।
ব্র। আজ্ঞে, তাই হইবে। আপনার নাম?
সুন্দরী। আমার নাম পাঁচকড়ি। কিন্তু তুমি আমার ভৃত্য, আমার নাম
ধরিতে পারিবে না। বরং বল ত আমিও তোমার নাম ধরিব না।
ব্র। তবে কি বলিয়া ডাকিলে আমি ‘আজ্ঞা’ বলিব?
পাঁচ। আমি ‘রামধন’ বলিয়া তোমাকে ডাকিব। তুমি আমাকে ‘মুনিব
ঠাকুরুণ’ বলিও। এখন তোমার পরিচয় দাও–বাড়ী কোথায়?
ব্র। এক কড়ায় কিনিয়াছ–অত পরিচয়ের প্রয়োজন কি?
পাঁচ। ভাল, সে কথা নাই বলিলে। রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা করিলে জানিতে
পারিব। রাঢ়ী, না বারেন্দ্র, না বৈদিক?
ব্র। হাতের ভাত ত খাইবেন–যাই হই না।
পাঁচ। তুমি যদি আমার স্বশ্রেণী না হও–তাহা হইলে তোমাকে অন্য কাজ
দিব।
ব্র। অন্য কি কাজ?
পাঁচ। জল তুলিবে, কাঠ কাটিবে–কাজের অভাব কি!
ব্র। আমি রাঢ়ী।
পাঁচ। তবে তোমায় জল তুলিতে, কাঠ কাটিতে হইবে–আমি বারেন্দ্র।
তুমি রাঢ়ী–কুলীন, না বংশজ?
ব্র। এ কথা ত বিবাহের সম্বন্ধের জন্যই প্রয়োজন হয়। সম্বন্ধ
জুটিবে কি? আমি কৃতদার।
পাঁচ। কৃতদার? কয় সংসার করিয়াছেন?
ব্র। জল তুলিতে হয়–জল তুলিব–অত পরিচয় দিব না।
তখন পাঁচকড়ি দেবী রাণীকে ডাকিয়া বলিল, “রাণীজি! বামুন ঠাকুর বড়
অবাধ্য। কথার উত্তর দেয় না।”
নিশি অপর কক্ষ হইতে উত্তর করিল, “বেত লাগাও।”
তখন দেবীর একজন পরিচারিকা সপাং করিয়া একগাছা লিকলিকে সরু বেত
পাঁচকড়ির বিছানায় ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। পাঁচকড়ি বেত পাইয়া ঢাকাই রুমালের ভিতর
মধুর অধর চারু দন্তে টিপিয়া বিছানায় বার দুই বেতগাছা আছড়াইল। ব্রজেশ্বরকে বলিল,
“দেখিয়াছ?”
ব্রজেশ্বর হাসিল। বলিল, “আপনারা সব পারেন। কি বলিতে হইবে
বলিতেছি।”
পাঁচ। তোমার পরিচয় চাই না–পরিচয় লইয়া কি হইবে? তোমার রান্না ত
খাইব না। তুমি আর কি কাজ করিতে পার, বল?
ব্র। হুকুম করুন।
পাঁচ। জল তুলিতে জান?
ব্র। না।
পাঁচ। কাঠ কাটিতে জান?
ব্র। না।
পাঁচ। বাজার করিতে জান?
ব্র। মোটামুটি রকম।
পাঁচ। মোটামুটিতে চলিবে না। বাতাস করিতে জান?
ব্র। পারি।
পাঁচ। আচ্ছা, এই চামর নাও, বাতাস কর।
ব্রজেশ্বর চামর লইয়া বাতাস করিতে লাগিল। পাঁচকড়ি বলিল, “আচ্ছা,
একটা কাজ জান? পা টিপিতে জান?”
ব্রজেশ্বরের দুরদৃষ্ট, তিনি পাঁচকড়িকে মুখরা দেখিয়া, একটি ছোট
রকমের রসিকতা করিতে গেলেন। এই দস্যুনেত্রীদিগের কোন রকমে খুসি করিয়া মুক্তিলাভ
করেন, সে অভিপ্রায়ও ছিল। অতএব পাঁচকড়ির কথার উত্তরে বলিলেন, “তোমাদের মত
সুন্দরীর পা টিপিব, সে ত ভাগ্য‒”
“তবে একবার টেপ না” বলিয়া অমনি পাঁচকড়ি আলতাদপরা রাঙ্গা পাখানি
ব্রজেশ্বরের ঊরুর উপর তুলিয়া দিল।
ব্রজেশ্বর নাচার–আপনি পা টেপার নিমন্ত্রণ লইয়াছেন, কি করেন।
ব্রজেশ্বর কাজেই দুই হাতে পা টিপিতে আরম্ভ করিলেন। মনে করিলেন, “এ কাজটা ভাল
হইতেছে না, ইহার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। এখন উদ্ধার পেলে বাঁচি।”
তখন দুষ্টা পাঁচকড়ি ডাকিল “রাণীজি! একবার এদিকে আসুন।”
দেবী আসিতেছে, ব্রজেশ্বর পায়ের শব্দ পাইল। পা নামাইয়া দিল।
পাঁচকড়ি হাসিয়া বলিল, “সে কি? পিছাও কেন?” পাঁচকড়ি সহজ গলায় কথা কহিয়াছিল।
ব্রজেশ্বর বড় বিস্মিত হইলেন–“সে কি? এ গলা ত চেনা গলাই বটে।” সাহস করিয়া
ব্রজেশ্বর পাঁচকড়ির মুখঢাকা রুমালখানা খুলিয়া লইলেন। পাঁচকড়ি খিল্ খিল্ করিয়া
হাসিয়া উঠিল।
ব্রজেশ্বর বিস্মিত হইয়া বলিল, “সে কি? এ কি? তুমি–তুমি সাগর?”
পাঁচকড়ি বলিল, “আমি সাগর। গঙ্গা নই–যমুনা নই–বিল নই–খাল
নই–সাক্ষাৎ সাগর। তোমার বড় অভাগ্য–না? যখন পরের স্ত্রী মনে করিয়াছিলে, তখন বড়
আহ্লাদ করিয়া পা টিপিতেছিলে, আর যখন ঘরের স্ত্রী হইয়া পা টিপিতে বলিয়াছিলাম,
তখন রাগে গর্গহর্ করিয়া চলিয়া গেলে। যাক, এখন আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইয়াছে।
তুমি আমার পা টিপিয়াছ। এখন আমার মুখপানে চাহিয়া দেখিতে পার, আমায় ত্যাগ কর, আর
পায়ে রাখ–এখন জানিলে, আমি যথার্থ ব্রাহ্মণের মেয়ে।”